আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারী স্বাধীনতা ও পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি

আসিফ মহিউদ্দিনের একটি পোস্ট ও মন্তব্যগুলো পরে অনেকের মত আমারও মন খারাপ হয়েছে। তবে আমার মন খারাপ হবার কারন ভিন্ন। ব্লগে নাস্তিকদের সংখ্যা বাড়ছে। যখনই কোন ব্লগারকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করি,নিজের ভেতর যুদ্ধজয়ের একটা উচ্ছ্বাস অনুভব করি। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম আমরা অনেকে নাস্তিক হয়েছি কিন্তু পুরোপুরি নারীবাদী হতে পারি নি।

সহজ সহজ ব্যাপার নিয়ে এত জল ঘোলা হয় কেন আমি বুঝে উঠতে পারি না। নারীকে পুরুষের যৌন আক্রমন থেকে রক্ষা করতে হবে,এ ব্যাপারে দেখি সবাই একমত। তারপরও এত মতের ভিন্নতা কেন ?ধরুন আপনার বন্ধুর বাসায় গেছেন। আপনার বন্ধু আপনাকে তার রুমে বসিয়ে রেখে বাথরুমে গেছে। টেবিলের উপর একটা ঘড়ি দেখতে পেলেন।

ঘড়িটি দেখেই আপনি বুঝতে পারলেন এটি বেশ দামি এবং এটি কেনা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন আপনি কী করবেন?আপনি কি ঘড়িটি পকেটে করে নিয়ে আসবেন আর সবাইকে বলবেন আমার এটি ভাল লেগেছে তাই নিয়ে এসেছি?সবাই নিশ্চয় আপনার পারিবারিক শিক্ষাদীক্ষা ও মূল্যবোধকে দায়ী করবে অথবা বলবে আপনি ক্ল্যাপ্টোম্যানিক। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সবাই কী করবে?সবাই কি বন্ধুদের বাসায় আনা বন্ধ করে দেবে,নাকি এমনটাই করা উচিত?কেউ কেউ ভাবছেন আমি নারীকে পন্য হিসেবে দেখছি কিনা? আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আমি বুঝাতে চাইলাম আমাদের অনেক কিছুই পেতে ইচ্ছে করবে তাই বলে জোর করে তা পাওয়ার প্রবনতা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। রাস্তা দিয়ে হাটছেন,রসগোল্লা দেখে খেতে ইচ্ছে করলো আর আপনি মিষ্টি নিয়ে দৌড় দিলেন।

এখন কি আপনি মিষ্টির লোভ দেখানোর জন্য দোকানীকে দায়ী করবেন?আপনি হয়তো বলবেন যে,ক্ষুধার জ্বালায় কেউ যদি দোকানের খাবার চুরি করে তাহলে কি সেটা অন্যায়?অবশ্যই অন্যায়। চিন্তা করে দেখুন,দোকানী যদি দোকানে খাবার দেখিয়ে না রাখত তাহলে কি লোকটির খিদা লাগত না? লাগত। তখন সে কী করত?বাসায় বাসায় গিয়ে খাবার চাইত। তখন যদি তাকে কেউ খাবার দিতে না চায় আর সে যদি জোর করে খাবার নিয়ে আসে তাহলে নিশ্চয় আপনি বলবেন না,ঘরে খাবার রাখা অপরাধ। তার মানে কি এই নয় যে,ঘরে খাবার রাখা আর দোকানে খাবার রাখায় সমস্যা না?আসল সমস্যা আমাদের জোর প্রয়োগের প্রবনতায়।

যৌনাকাঙ্ক্ষা ক্ষুধার মতই সার্বজনীন। তাই আমাদের উচিত নিজ যোগ্যতায় আমাদের এই চাহিদা পূরনে সক্ষমতা অর্জন করা। এজন্য প্রয়োজন মুক্ত সমাজ। সামাজিক সেন্সরশীপ বন্ধ করতে হবে। মুখে সবাই বলব হস্তমৈথুন ভাল নয়-ধর্মে নিষেধ আছে,অথচ আমরা সবাই অনবরত হস্তমৈথুন করে যাব,এধরনের ভণ্ডামি থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে।

একটা ছেলের মত একটা মেয়েরও জৈবিক চাহিদা আছে। এখন একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যদি একমত হয় যে তারা একে অপরের চাহিদা পূরন করবে তাহলে আমাদের সমস্যা হবে কেন?এমনটা ভাবতে আপনার গা ঘিনঘিন করে?ভালকথা,আপনি সবাইকে দাওয়াত করে বিয়ে করুন,দুজনে মিলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর ভালবাসায় সুখে-দুঃখে একাকার হয়ে যান,আমাদেরও দেখতে ভাল লাগবে। কিন্তু কে কোন পথ বেছে নেবে সেটা তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। কেউ কেউ বলবেন,এতে করে সমাজে প্রতারনার হার বাড়বে,ছেলেরা প্রেম করে বিয়ের কথা বলে সেক্স করবে তারপর সটকে পড়বে। এটি আসলে আমাদের সামগ্রিক নৈতিকতার স্তরকেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্বের উন্নত সমাজগুলিতে মোটামুটি সবাই বিয়ের আগেই সেক্স করে কিন্তু কেউ কারো বিরুদ্ধে প্রতারনার অভিযোগ করে না। কেউ কেউ মডেলিংকে নারীর অবমাননা হিসেবে দেখছেন। আমি নারীর প্রতি আপনাদের শ্রদ্ধাবোধকে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু দেখুন,আপনি হয়তোবা নারীকে পন্য হিসেবে দেখতে চান না,কিন্তু অধিকাংশ পুরুষ নারীকে পন্য হিসেবে দেখতে চায় বলেই তো তার পন্য সত্ত্বার এত মূল্য। তাহলে এর জন্য নারীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে আমাদের কি উচিত নয় নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করা?কর্পোরেট কোম্পানিগুলো যদি আমাদের ক্ষতি করে থাকে তাহলে আমরা এদের বর্জন করছি না কেন?আসলে ওদের কাছ থেকে আমরা যা পাই তা ত্যাগ করার ইচ্ছে আমাদের নেই।

