আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কমিউনিষ্ট সাংবাদিক, কবি কমরেড সুধীর চৌধুরী চলে গেলেন

চলে গেলেন প্রবীণ কমিউনিষ্ট সাংবাদিক, কবি কমরেড সুধীর চৌধুরী। ১৯৬৭ সালে সান্ধ্য দৈনিক হিসাবে গণশক্তি-র আত্মপ্রকাশের সময় থেকেই আমৃত্যু এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রয়াত কমরেড চৌধুরী। বেশ কিছুদিন গণশক্তি-র মুখ্য সাংবাদিকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতায় ভূগছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে বেলেঘাটায় একটি বেসরকারী নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়।

১৪ই ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যািগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯বছর। প্রয়াত সুধীর চৌধুরীর স্ত্রী কৃষ্ণা চৌধুরী ও একমাত্র পুত্র অভীক চৌধুরী বর্তমান। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়াতে জন্ম হয় সুধীর চৌধুরীর। দেশভাগের পর তাঁদের পরিবার দক্ষিণ ২৪পরগণা জেলার সোনারপুরের চৌহাটি-র ডি ব্লকের বাসিন্দা হয়।

এখানে হরিনাভি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন সুধীর চৌধুরী। পরে আশুতোষ কলেজে তিনি ভর্তি হন। পশ্চিমবঙ্গে উত্তাল গণআন্দোলনের শীর্ষে ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে সময়ের চাহিদামত পার্টির রাজ্য কমিটির মুখপত্র হিসাবে যে গুটিকয়েক কর্মীকে নিয়ে গণশক্তি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছিলো, সুধীর চৌধুরী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তখন তিনি থাকতেন সোনারপুরে। সেখান থেকেই রোজ যাতায়াত করতেন।

অল্প কয়েকজন কমরেড থাকায় সবাইকেই সব কাজ করতে হতো—রিপোর্টিং থেকে প্রুফ রিডিং সব কাজই করতেন কমরেড সুধীর। চার পাতার ছোট কাগজ। সান্ধ্য দৈনিক। বিকালে পত্রিকা প্রকাশ হতো। তাই খুব সকালেই তিনি দপ্তরে এসে উপস্থিত হতেন।

অতি সাধারণ ঘরের ছেলে। ছিল না কোন অহঙ্কার। ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। এলাকায় রাজনীতি করার কারণে ছিলেন জনপ্রিয়।

জনপ্রিয় ছিলেন কর্মক্ষেত্রেও। সংবাদ সংগ্রহ এবং তার উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই আন্তরিক। ১৯৬৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। তৈরি হয় যুক্তফ্রণ্ট সরকার। মাত্র ৯মাসের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের যুক্তফ্রণ্ট সরকারকে ভেঙে দেয়।

তৈরি হয় প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে পি ডি এফ সরকার। পুলিস নির্বিচারে গ্রেপ্তার করতে শুরু করলো পার্টির নেতা ও কর্মীদের। সি পি আই (এম)-র রাজ্য দপ্তরেও এক রাতে পুলিস হানা দেয়। গণশক্তি প্রকাশ হতো ওই বাড়ি থেকেই। পুলিস গণশক্তি দপ্তরেও আসে।

সে রাতে দপ্তরে ছিলেন বর্তমান সম্পাদক নারায়ণ দত্ত, সুধীর চৌধুরী ও ম্যানেজার প্রণব প্রিয় পাল। নৈশ প্রহরীর তৎপরতায় তাঁরা পুলিসের হাত থেকে রেহাই পান। ১৯৭২ সালে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে সিদ্ধার্থ রায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে কংগ্রেসী শাসন শুরু হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই সরকারের শাসনকালে সি পি আই (এম)-র এক হাজারের বেশি কর্মী খুন হন। কমরেড সুধীর চৌধুরী জীবনের ঝুকি নিয়েই এ সমস্ত খবর সংগ্রহ করতে যেতেন।

বহু ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। কিন্তু খবর সংগ্রহে পিছুপা হননি। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে গণতন্ত্রকে খুন করে ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরী অবস্থা জারি করলেন। কেড়ে নিলেন বাক্‌-স্বাধীনতা। সংবাদপত্রের উপর জারি হলো সেন্সরশিপ।

