আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনপ্রশাসনে কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!

প্রতিদিন যা পড়ি পত্রিকার পাতায়, ভাললাগা-মণ্দলাগা সবই শেয়ার করি সবার সাথে।

চাকরি আছে, বেতন-ভাতা আছে, কাজ নেই। জনপ্রশাসনে এঁদের বলা হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংক্ষেপে ওএসডি। বর্তমানে এঁদের সংখ্যা ৩৭৭। বেতন-ভাতা বাবদ বছরে তাঁদের পেছনে রাষ্ট্রের ব্যয় প্রায় ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ আট হাজার টাকা।

মাসে তিন কোটি সাত লাখ ৩৪ হাজার টাকা। দক্ষ হওয়ার পরও সচিব-পর্যায় থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদমর্যাদার এসব কর্মকর্তাকে মাসের পর মাস বসিয়ে রেখে বেতন দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা ছুটি বা প্রশিক্ষণের জন্যও অনেকে ওএসডি রয়েছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের হিসাব ও প্রশাসন শাখাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, ওএসডির সংখ্যা প্রায়ই পরিবর্তন হয়ে থাকে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ সময়ে (২৮ অক্টোবর, ২০০৬) ওএসডির সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৫৫। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সংখ্যা হয় মাত্র ৫৮ জন, যা ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, বিগত কয়েকটি সরকারের দলীয়করণের কারণে দক্ষ কর্মকর্তাকে ওএসডি হতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে প্রশাসনে নিয়ে আসায় দক্ষ কর্মকর্তারা তাঁদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারছেন না।

এর ফলে জনপ্রশাসন থেকে যে সেবা জনগণ পেতে পারত, তা পাচ্ছে না। বরং কর্মশক্তি ও টাকার অপচয় হচ্ছে। মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ওএসডি কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা দেওয়ার জন্য কোনো খাত তৈরি করা হয়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাঁদের বেতন-ভাতা দিয়ে টাকার অপচয় করা হচ্ছে। জাতীয় বেতন স্কেল, ২০০৯ অনুযায়ী ওএসডি সচিবেরা বেতনের পাশাপাশি সব সুবিধা পেয়ে থাকেন।

যুগ্মসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা প্রতি মাসে ১৮০ লিটার জ্বালানি তেল পান। এর মূল্য ১৩ হাজার ৮৬০ টাকা। চালকের বেতনও দেয় সরকার। অনেক কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের দু-তিনটি গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। এসব গাড়িরও সব খরচ বহন করে সরকার।

শুধু গাড়ি বাবদ একজন কর্মকর্তার পেছনে রাষ্ট্রের মাসিক খরচ ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ওএসডি কর্মকর্তারা যেসব বাড়িতে থাকেন, সেগুলোর ভাড়া ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সরকারি বাড়িতে না থাকলে বাড়িভাড়া হিসেবে আলাদা টাকা পান। আরও আছে চিকিৎসা ভাতা, গৃহভৃত্য ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, পত্রিকা, সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা, টেলিফোন ও মুঠোফোন বিল এবং নিরাপত্তারক্ষী। তবে উপসচিব ও জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবেরা পরিবহন পুলের গাড়ি ব্যবহার করেন।

জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, এত সংখ্যক কর্মকর্তা ওএসডি থাকার ফলে দেশের মানুষ তাঁদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। ওএসডি প্রথাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে রাজনৈতিক মানদণ্ডে। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অধিকার বজায় রাখা সরকারের দায়িত্ব।

ওএসডি প্রথা থাকলে দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন আশা করা যাবে না বলে মনে করেন তিনি। জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী ওএসডি কর্মকর্তারা কর্মরত সচিবের সমান ৪০ হাজার টাকা বেতন পান। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে একজন সচিবের পেছনে সরকারের প্রতি মাসে ব্যয় হয় প্রায় এক লাখ ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে ওএসডি রয়েছেন ১৩ জন সচিব। এই ১৩ সচিবের পেছনে সরকারের মাসিক ব্যয় ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা, যা বছরে প্রায় এক কোটি ৭১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

যদিও সম্প্রতি ওএসডি করায় পদত্যাগ করেছেন বেসরকারীকরণ কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ মোহসীন। অতিরিক্ত সচিবের বেতন স্কেল সাড়ে ৩৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩৯ হাজার টাকা। অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে প্রতি মাসে অতিরিক্ত সচিবের পেছনে ব্যয় হয় এক লাখ তিন হাজার টাকা (বছরে ১২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা)। বর্তমানে ওএসডি ৩৪ অতিরিক্ত সচিবের পেছনে মাসে ব্যয় হয় ৩৫ লাখ দুই হাজার টাকা (বছরে চার কোটি ২০ লাখ ২৪ হাজার)। একজন যুগ্ম সচিবের বেতন স্কেল ২৯ হাজার থেকে ৩৫ হাজার ৬০০ টাকা।