কর্পোরেট কালচার আসলে একটা দর্পন। সেই দর্পনে আমরা আমাদের নীতিহীন ভন্ডামিপূর্ন সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখে ক্ষেপে যাই। ইদানিং রবির একটা বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। সেখানে একটি মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলে। তার ভাই বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়।

খুব জাকজমকভাবে অনুষ্ঠান হবে। ভাই বোনকে বলে,তোর বিয়ের জৌলুস দেখে “ও বাড়ির সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখবে”। এখন এই বিজ্ঞাপন দেখে আপনি ক্ষিপ্ত হতে পারেন এই ভেবে যে,এরা প্রতিবেশীতে প্রতিবেশীতে নোংরা মানসিক প্রতিযোগিতা প্রোমোট করছে। কিন্তু আপনি একটু ভাবলেই বুঝবেন,এই নোংরা মানসিক প্রতিযোগিতা আমাদের সমাজে বেশ ভালভাবে আছে বলেই রবি এমন একটা বিজ্ঞাপন করেছে। তাই অহেতুক না ক্ষেপে আমাদের বরং সমাজের এই নোংরা কালচার থেকে বের হয়ে আসার জন্য নিজেদের আত্নিক উত্তরন ঘটানো উচিত।

আপনি বলবেন,আপনি কি বেশ্যাবৃত্তির পক্ষে?তাহলে আপনাকে জিজ্ঞেস করি কেউ যদি রক্ত বিক্রি করে আর অন্যজন যখন নিজের প্রয়োজনে সেই রক্ত কেনে তখন আপনি নিশ্চয় বলেন না,রক্ত কেনাবেচার এই প্রক্রিয়া অবৈধ। আবার আপনি পেশাদার রক্তবিক্রেতা যে কিনা রক্ত বিক্রির এই টাকা দিয়ে হয়তো মদ কিনে খাবে তার কাজকে শ্রদ্ধা করবেন না। কিন্তু কেউ যদি তার সন্তানের ওষুধ কিনবার জন্য তার রক্ত বিক্রি করে তখন আবার তার প্রতি আপনার সমবেদনা জাগবে। এই রক্ত,কিডনী,চোখ সবই শরীরের অংশ। মানুষ খুব নিরুপায় না হলে নিজের শরীরটাকে অন্যের হাতে তুলে দেয় না।

যে সব নারী শরীর বেচে তাদের অধিকাংশের বেলায়ও এই কথা সত্য। কেউ হয়তোবা তার প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে এসেছে,প্রেমিক কিছুদিন এক সাথে থাকার পর সটকে পড়েছে,তার আর বাড়ি ফেরার উপায় নেই,তাই এই পথে। অন্য কাহিনীগুলো আরও বেশি করুন। যাই হোক,কে কেন শরীর বিক্রি করতে পারবে আপনি তা ঠিক করে দিতে পারেন না। আমাদের উচিত কেউ যেন এসব করতে বাধ্য না হয় সে চেষ্টা করা।

হাসপাতালে যেন পর্যাপ্ত ওষুধ থাকে। আমরা মদ খাওয়া নিষিদ্ধ করতে পারি। কেউ যেন কাউকে জোর করে তার কিডনী বিক্রি করতে না পারে সে দিকে নজর দিতে হবে। তেমনি ভাবে নজর দিতে হবে কোন রানীমাতা যেন মেয়েদের আটকিয়ে রেখে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করতে না পারে। আর যে নারী শরীর বেচে শুধুমাত্র তার দিকেই বা চোখ কেন,যারা ঘরে বউ রেখে অন্যের শরীর কিনে নিচ্ছে তাদের দিকে কেন আমাদের আঙ্গুল উঠতে চায় না?আমরাও পুরুষ বলে নাকি সে নারীর মত অবলা নয় বলে? নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি,নারীর চিন্তার স্বাধীনতা নাকি নারীর শিক্ষা আগে? আমারতো মনে হয় এগুলো সবগুলোই নারীর জন্য প্রয়োজন এবং এর যে কোন একটি আসলেই বাকিগুলো আসবে।

এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হল,চিন্তার স্বাধীনতা এরপর শিক্ষা এরপর অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু আমাদের মত নীতিহীন পুজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক মুক্তি শিক্ষার চেয়ে সহজলভ্য। আর চিন্তার স্বাধীনতা সবচেয়ে দুর্লভ। মুক্তমনা ভাইদের বলছি,নাস্তিকতার সাথে সাথে নারীবাদের উপরও জোর দিতে হবে। পুরুষ যখন নারীকে নারীর চোখে দেখতে শিখবে,তখন সে ধর্মের অমানবিকতা খুব সহজেই উপলন্ধি করবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.