গণশক্তি পত্রিকায় কী সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তা রাইটার্স বিল্ডিংস-এ গিয়ে দেখিয়ে পাশ করিয়ে নিয়ে আসতে হতো। কমরেড সুধীর চৌধুরীই সর্বপ্রথম এ কাজটা শুরু করেন। সেন্সরশিপে কার্যত কোন নিয়মনীতি ছিল না। তথ্য আধিকারিকদের পছন্দই ছিলো শেষ কথা। তাই দক্ষতার সাথে খবর পাশ করিয়ে আনাটা ছিল খুই কৃতিত্বের।

কমরেড সুধীর চৌধুরী এ কাজটা খুবই দক্ষতার সাথে করেছিলেন। খবর সংগ্রহের কাজে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরায় গিয়ে তিনি যেসব রিপোর্ট ও রিপোর্টাজ পাঠিয়েছিলেন তা ছিলো বহু প্রশংসিত। বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত খোঁজ রাখতেন সাহিত্যজগতের। আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের সময়কালে বৃহত্তর কলকাতার কয়েক হাজার পার্টিকর্মী ও সমর্থক পাড়া ছাড়া হন।

কমরেড সুধীর চৌধুরীও উৎখাত হন সোনারপুর থেকে। গণশক্তি অফিসেই তখন থাকতেন আরও কয়েকজন উৎখাত কমরেডের সঙ্গে। কাজের শেষে রাতে রান্না করা হতো। রান্না করতে ভালোবাসতেন সুধীর চৌধুরী। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত প্রায় দিনই দেখতে আসতেন কী রান্না হচ্ছে।

মাঝে মাঝে তিনি পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলতেন, ‘শোনো, কটা ডিম নিয়ে এসো। প্রতিদিন সেদ্ধ-ভাত খেয়ে কাজ করবে কী করে?’ উৎখাত অন্য কর্মীদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতেন তখন কমরেড সুধীর চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে পটপরিবর্তন হয়। কায়েম হয় বামফ্রণ্ট সরকার। দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়।

রাজ্য সরকারের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কেন্দ্রের কাছে দাবিপত্র পেশ করলেন। সারা দেশেই শুরু হয়েছিল এই বিতর্ক। এই সময় খুব সঠিকভাবেই কমরেড সুধীর চৌধুরী একটি পুস্তক সম্পাদনা করেন যার নাম ‘সম্পর্ক — কেন্দ্র রাজ্য’। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের লেখায় সমৃদ্ধ বইটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। আন্তরিকভাবে ছিলেন কবি।

সোনারপুর থেকে প্রকাশিত ‘সোমপ্রকাশ’সহ ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্ন ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কবিতা লিখতেন এইসব পত্রপত্রিকায়। নামও হয়েছিলো কবি হিসাবে। মাও জে দঙ-এর কবিতাগুচ্ছ অনুবাদ করে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন।

বহুদিন পর তাঁর কবিতার একটি সংকলন ‘নীল জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে’ প্রকাশ হয়। বিশিষ্ট সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সুধীর চৌধুরীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। সলিল চৌধুরী তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। সলিল চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর লেখা বিখ্যা ত কবিতাগুলির প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সুধীর চৌধুরীর উদ্যোগ ও সম্পাদনাতেই। ১৯৬৬ সালে সোনারপুরে সি পি আই (এম)-র সদস্যপদ লাভ করেছিলেন কমরেড সুধীর চৌধুরী।

সেবছরই দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদ্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন বেশ কিচুদিন। পরবর্তীকালে গণশক্তিতে যুক্ত হলে তিনি দীর্ঘদিন শাখা সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন পার্টির রাজ্য দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত দৈনিক ১ শাখার সদস্য। শরীরের প্রতি ছিলেন খুবই উদাসীন।

প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। টি বি, স্পণ্ডিলাইটিস্‌ এবং শেষের দিকে হাঁপানি তাঁকে খুবই কাহিল করে দেয়। তাও অসুস্থ শরীর নিয়েই অফিসে আসতেন। বারণ করলে বলতেন বাড়িতে ভাল লাগে না। যে কয়দিন পারবো আসবো।

এসেছেনও তাই। শীতে খুবই কাহিল হয়ে পড়ায় কিছুদিন ধরে আসছিলেন না। শেষে ভর্তি হতে হলো নার্সিং হোমে। সেখানেই সব শেষ। কমরেড সুধীর চৌধুরীর জীবনাবসানে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক বিমান বসু।

