আকাশ ছুঁব...
পুরুষশাসিত নারীমন-৩
অদ্বিতীয়া সিমু
প্রতিবারের মতই ঈদে বাড়ী এল ইপ্সিরা। মহাধুমধামে গাড়ি থেকে নামল পরিবার। নিম্মী ছুটলো ড্রয়ইং-রুমের দিকে। কম্পিউটারটা চালু করতে হবে। ফেসবুকে একটা স্টেটাসতো দিতেই হবে।
বাড়ী এসেছি।
-আরে ছুটছিস কোথায়?
-কম্পুটার চা....
হো হো করে হেসে উঠলো ইপ্সি।
-যা বাবা, একখান স্টেটাস মেরে আয় তবে...
কে শোনে কার কথা, নিম্মী দৌড়ে পালাল। ও ফেসবুকে বসে কম। মেডিকেলের পড়া পড়েই কুল পায় না, ফেসবুক! ইপ্সি ঘরের ভেতরের দিকে মন দিল।
সব নোংরা হয়ে আছে। ওরা কেউ এখানে থাকে না, ছুটি কিংবা ঈদ...। ধুলা ঝাড়তে হবে আগে। সুমিকে ডাক দিল ইপ্সি।
-সুমি, সুমি..
-জ্বী খালাম্মা...
-একটা মোছনা নিয়ে এদিকে আয়।
-আসতেছি।
গরু কেনা হয়ে গেছে। বাবা গরু কুরবানী দিবে গ্রামে, আর খাসী দিবে ৩য় দিন এ বাড়ী। সব গুছিয়ে ফেলতে হবে। সকালেই বাবা হাঁকডাক শুরু করে দিবে এটা হলোনা, ওটা হলো না।
ওরা থাকে ঢাকায়। এসেই কি সব গুছানো যায়! রোজার ঈদ ঢাকাতেই হয়েছে। কুরবানীর ঈদ নাকি হবে না। বাবাকে গ্রামে কুরবানী দিতে হবে, সেখানে সমাজ আছে। তাহলে সোজা গ্রামে গেলেই পারতো! না, আগে মফস্বলের বাড়ি আসতে হবে।
বাবার বিছানার চাদরটা আগে ঝেড়ে দিল ইপ্সি। বাবা শোবে। বাবার জার্নি সয়না।
-বাবা হয়ে গেছে...
-আসছি মা।
শফিক রেহমান মোবাইলে কথা বলতে বলতে খাটে শুয়ে পড়লেন।
হুম, আবেদকে বলিস সব ঠিক রাখতে..., কি সব আগাড়া-বাগাড়া। ইপ্সি ছুটলো ভাত চড়াতে। দুপুরে খাওয়াতো লাগবে।
-মা, ক’পট চাল বসাবো...
-বসা, আমি কি জানি?
একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে, মার সংগে ঝগড়া করলে কোন লাভ হবে না।
-দিদিপু,দুপুরে হচ্ছে কি?
-দেখি..গোশতো রেধেই এনেছি.. কি খাবি?
রী গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলো।
রী, মৌরী রেহমান, ইপ্সিদের সবছেয়ে ছোটবোন। আজ গাড়িতে সারাটা পথ গল্পের বই পড়তে পড়তে পৌঁছা হয়েছে বাড়ি। এখনো বইটা হাতে, শেষ না করে উনি উঠবেন না। নাসরিন জাহানের “উরুক্কু”। বইটা ইপ্সিও পড়েছে।
কিন্তু আজ গাড়িতে একটু বিরক্ত হয়েছিল ।
-দিদিপু, কাল মেঘনায় যাচ্ছি..
সবজি নাড়তে নাড়তে রীর কথা শুনে হাসলো ইপ্সি, ইপ্সিতা রেহমান।
-বাবার অনুমতি মিলেছে?
-হুম।
ইপ্সি অবাক হলো। বাবা অনুমতি দিয়েছে!
