একজন জনপ্রিয় এবং মেধাবী অভিনেতা হিসেবে শাহরুখ খানের যে পরিচিতি রয়েছে তা নিয়ে হয়তো কেউ সন্দেহ পোষণ করবেন না। বেশ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান, মঞ্চকাঁপানো নৃত্যভঙ্গিমা আর ঝলমলে পোষাকের দ্বারা তিনি এবং তার দল অবশেষে বঙ্গবিজয় পর্ব সমাধা করলেন। পত্রিকান্তরে আমরা জানতে পারলাম- এই সোনার বাংলা থেকে সোনা নয়, তিনি এযুগের ঈশ্বর টাকা নিয়েছেন এবং এর সত্যিকারের পরিমাণটি নেহাৎ কম নয়। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কল্যাণে পঁচিশ হাজারী থেকে তিন হাজারী কোন ধাপের প্রবেশ পত্রই যারা হস্তগত করতে পারেননি তারাও অনুষ্ঠানটির স্বাদ বঞ্চিত থাকেননি।
শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা এদেশে বলিউডের অন্য যেকোন নায়ক-নায়িকার চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি, তার অভিনীত সিনেমাগুলোর নিবিষ্ট দর্শকের সংখ্যা এদেশে উল্লেখযোগ্য আর এ জনপ্রিয়তা একদিনে তৈরি হয়নি, হয়েছে দীর্ঘদিনে- ক্রমে ক্রমে।
কিন্তু আমরা কি আয়নায় আমাদের নিজেদের মুখ দেখবনা! মুক্ত বাতায়নের অর্গল ভেদ করে শয্যাপার্শ্বে নাপাম বোমা এসে পড়লেও যদি আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হই, তবে ধরে নেয়া যায় মানুষ হিসেবে আমাদের স্থূল, সুক্ষ্ম সবধরনের বোধেরই অপমৃত্যু ঘটেছে।
আপন অস্তিত্ত্ব রক্ষার সংগ্রামে অন্য সকল প্রাণীর ন্যায় মানুষও যথাযথ কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে বলেই প্রস্তর যুগ থেকে আজ অবধি মানুষ টিকে আছে। সভ্যতার কালপরম্পরায় জৈবিক দেহটির অস্তিত্ত্ব রক্ষার পাশাপাশি চিন্তা, সৃজনকর্ম, মূল্যবোধ, ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতির জন্য সংগ্রামটিকেও সে আপন অস্তিত্ত্বরক্ষার সংগ্রামের সাথে যুক্ত করে নিয়েছে। অনাগত কালে হয়তো এ তালিকায় আরও অনেক বিষয় যুক্ত হবে যেগুলোর নামও এখনকার মানুষ জানে না।
বাংলাদেশের আষ্টেপৃষ্ঠে দারিদ্র বাসা বেঁধে থাকলেও প্রতিভাবান এবং প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেতা-অভিনেত্রীর অবস্থিতি এ দেশে নিতান্ত নগণ্য নয়।
তাদের অনেকেই রয়েছেন যারা যথার্থভাবেই গুণী অভিধা পেতে পারেন যদিও ধনী অভিধাটি হয়তো তাদের ভাগ্যে কোনদিন জুটবে না, শাহরুখ খান এই দিকটিতেও ছক্কা হাঁকিয়েছেন। হিন্দি সিনেমা দেখা কোনও পাপকর্ম নয় যেমন পাপকর্ম নয় তামিল, কানাড়া, ইংরেজি, উর্দু বা ফরাসি সিনেমা দেখা। কিন্তু এ ধরনের ব্যাপক পরিসরের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আয়োজকবৃন্দ, সর্বোপরি আবেগাপ্লুত দর্শককুল বাংলাদেশের গুণী শিল্পী-অভিনেতা প্রমূখের বহুদিনের প্রচেষ্টায় তৈরি শোভন, রুচিশীল এবং দেশজ সাংস্কৃতিক হৃদপিণ্ডটিতে একটি সূঁচালো পেরেক ঠুকে দিয়েছেন, যার ফলে শুরু হওয়া রক্তক্ষরণের প্রভাব আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে সুদীর্ঘকাল।
শাহরুখ খানকে এত বিশাল মাত্রার একটি বাণিজ্যিক লাভালাভের সুযোগ করে দিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ স্থানান্তরের হিসেবটুকু হয়তো অঙ্ক কষে বের করা যাবে কিন্তু ভোগস্পৃহায় উন্মত্ত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসলোকে যে সর্বনাশের বীজ রোপিত হল তার পরিমাণ কখনো হিসেব কষে বের করা যাবে না। এক ডজন জাগরণের গানের এ্যালবাম,বদলে যাও বদলে দাও ধাঁচের দুই ডজন স্লোগান আর শীতার্তদের সহায়তা কামনায় করা তিন ডজন আবেদন এই বিশেষ শ্রেণীটিকে যতখানি মানবতার প্রতি, দেশের প্রতি, নিজেকে উপলব্ধি করার প্রতি সজাগ করে তুলেছিল এই ধাঁচের একটিমাত্র অনুষ্ঠান তার চেয়ে দ্বিগুণ বেগে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
উল্লেখিত দেশজ সংস্কৃতির হৃদপিণ্ডটিকে রক্ষা প্রকারান্তরে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সাথেই যুক্ত, সমধর্মী আরেকটি সংগ্রাম যেমন করে যাচ্ছেন জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জ। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সাথে তিনি যুক্ত করেছেন তথ্য জানার অধিকারের সংগ্রামকে। তার এ সংগ্রামকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় যেভাবেই আমরা সমর্থন জানাইনা কেন, তা হয়ে দাঁড়াবে সেই চিরায়ত মানব-সংগ্রামের অংশ ; যে সংগ্রামের দ্বারা মানুষ বাঁচে, আরও ভালোভাবে বাঁচে। পক্ষান্তরে শাহরুখ খানের এ ধরণের একটি অনুষ্ঠানকে সমর্থন দেয়ার মানে হল আমরা নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামের ধারণাটিতে বিশ্বাসী নই - আমরা আত্মহন্তারক জাতিতে পরিণত হতে চাই।
---------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।