কমরেড সুধীর চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ আসার পরই গণশক্তি-র সমস্ত বিভাগে শোকের ছায়া নেমে আসে। নার্সিং হোমে ছুটে যান গণশক্তি-র সম্পাদক নারায়ণ দত্ত, সহকারী সম্পাদক অভীক দত্ত, মুখ্য সাংবাদিক অতনু সাহাসহ অন্যাতন্য কর্মীরা। নার্সিং হোম থেকে প্রয়াত কমরেডের মরদেহ প্রথমে গণশক্তি ভবনে নিয়ে আসা হয়। এখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় প্রয়াত কমরেড সুধীর চৌধুরীকে। সি পি আই (এম) নেতৃবৃন্দ মালা দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।

এরপর যাদবপুরের বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলী উপনগরীতে তাঁর নিজের বাড়িতে, স্থানীয় সি পি আই (এম) যাদবপুর মধ্য ৩ আঞ্চলিক কমিটির দপ্তরে এবং রাজপুর চৌহাটির ডি ব্লকে পৈতৃক বাড়িতে প্রয়াত চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার-পরিজনের শ্রদ্ধা জানানোর পর ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে গড়িয়া শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে কমরেড সুধীর চৌধুরীর মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা মহম্মদ আমিন, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, শ্যা মল চক্রবর্তী, মৃদুল দে, মদন ঘোষ, মহম্মদ সেলিম, রবীন দেব, অমিতাভ বসু, দীপক সরকার, নৃপেন চৌধুরী, অমিয় পাত্র, সি আই টি ইউ নেতা কালী ঘোষ, দেশহিতৈষী-র সম্পাদক অশোক ব্যাৌনার্জি, গণশক্তি প্রেসের কর্মাধ্যক্ষ সুকান্ত মুখার্জি, ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ, পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য সুখেন্দু পানিগ্রাহীসহ রাজ্য দপ্তরের কর্মীরা। এর আগে গণশক্তি ভবনে প্রয়াত কমরেডকে নিয়ে আসা হলে শ্রদ্ধা জানান পত্রিকার প্রতিটি বিভাগের কর্মীরা। মরদেহে মাল্যদান করেন নারায়ণ দত্ত, পার্টিনেতা ও গণশক্তি-র প্রাক্তন সম্পাদক দীপেন ঘোষ, অভীক দত্ত, বার্তা সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী, অতনু সাহা, কর্মাধ্যক্ষ অশেষ চক্রবর্তী, অধ্যাপক অঞ্জন বেরা, কালান্তর পত্রিকার পক্ষ থেকে অনুপম দাশগুপ্তসহ অন্যান্যরা।

সি পি আই (এম) যাদবপুর মধ্য ৩ আঞ্চলিক কমিটির দপ্তরেও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টিনেতা ও কর্মীরা। মালা দেন সি পি আই (এম) নেত্রী দীপা রায়, খোকন ঘোষ দস্তিদার, চন্দনা ঘোষ দস্তিদার, উজ্জ্বল চ্যা টার্জিসহ অন্যাপন্য নেতৃবৃন্দ। বিমান বসু শোক জানিয়ে বলেন, কমরেড সুধীর চৌধুরী গণশক্তির পত্রিকার প্রথম যুগের অন্যতম কর্মী। সুধীরকে আমি তখন থেকেই চিনি। আমি ওঁকে ‘সাংবাদিক’ বলে ডাকতাম।

বিভিন্ন বিষয়ে ওঁর সঙ্গে মতবিনিময় করতে ভালো লাগতো। প্রথম যুগে সঙ্কটের দিনগুলিতেও তাঁকে নিরলসভাবে কাজ করতে দেখেছি। আমি কমরেড সুধীর চৌধুরীর পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। কমরেড সুধীর চৌধুরীর জীবনাবসানে গভীর শোক জানিয়েছেন ত্রিপুরার ডেইলি দেশের কথা-র সম্পাদক গৌতম দাশ। তিনি বলেন, ওঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়।