আজ এত বড় হয়েছে, তিরিশের আশেপাশে এসেও অনুমতি মেলেনি মেঘনা ঘোরার।
বাড়ির পাশে মেঘনা রেখেও নৌকায় ঘোরার সাধ মেটেনি, বলছে কি ছুকরি! বাবা অনুমতি দিয়েছে। এখানে আমার মেয়ে বাড়ির বাইরে যাবে না। মার্কেট যাবার অনুমতিও মেলে না এখানে। বের হলে বলবে, অমুক বাড়ির মেয়ে বাইরে বের হয়েছে। মুখরোচক গল্প বের হয়।
সবার মেয়েরা বের হোক, আমার মেয়েরা হবে না। যা চাও ঘরে এনে দেব। কি চাই! হ্যাঁ, তবে যা চেয়েছে ঘরের মধ্যে পেয়েছে ইপ্সিরা। বাবা, চটপটি খাব। ঘরের বানানো নয়, বাইরের রাস্তারধারের।
দেখা গেল কতণ পরই চটপটিওয়ালা ওদের বাড়ি হাজির। কি ব্যাপার? স্যার, পাঠাইছে। আপামনিরা নাকি চটপটি খাইবো। বাবা, আলুপুরি খাব। ঘরের মধ্যেই এসে গেছে গরমপুরি।
পুরিরদোকানের পিচ্চি এসে দিয়ে যাবে পুরি। বাবার ভুল ধরার কোন ফাঁকই বাবা রাখেন না। কিন্তু এ এলাকা ঘুরে দেখার সাধ কারই মেটেনি। এ কিনা ওদের নিজেদের এলাকা। বাড়িই ওদের এলাকা।
একখান বাড়ি থাকলেই কি নিজ এলাকা হয়! যখন পথ-ঘাটই চেনা নেই!
ইপ্সি বাবার ঘরের দিকে গেল। বাবা এখনো মোবাইলে কথা বলছে। ইপ্সি দাঁড়াল দরজা ধরে। শফিক সাহেব বুঝলেন মেয়ে কিছু বলতে চায়। মোবাইল রেখে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি।
-কিছু বলবি, মা?
-কাল নাকি আমরা সবাই মেঘনা যাচ্ছি। আরিফ নাকি এসে নিয়ে যাবে আমাদের?
বাবা হাসলেন।
-তুমি হাসছ যে বড়...
-রাখ তোর মেঘনা, কাল খুব ভোরে আমি আর অপু গ্রামে চলে যাচ্ছি। নামাজ পড়ে কুরবানী দিয়েই ফিরে আসছি।
-গোশত কে আনবে?
-আমি সাথে কিছু আনবো,বাকীটা তোর আবিদচাচা আনবে।
আবিদচাচা, ইপ্সিদের রক্তসম্পর্কীও কোন চাচা নন। বহু বছর ধরে আবিদচাচারা ইপ্সিদের তে করছে, সে হিসেবে ইপ্সিদের সাথে বাঁধনে জড়িয়ে গেছে তারা। ওদের বাসার সুমি, আবিদচাচারই নাতনী। সুমিকে নিয়ে ইপ্সি ঘরের কাজে মন দিল। অনেক কাজ আজকের মধ্যে সারতে হবে।
কোপাদাটা বের করতে হবে, বটি ধার করতে দিতে হবে। আরও কতকিছু। ইপ্সি যদিও কুরবানী ভয় পায় , গোশত তাকেই বিতরন করে নিপাট করতে হবে। কুরবানীতো ত্যাগের মহিমা প্রচার করে, মানুষ কি তার মনের কালিমা কুরবানী দিতে পারে না! সমাজ কি পারে না সমাজের কালিমা কুরবানী দিতে, পারে না! পুরুষরা পারে না সবাইকে তার বোন মনে করতে । আলাদা করে ঐ বাড়ীর মেয়ে, ও বাড়ির মেয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁইটা গেল, তা মজার সন্দেশ না বানাতে! আত্তর মারি কুরবানীর।
শুধু গোশত খাওয়ার উৎসবই যদি কুরবানী হয়, দরকার নাই এমন কুরবানীর। ভাবলে চলবে না, ঘরের কাজ সারতে হবে ইপ্সিকে।
রাতে ঘরের সব কাজ সেরে সবার ঘরে গিয়ে দেখলো মশারী খাটিয়েছে কিনা। সবার ঘর ঘুরে মেইন গেট আটকে নিজেও শুয়ে পড়লো ইপ্সি।
সকাল হয়েছে।
ঘড়েিত এলার্ম দেয়াই ছিলো। বাবার পাঞ্জাবী! হুঁ, রেডী আছে।
-অপু , অপু...