অন্যান্য সুবিধাসহ যুগ্ম সচিব মোট বেতন-ভাতা পান ৯৮ হাজার টাকা, যা বছরে হয় ১১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। বর্তমানে ওএসডি আছেন ২২৩ জন যুগ্ম সচিব। তাঁদের পেছনে মাসে ব্যয় হয় দুই কোটি ১৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা (বছরে ২৬ কোটি ২২ লাখ ৪৮ হাজার)। তবে গত রোববার প্রায় ১৬৬ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ায় এ সংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হলে এ সংখ্যা দ্রুত কমে আসবে।

একজন উপসচিবের বর্তমান বেতন ২২ হাজার ২৫০ থেকে ৩১ হাজার ২৫০ টাকা। সব সুবিধাসহ উপসচিবের পেছনে সরকারের মাসিক ব্যয় হয় ৪২ হাজার টাকা। বর্তমানে ওএসডি আছেন ৬১ জন উপসচিব। তাঁদের পেছনে মাসে ব্যয় ২৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা (বছরে তিন কোটি সাত লাখ ৪৪ হাজার)। একইভাবে ওএসডি থাকা ৩৩ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবের পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হয় এক কোটি ৬৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পদের তুলনায় পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি করায় বসিয়ে বেতন নেওয়ার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যাও। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওএসডি করার সরকারি নীতিমালা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। জানতে চাইলে সংস্থাপন সচিব ইকবাল মাহমুদ বলেন, কোনো কারণ ছাড়া কাউকে ওএসডি করা হয় না। পদ শূন্য হলে পদোন্নতি হবেই।

এ বিষয়গুলোকে অন্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সচিব দাবি করেন, ওএসডি বিভিন্ন কারণে করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগই হয় পদোন্নতিজনিত কারণে। তবে রাজনৈতিক কারণে সচিবদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি সচিব। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে পদচ্যুতি বা শাস্তির কারণে কাউকে ওএসডি করা হয়নি।

নিয়ম কী: চারদলীয় জোট ও মহাজোট—দুই সরকারের আমলেই ওএসডি প্রথাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ প্রথা চালু থাকলেও আগে এত বেশি সংখ্যক ওএসডি করা হতো না। প্রশিক্ষণের জন্য কেউ বিদেশে গেলে তাঁকে ওএসডি করা হতো। ফিরলে আবার স্বপদে পদায়ন করা হতো। ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচটি কারণে সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়।

প্রথমত, দুর্নীতি, শৃঙ্খলাজনিত, অসদাচরণ ও অযোগ্যতার জন্য প্রত্যাহার করা কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়। তবে সর্বোচ্চ ১৫০ দিন ওএসডি রাখা যাবে। দ্বিতীয়ত, দুই মাসের অধিক ছুটি ভোগকারী বা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ওএসডি করা যায়; পুরোনো পদ বা বৈদেশিক চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বৈদেশিক প্রশিক্ষণ থেকে প্রত্যাগত এবং নতুন পদে যোগদানের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন এমন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়; বৈদেশিক চাকরি বা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে অপেক্ষমাণ রয়েছেন এমন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়, এ ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব তিন মাস পর্যন্ত ওএসডি রাখা যাবে; এবং প্রশাসনিক বা অনিবার্য কারণে কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়। ১৬ বছরে সবচেয়ে কম: ১৬ বছরের মধ্যে ওএসডির সংখ্যা সবচেয়ে কম ছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সে সময় মোট ৫৮ জন যুগ্ম সচিব ও উপসচিবকে ওএসডি করা হয়েছিল।

তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে ওএসডি কর্মকর্তাদের দ্রুত নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, এটি একটি খারাপ নজির যে কাজ না করেও সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রের বেতন-ভাতা দেওয়া হবে। বিদেশে যেতে মানা: ওএসডি কর্মকর্তাদের বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ বিষয়ে সংস্থাপন সচিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওএসডি কর্মকর্তার কাজ না থাকায় তাঁকে কোনো সেমিনারে বা প্রশিক্ষণে পাঠানোর সুযোগ নেই। ফলে ওএসডি কর্মকর্তার বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

’ রোজিনা ইসলাম | প্রথম আলো

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।