১৯৭২সালের মে মাসের প্রথম দিকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে কমরেড সুধীর চৌধুরীর সঙ্গে সাংবাদিক হিসাবে সফর করেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে পড়ছে। এই প্রবীণ সাংবাদিকের মৃত্যুতে ডেইলি দেশের কথা-র সমস্ত কর্মী মর্মাহত। চলে গেলেন প্রবীণ কমিউনিষ্ট সাংবাদিক, কবি কমরেড সুধীর চৌধুরী। ১৯৬৭ সালে সান্ধ্য দৈনিক হিসাবে গণশক্তি-র আত্মপ্রকাশের সময় থেকেই আমৃত্যু এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রয়াত কমরেড চৌধুরী।

বেশ কিছুদিন গণশক্তি-র মুখ্য সাংবাদিকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতায় ভূগছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে বেলেঘাটায় একটি বেসরকারী নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যািগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯বছর।

প্রয়াত সুধীর চৌধুরীর স্ত্রী কৃষ্ণা চৌধুরী ও একমাত্র পুত্র অভীক চৌধুরী বর্তমান। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়াতে জন্ম হয় সুধীর চৌধুরীর। দেশভাগের পর তাঁদের পরিবার দক্ষিণ ২৪পরগণা জেলার সোনারপুরের চৌহাটি-র ডি ব্লকের বাসিন্দা হয়। এখানে হরিনাভি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন সুধীর চৌধুরী। পরে আশুতোষ কলেজে তিনি ভর্তি হন।

পশ্চিমবঙ্গে উত্তাল গণআন্দোলনের শীর্ষে ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে সময়ের চাহিদামত পার্টির রাজ্য কমিটির মুখপত্র হিসাবে যে গুটিকয়েক কর্মীকে নিয়ে গণশক্তি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছিলো, সুধীর চৌধুরী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তখন তিনি থাকতেন সোনারপুরে। সেখান থেকেই রোজ যাতায়াত করতেন। অল্প কয়েকজন কমরেড থাকায় সবাইকেই সব কাজ করতে হতো—রিপোর্টিং থেকে প্রুফ রিডিং সব কাজই করতেন কমরেড সুধীর। চার পাতার ছোট কাগজ।

সান্ধ্য দৈনিক। বিকালে পত্রিকা প্রকাশ হতো। তাই খুব সকালেই তিনি দপ্তরে এসে উপস্থিত হতেন। অতি সাধারণ ঘরের ছেলে। ছিল না কোন অহঙ্কার।

ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। এলাকায় রাজনীতি করার কারণে ছিলেন জনপ্রিয়। জনপ্রিয় ছিলেন কর্মক্ষেত্রেও। সংবাদ সংগ্রহ এবং তার উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই আন্তরিক।

১৯৬৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। তৈরি হয় যুক্তফ্রণ্ট সরকার। মাত্র ৯মাসের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের যুক্তফ্রণ্ট সরকারকে ভেঙে দেয়। তৈরি হয় প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে পি ডি এফ সরকার। পুলিস নির্বিচারে গ্রেপ্তার করতে শুরু করলো পার্টির নেতা ও কর্মীদের।

সি পি আই (এম)-র রাজ্য দপ্তরেও এক রাতে পুলিস হানা দেয়। গণশক্তি প্রকাশ হতো ওই বাড়ি থেকেই। পুলিস গণশক্তি দপ্তরেও আসে। সে রাতে দপ্তরে ছিলেন বর্তমান সম্পাদক নারায়ণ দত্ত, সুধীর চৌধুরী ও ম্যানেজার প্রণব প্রিয় পাল। নৈশ প্রহরীর তৎপরতায় তাঁরা পুলিসের হাত থেকে রেহাই পান।

১৯৭২ সালে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে সিদ্ধার্থ রায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে কংগ্রেসী শাসন শুরু হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই সরকারের শাসনকালে সি পি আই (এম)-র এক হাজারের বেশি কর্মী খুন হন। কমরেড সুধীর চৌধুরী জীবনের ঝুকি নিয়েই এ সমস্ত খবর সংগ্রহ করতে যেতেন। বহু ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। কিন্তু খবর সংগ্রহে পিছুপা হননি।

১৯৭৫ সালের জুন মাসে গণতন্ত্রকে খুন করে ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরী অবস্থা জারি করলেন। কেড়ে নিলেন বাক্‌-স্বাধীনতা। সংবাদপত্রের উপর জারি হলো সেন্সরশিপ। গণশক্তি পত্রিকায় কী সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তা রাইটার্স বিল্ডিংস-এ গিয়ে দেখিয়ে পাশ করিয়ে নিয়ে আসতে হতো। কমরেড সুধীর চৌধুরীই সর্বপ্রথম এ কাজটা শুরু করেন।

