আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নদীমাতৃক দেশের পরিচয় হারাচ্ছে বাংলাদেশ

গণমাধ্যমকর্মী, চেয়ারম্যান - উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান, সদস্য সচিব - সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন।

নদীমাতৃক দেশের পরিচয় হারাচ্ছে বাংলাদেশ পলি জমে দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ১৭ টি নদী : বিলীন হবার পথে আরো ৮ নদী যৌবনের জলতরঙ্গে এক সময় উচ্ছ্বল ছিল বাংলাদেশের নদ-নদী। সেই কারণে নদীর সাথে এদেশের মানুষের গভীর মিতালী-এ আপ্তবাক্য ছিল চিরন্তন সত্য। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সময়ের স্রোতে পাল তোলে এ চিরন্তন সত্য কথাটিও যেন একেবারেই বেমানান হয়ে উঠেছে।

নদীমাতৃক দেশের পরিচয় বা অহংকারও যেন এখন বিলীন! জলবায়ু পরিবর্তন আর পলি জমে নদীমাতৃক এ দেশের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে ১৭টি নদী। এছাড়া আরো ৮টি নদী অল্প সময়ের ব্যবধানে বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত বালুর চাপ ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত বিকল্প বাঁধ নদীগুলোর পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করছে। কৃষি সেচের বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রাও বদলে যাচ্ছে।

সৃষ্টি হচ্ছে নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয়। এছাড়া দেশের প্রধান চার নদী পদ্মা, ব্রক্ষপুত্র, মেঘনা ও যমুনা পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। পলি জমে ক্রমশ ভরাট হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির বদলে এসব নদীর বুকে চর পড়ে শুধুই বালু আর বালু। কোথাও কোথাও ছোট-বড় নদীগুলোর বুকে চলে চাষাবাদ।

নদীর তলদেশ শুকিয়ে হয়ে উঠে মরুভূমি। সেই সময়ে নদীর বুকচিড়ে বালিসন্ত্রাসীরা মেতে উঠে বালি বাণিজ্যে। প্রতিদিনই নদীর বুক ক্ষতবিক্ষত করে দাবড়ে বেড়ায় শত শত ট্রাক। এসব নদীগুলোর কাছে গিয়ে দাড়ালে শুধুই শোনা যায় দীর্ঘশ্বাস আর কান্না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাম্প্রতিক এক গবেষণা রিপোর্ট মারফত জানা গেছে দেশে ১৭টি নদী একেবারে শুকিয়ে গেছে।

এর বেশিরভাগই উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের নদ-নদী। এসব নদীর অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এগুলো খরস্রোতা নদী ছিল। বর্তমানে এই নদীগুলো মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় মৃত নদী হিসেবে ঠাঁই হয়েছে- কিশোরগঞ্জ নরসুন্দা-রাজবাড়ী, ফরিদপুর কুমার নদী, ভুবনেশ্বর-হবিগঞ্জ, বিবিয়ানা ও শাখা বরাক-শরীয়তপুর, পাংলা-কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বুড়ি নদী-যশোর, হরিহর ও মুক্তেশ্বরী-খুলনা, হামবুড়া-নোয়াখালী, বামনি-বগুড়া, মানস-নাটোর ও পাবনা, বড়াল ও চিকনী-কুষ্টিয়া, হিসনা-রাজশাহী নাটোর, মুসাখান কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, বাগেরহাটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় আরো ৭টি নদী মরে যেতে বসেছে। ওই তালিকায় উঠে আসা নদীগুলো হচ্ছেÑ করতোয়া, ইছামতি, কালীগঙ্গা, কুমার, চিত্রা, ভদ্রা ও নবগঙ্গা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে নদী, উপনদী ও শাখা নদী সব মিলিয়ে ২৩০টি নদীর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে নদী নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্স ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) হিসাব মতে, দেশে নদী রয়েছে ১ হাজার ২’শ টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদী ৫৪টি।

তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ মতে, এ সংখ্যা ৭’শ ১০। সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ পানি বিজ্ঞান ও নদী জরিপ গবেষণা কেন্দ্র জরিপ করে ৩’শ ১০টি নদ-নদীর উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে নদ-নদীর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উৎপত্তি, পতিত স্থল, অববাহিকা, গভীরতা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় দেশের বৃহত্তম নদী মেঘনা। নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩৩০ কিলোমিটার, ভৈরবের কাছে প্রস্থ দেড় কিলোমিটার ও গভীরতা ২৫ মিটার।

আর দেশের ক্ষুদ্রতম নদী হচ্ছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার গোবরা নদী। যার দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৫ মিটার। একটি বেসরকারি সংস্থার সূত্র মতে, মজে যাওয়া নদীর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে নাটোরের গদাই ও নারদ, বগুড়ার গাংলাই ও নাগর, কুড়িগ্রামের জিনজিরাম, ঠাকুরগাঁওয়ের ছোটচেপা, আমন দামন, লোনা ও লাচ্ছি, দিনাজপুরের নলশিসা, কালা, গড়েশ্বরি, ইছামতি, মাইলা, পাথরঘাটা, নর্ত, বেলান, তুলসিগঙ্গা, ছোট যমুনা, চিরি ও তেঁতুলিয়া, রংপুরের নলেয়া, আলাই কুমারি ও মরাতিস্তা, নওগাঁর শিব ও ফকিরনি। নীলফামারীর খড়খড়িয়া, খারুবাজ, ঘিরনাই, চাড়া, বুল্লাই ও আউরিয়া খানা, পাবনার বাদাই, রওনাই, গোমানি, বড়াল লোয়ার, চিকনাই, সুতিখালি কাগেশ্বরী ও হুরসাগর। সাম্প্রতিক সময়ে এক নদী গবেষণা জরিপে এসব নদ-নদীকে বলা হয়েছে মৌসুমি নদী।

এসব মৌসুমী নদীও মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে যাবার পথে। একাধিক সূত্র জানায়, গত শুষ্ক মৌসুমে দেশের বৃহত্তম চার নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, যমুনা’র বিভিন্ন স্থানে পলি জমে ভরাট হয়ে যায়। বর্ষায় আবার এ নদীগুলো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এ বছরেও এসব নদীর অনেক স্থানে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। বিশেষজ্ঞদের ধারণাÑ এ চার নদীর মাধ্যমে হিমালয় থেকে বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানি এলেও এগুলোর স্রোতধারা অনেকটা বদলে গেছে।

তন্মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের অবস্থা খুবই নাজুক। ব্রক্ষপুত্রের উৎসমুখ ভরাট হয়ে গেছে। নদীবক্ষে প্রায় সাড়ে ৭’শ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবো চর। তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯ ফুটে গিয়ে ঠেকেছে। সংকটাপন্ন ব্রক্ষপুত্র নদের নাব্যতা ও চঞ্চলতা ফিরিয়ে আনতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ‘ব্রক্ষপুত্র বহুমূখী নদীশাসন প্রকল্প’ গ্রহণ করলেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অভাবে প্রকল্পটি টানা ১২ বছর ধরে ফাইলবন্দি হয়ে আছে।

লাল ফিতার গিট্রুতে থমকে থাকা প্রকল্পটিতে বাহাদুরাবাদ-ভৈরব পর্যন্ত পুরাতন ব্রক্ষপুত্রের ভরাট হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো ড্রেজিং করা ও ড্রেজিং’র উত্তোলিত মাটি দিয়ে নদের দুই পাড়ে বাঁধ ও রাস্তা নির্মার্ণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মাইলের পর মাইল মরুময় ব্রক্ষপুত্র নদের চরে চরে সবুজ বিপ্লব। চরের জেগে ওঠা কায়েম জমিতে ভুট্রা, কালাই, মরিচ, বেগুনসহ নানা ধরনের সব্জির চাষ করা হয়েছে। বিশাল বিস্তৃত বালু চরের মাঝে কায়েম মাটিতে এখন সবুজ ফসলে ভরা। নদীর পলিতে চাষ করা সব্জির ফলনও হয়েছে বেশ।