ডাকতে ডাকতে ছুটলো ইপ্সি। অপু , অর্পণ রেহমান, ইপ্সিদের একমাত্র ভাই। অপু কোথায়? কোথায় আবার, ল্যাপটপে বসে আছে।
তাড়া লাগাল ইপ্সি।
-অপু, বাবা গোসলে চলে গেছে। বের হয়েই চিল্লাবে। তুই গোসলে যা...
-এইতো হয়ে গেছে...
ল্যাণ্ডফোনটা বেজেই চলেছে। কে ফোন করেছে! মোবাইল থাকতে সাধারনত এ বাড়ীর ল্যাণ্ডফোনে কেই ফোন করে না।
ইপ্সি ছুটলো ফোনের দিকে।
-হ্যাঁ, কনফার্ম। ১০টায় বেরুবো। তুই রিকশা রেডী রাখিস। মেঘনার ঘাটে গিয়ে নৌকা নেব।
রাখি।
খটাস করে ফোনটা রাখলো নিম্মী।
-কে ফোন করেছে, নিম্মী?
-কে আবার, আরিফ। বলে দিয়েছি আমরা যাচ্ছি ঠিক সময়ই...
-তুই বাবাকে না জিজ্ঞেস করেই কথা দিলি!
-বাবাকেতো কালই বলেছি!
-বাবা কি অনুমতি দিয়েছে?
-আপু, ঈদের দিন এমন অশুভ কথা বলবে না। বাবা এবার আনুমতি দিয়েছে।
ইপ্সির বুক ধক্ করে উঠল। বাবা অনুমতি দিয়েছে! কিভাবে! শেষসময়...!
-ইপ্সি..
-জ্বি মা, আসছি।
ইপ্সি দৌঁড় লাগালো।
-কি হয়েছে, মা?
-দেখ, তোর বাবা কি বলছে!
-কি হয়েছে বাবা?
-তোমরা নাকি মেঘনা দেখতে যাচ্ছ?
-বাবা, নিম্মী নাকি তোমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে?
-হ্যাঁ, নিম্মী বলেছে। কিন্তু আমি মনে করেছি মজা করছো তোমরা।
-না, বাবা...
-তোমরা যে নাচছো, যাবে কার সাথে? অপু আমার সাথে যাবে।
-আরিফ যাচ্ছে।
-আরিফ যাচ্ছে মানে! তোমাদের কি মনে হয় কোন গার্ডিয়ান ছাড়া আমি তোমাদের ছেড়ে দেব!
-বাবা, অপু আমাদের গার্ডিয়ান?
-হ্যাঁ,নয়তো কি?
-বাবা, অপু আমার ১১বছরের ছোট। নিম্মীও অপুর চেয়ে বড়। অপু কি করে গার্ডিয়ান হয়।
সে ছেলে এই কি ওর গার্ডিযান হবার যোগ্যতা?
বাবা এবার থতমত খেলেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। মা পিছনে দাঁড়িয়ে স্ট্যাচু হয়ে। ইপ্সি ক্ষ্যাঁপে গেছে।
-বাবা, মেঘনায় যাবার প্ল্যানটা নিম্মীর।
আমি এতে কোন কথা বলিনি। কিন্তু তুমি যখন বলেছ গার্ডিয়ান ছাড়া কি করে যাবি? আর অপু গার্ডিয়ান!
-তোদের পাহারা দিতেও লোক লাগবেতো...।
-পাহারা? কেন?
-এলাকার ছেলেরাতো ভাল না। যদি দেখে এ বাড়ির মেয়েরা বের হয়েছে...।
-সো হোয়াট,বাবা।
ওদের ভয়ে আমরা ঘরে বসে থাকবো? ওরাই সমাজের মাথা হবে! আজ যারা আমরা বের হলে নোংরা কথা বলবে, তারা পরবর্তীতে বয়স বাড়লে সমাজপতি হবে! তাহলে সমাজের কি হবে...! পাহারার কথা বলছো!
তবু তোমাদের মত একজন মহাপুরুষতো নিচ্ছি। আরিফ যাচ্ছে। আরিফ অপুর চেয়ে ৫বছরের বড়, হয়তো গার্ডিয়ান নয়..!