সেন্সরশিপে কার্যত কোন নিয়মনীতি ছিল না। তথ্য আধিকারিকদের পছন্দই ছিলো শেষ কথা। তাই দক্ষতার সাথে খবর পাশ করিয়ে আনাটা ছিল খুই কৃতিত্বের। কমরেড সুধীর চৌধুরী এ কাজটা খুবই দক্ষতার সাথে করেছিলেন। খবর সংগ্রহের কাজে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরায় গিয়ে তিনি যেসব রিপোর্ট ও রিপোর্টাজ পাঠিয়েছিলেন তা ছিলো বহু প্রশংসিত।

বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত খোঁজ রাখতেন সাহিত্যজগতের। আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের সময়কালে বৃহত্তর কলকাতার কয়েক হাজার পার্টিকর্মী ও সমর্থক পাড়া ছাড়া হন। কমরেড সুধীর চৌধুরীও উৎখাত হন সোনারপুর থেকে। গণশক্তি অফিসেই তখন থাকতেন আরও কয়েকজন উৎখাত কমরেডের সঙ্গে।

কাজের শেষে রাতে রান্না করা হতো। রান্না করতে ভালোবাসতেন সুধীর চৌধুরী। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত প্রায় দিনই দেখতে আসতেন কী রান্না হচ্ছে। মাঝে মাঝে তিনি পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলতেন, ‘শোনো, কটা ডিম নিয়ে এসো। প্রতিদিন সেদ্ধ-ভাত খেয়ে কাজ করবে কী করে?’ উৎখাত অন্য কর্মীদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতেন তখন কমরেড সুধীর চৌধুরী।

১৯৭৭ সালে রাজ্যে পটপরিবর্তন হয়। কায়েম হয় বামফ্রণ্ট সরকার। দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কেন্দ্রের কাছে দাবিপত্র পেশ করলেন। সারা দেশেই শুরু হয়েছিল এই বিতর্ক।

এই সময় খুব সঠিকভাবেই কমরেড সুধীর চৌধুরী একটি পুস্তক সম্পাদনা করেন যার নাম ‘সম্পর্ক — কেন্দ্র রাজ্য’। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের লেখায় সমৃদ্ধ বইটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। আন্তরিকভাবে ছিলেন কবি। সোনারপুর থেকে প্রকাশিত ‘সোমপ্রকাশ’সহ ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্ন ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কবিতা লিখতেন এইসব পত্রপত্রিকায়।

নামও হয়েছিলো কবি হিসাবে। মাও জে দঙ-এর কবিতাগুচ্ছ অনুবাদ করে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। বহুদিন পর তাঁর কবিতার একটি সংকলন ‘নীল জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে’ প্রকাশ হয়। বিশিষ্ট সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সুধীর চৌধুরীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।

সলিল চৌধুরী তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। সলিল চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর লেখা বিখ্যা ত কবিতাগুলির প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সুধীর চৌধুরীর উদ্যোগ ও সম্পাদনাতেই। ১৯৬৬ সালে সোনারপুরে সি পি আই (এম)-র সদস্যপদ লাভ করেছিলেন কমরেড সুধীর চৌধুরী। সেবছরই দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদ্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন বেশ কিচুদিন।

পরবর্তীকালে গণশক্তিতে যুক্ত হলে তিনি দীর্ঘদিন শাখা সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন পার্টির রাজ্য দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত দৈনিক ১ শাখার সদস্য। শরীরের প্রতি ছিলেন খুবই উদাসীন। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। টি বি, স্পণ্ডিলাইটিস্‌ এবং শেষের দিকে হাঁপানি তাঁকে খুবই কাহিল করে দেয়।

তাও অসুস্থ শরীর নিয়েই অফিসে আসতেন। বারণ করলে বলতেন বাড়িতে ভাল লাগে না। যে কয়দিন পারবো আসবো। এসেছেনও তাই। শীতে খুবই কাহিল হয়ে পড়ায় কিছুদিন ধরে আসছিলেন না।