একই রকমের চিত্র যমুনা নদীর বেলাতেও। বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, পাবনা, সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদীর চরাঞ্চলের নদীভাঙ্গা ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক জেগে ওঠা চরের জমিতে সবজি চাষের সাথে সাথী ফসল হিসাবে মসলা জাতীয় ফসল চাষ করছে। চরের জমিতে এখন চাষ হচ্ছে বাঁধা কপি, ফুল কপি, মিষ্টি কুমড়া সহ নানা জাতের সবজি। এসব সবজির জমিতে সাথী ফসল হিসাবে মসলার চাষ করা হচ্ছে। দরিদ্র চাষী মসলা জাতীয় ফসল চাষ করে বাড়তি আয় ঘরে তোলছে।

অন্য দু’ প্রধান নদী মেঘনা ও পদ্মার বুকেও চাষাবাদের চিত্র এ দু’ নদীর মতই। জানা গেছে, দেশের প্রধান চার নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও যমুনা বছর বছর চ্যানেল পরিবর্তন করে থাকে। নদীর এ চ্যানেল পরিবর্তনে একদিকে যেমনি নদীভাঙন সৃষ্টি করে তেমনি পলি জমে ভরাট হয়। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীগুলোর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। খুলনা ও যশোরের ভৈরব নদীতে এখন আর আগের মতো স্রোত নেই।

এখন এ দু’নদী কেবলই ইতিহাসের স্বাক্ষী। যেখানে আগে স্রোত প্রবাহের বেগ ছিল সেখানে পলি জমে চর পড়ায় কৃষকরা চাষাবাদ করছে। ভৈরবের এরূপ প্রতিক্রিয়ায় সেখানকার জনগণের জনজীবনে পরিবর্তন এসেছে। যে নদটি ঘিরে ওই এলাকার সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই ভৈরব নদ বর্তমানে সেইখানকার দুঃখ বয়ে এনেছে। কালের বিবর্তনে নদটি তিনটি অংশে ভাগ হয়েছে।

উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম নদী হিসেবে পরিচিত তিস্তা। করতোয়া, আত্রাই, যমুনেশ্বরীসহ বিভিন্ন নদীর জলরাশি প্রবাহিত হতো এক সময় এ তিস্তা নদী দিয়ে। কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরে কুমার নামে দুইটি পৃথক নদী ছিল। বর্তমানে নদী দুটির অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। কালীগঙ্গা ও কুমার নদীর মতো ভয়াল নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে।

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, শুকনো মৌসুমে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ১৭টি নদীর পানি শুকিয়ে যায়। বছরে তিন থেকে চার মাস ওইসব নদীতে পানি প্রবাহ কম থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের নদীগুলোতে বছরে ৩ হাজার টন পলি জমে। এ পলি পড়ার কারণে নদীগুলো তার স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। বিআইডব্লিউটি সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭১ সালে দেশে মোট নদীর দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার।

নদী শুকনো মৌসুমে ৩ হাজার ৮’শ কিলোমিটার এবং বর্ষা মৌসুমে ৬ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে ১৮ হাজার নৌপথের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫’শ কিলোমিটার নৌপথে নৌযান চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত। এর ফলে এসব এলাকায় মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে সংকট দেখা দিচ্ছে। যদিও দেশের দক্ষিণাঞ্চল পুরোপুরি নৌপথের ওপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে গত তিন দশকে দেশের ৮০টি নদীর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

১৯৭৪ সালে ভারত সরকার ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের ফলে গঙ্গা নদী থেকে পানি প্রবাহ কমে গেছে। ফলে এ দেশের নদীগুলো পর্যাপ্ত পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে আশার খবর হচ্ছে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ধু-ধু মরুভূমি হয়ে যাওয়া নদীগুলো দ্রুততার সাথে ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ময়মনসিংহ সফরকালে জেলা নাগরিক আন্দোলনের এক সভায় নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এ ইঙ্গিতই করেছেন। এ কাজ সম্পন্ন হলে নদীগুলো তার হারিয়ে যাওয়া গতিপথ ফিরে পেতে পারে বলে নদী বিশেজ্ঞরা মনে করছেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।