এক নিঃশ্বাসে র্হর্ব করে কথা বলল ইপ্সি। কিছুটা চিল্লিয়েই বলল। নিম্মী আর রী এসে দাঁড়ালো ঘরের দরজায়।
বাবা বোধহয় কিছুটা অপমানিত বোধ করলেন। ইপ্সি কখনও বাবার সাথে এভাবে চিল্লিয়ে কথা বলে না।
-তুমি জান রক্তের সম্পর্কিত মহাররম ছাড়া হজ্ব পর্যন্ত হয়না!
-বাবা কেউ হজ্ব করতে যাচ্ছিনা। আমরা মেঘনা নদীতে ঘুরতে যাচ্ছি। আর যখনি তোমাদের পুরুষদের আঁতে ঘা লাগে গায়েওে মোহাররমের খোড়া অজুহাত দেখাতেও ছাড়না বাবা, ছিহ্! তুমি কি বলছ বাবা? আরিফ আমার চাচাত ভাইয়ের ছেলে।
তুমি মোহাররমের অজুহাত দেখিও না, প্লিজ...। আর যখন হজ্বেও কথাই তুলেছ, আমার এমন হজ্বেও দরকার পড়বে না...
এবার মা চিল্লিয়ে উঠলেন।
-দেখলে তোমার নাস্তিক মেয়ে কি বললো?
-তুমিইতো মা। তুমিইতো শিা দেবে...
ইপ্সির কান্না পাচ্ছে। ও দৌঁড়ে ঘর থেকে বের এল।
ও নাস্তিক না আস্তিক, সে বিচার করার সময় নেই ওর কাছে। বাবা বোকার মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বাবা বুঝতে পারছেন তিনি কি ভুল করেছেন। মোহাররম-হজ্ব-গার্ডিয়ান এসব কথা না তুললেও পারতেন। নিম্মী-রীও এল বোনের পিছুপিছু।
-নিম্মী, আরিফকে ফোন লাগা।
-আপুনি...
-আমি কথা বলবো।
আরিফকে না করে দেয়া হলো। ইপ্সি ঘুমিয়ে আছে। দুপুরবেলা ডাকছে কেউ।
অনেক কেঁদেছে আজ। গালে শুকিয়ে আছে চোখের জল। একটা ভাল পজিশনে থাকার পড়েও মেয়েদের উপর গার্ডিয়ান ছেলেরাই। ছোট হলেও! ও ঝটকা মারল হাত।
-কি হয়েছে? উঠতে পারবো না।
-ওঠ মা...
ধড়মড় করে উঠলো ইপ্সি। বাবা!
অটোরিকশা ভাড়া করে আনা হয়েছে। মেঘনায় যাচ্ছি আমরা। বাবাও যাচ্ছে সংগে। মেঘনা ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া হলো।
ইপ্সি বাবার সাথে কথা বলছে না। ওর ওড়না উড়ছে বাতাসে। বাবা পাশে এসে বসলেন। পাশ দিয়ে একটা নৌকা গেল। ওটাতে অনেকগুলো ছেলে।
ইপ্সিদের নৌকার পাশ দিয়ে যাবার সময় ছেলেগুলা বিশ্রীভাবে শিস্ বাজালো।
-দেখলিতো কি করলো? আমি আছি বলে রা। নয়তো...! এজন্যই তোদের গার্ডিয়ান ছাড়া বের হতে দেই না।
নিম্মীরা খাব মজা করছে নৌকায়। ফটোসেশন চলছে।
রী একবার ঘোমটায় বউয়ের পোজ দিচ্ছে, আবার চুল ছেড়ে দিয়ে পোজ দিচ্ছে। সবাই খুশী। ইপ্সি ঝটকা মেরে তাকাল বাবার দিকে। বলতে গিয়েও বললো না। বাবা, গার্ডিয়ান মানে ছেলে! এই সমাজ কি তাই বোঝায়।
ও হাসলো।
-বাবা, আমি জানি তুমি আমাদের অনেক ভালবাস। আমরাও তোমাকে ভালবাসি বাবা।
বাবা ইপ্সির হাত ধরলো। ইপ্সি দূর মেঘনায় তাকিয়ে আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।