শেষে ভর্তি হতে হলো নার্সিং হোমে। সেখানেই সব শেষ। কমরেড সুধীর চৌধুরীর জীবনাবসানে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক বিমান বসু। কমরেড সুধীর চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ আসার পরই গণশক্তি-র সমস্ত বিভাগে শোকের ছায়া নেমে আসে। নার্সিং হোমে ছুটে যান গণশক্তি-র সম্পাদক নারায়ণ দত্ত, সহকারী সম্পাদক অভীক দত্ত, মুখ্য সাংবাদিক অতনু সাহাসহ অন্যাতন্য কর্মীরা।

নার্সিং হোম থেকে প্রয়াত কমরেডের মরদেহ প্রথমে গণশক্তি ভবনে নিয়ে আসা হয়। এখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় প্রয়াত কমরেড সুধীর চৌধুরীকে। সি পি আই (এম) নেতৃবৃন্দ মালা দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এরপর যাদবপুরের বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলী উপনগরীতে তাঁর নিজের বাড়িতে, স্থানীয় সি পি আই (এম) যাদবপুর মধ্য ৩ আঞ্চলিক কমিটির দপ্তরে এবং রাজপুর চৌহাটির ডি ব্লকে পৈতৃক বাড়িতে প্রয়াত চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার-পরিজনের শ্রদ্ধা জানানোর পর ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে গড়িয়া শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে কমরেড সুধীর চৌধুরীর মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা মহম্মদ আমিন, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, শ্যা মল চক্রবর্তী, মৃদুল দে, মদন ঘোষ, মহম্মদ সেলিম, রবীন দেব, অমিতাভ বসু, দীপক সরকার, নৃপেন চৌধুরী, অমিয় পাত্র, সি আই টি ইউ নেতা কালী ঘোষ, দেশহিতৈষী-র সম্পাদক অশোক ব্যাৌনার্জি, গণশক্তি প্রেসের কর্মাধ্যক্ষ সুকান্ত মুখার্জি, ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ, পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য সুখেন্দু পানিগ্রাহীসহ রাজ্য দপ্তরের কর্মীরা। এর আগে গণশক্তি ভবনে প্রয়াত কমরেডকে নিয়ে আসা হলে শ্রদ্ধা জানান পত্রিকার প্রতিটি বিভাগের কর্মীরা। মরদেহে মাল্যদান করেন নারায়ণ দত্ত, পার্টিনেতা ও গণশক্তি-র প্রাক্তন সম্পাদক দীপেন ঘোষ, অভীক দত্ত, বার্তা সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী, অতনু সাহা, কর্মাধ্যক্ষ অশেষ চক্রবর্তী, অধ্যাপক অঞ্জন বেরা, কালান্তর পত্রিকার পক্ষ থেকে অনুপম দাশগুপ্তসহ অন্যান্যরা। সি পি আই (এম) যাদবপুর মধ্য ৩ আঞ্চলিক কমিটির দপ্তরেও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টিনেতা ও কর্মীরা। মালা দেন সি পি আই (এম) নেত্রী দীপা রায়, খোকন ঘোষ দস্তিদার, চন্দনা ঘোষ দস্তিদার, উজ্জ্বল চ্যা টার্জিসহ অন্যাপন্য নেতৃবৃন্দ।

বিমান বসু শোক জানিয়ে বলেন, কমরেড সুধীর চৌধুরী গণশক্তির পত্রিকার প্রথম যুগের অন্যতম কর্মী। সুধীরকে আমি তখন থেকেই চিনি। আমি ওঁকে ‘সাংবাদিক’ বলে ডাকতাম। বিভিন্ন বিষয়ে ওঁর সঙ্গে মতবিনিময় করতে ভালো লাগতো। প্রথম যুগে সঙ্কটের দিনগুলিতেও তাঁকে নিরলসভাবে কাজ করতে দেখেছি।

আমি কমরেড সুধীর চৌধুরীর পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। কমরেড সুধীর চৌধুরীর জীবনাবসানে গভীর শোক জানিয়েছেন ত্রিপুরার ডেইলি দেশের কথা-র সম্পাদক গৌতম দাশ। তিনি বলেন, ওঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। ১৯৭২সালের মে মাসের প্রথম দিকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে কমরেড সুধীর চৌধুরীর সঙ্গে সাংবাদিক হিসাবে সফর করেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে পড়ছে।

এই প্রবীণ সাংবাদিকের মৃত্যুতে ডেইলি দেশের কথা-র সমস্ত কর্মী মর্মাহত।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.