আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনখেঁকো ঘুণপোকা

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রুবিনার কোন দিকেই হুঁশ ছিল না। তাকে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ঘরে পরে থাকা ঢোলা ধরনের ম্যাক্সি আর নিউমার্কেটের ফুটপাত থেকে কেনা দেড়শ টাকার স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই বেরিয়ে পরেছিল। বাসায় থাকলে সচরাচর ওরনা গায়ে রাখে না সে। কিন্তু, হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতে যাওয়ার আগে কি মনে করে ওরনাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল।

নিয়েছিল বলে রক্ষা। নইলে এই বৃষ্টিভেজা রাতের ঠান্ডা হাওয়ায় বুকে ঠান্ডা লেগে যেতে পারত। হয়তো সেটা নিউমোনিয়া পর্যন্ত গড়াতো। ঠান্ডা সে একদম সহ্য করতে পারে না। পাতলা হলেও ওরনাটা বরফছোঁয়া ঠান্ডা বাতাসের সরাসরি ধাক্কা থেকে কিছুটা হলেও তো আড়াল দিচ্ছে।

নিজেকে নিয়ে রুবিনা চিন্তা করে না। অন্যসময় হলে এগুলো কিছুই সে পাত্তা দিত না। নিজের মনে চিরপরিচিত এই শহরের রাজপথ ধরে খানিকক্ষন হেঁটে ঘরে ফিরে যেত। মেয়ে হলেও রাত-বিরাতে একা একা রাস্তায় হাঁটার অভ্যাস সে ভালোই রপ্ত করেছে। এরকম সময়ে সে তার চেহারায় কপট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলে আর চোখে-মুখে ধরে রাখে আত্মবিশ্বাসের তীক্ষ্ণ হাসি।

যার ফলে অন্যের অবাঞ্চিত কৌতুহল থেকে সবসময়ই রক্ষা পেয়ে আসছে সে। কিন্তু, এখন তো আর রুবিনা শুধুই রুবিনা নয়। ছোট্ট একটি নতুন জীবন একটু একটু করে রুবিনার দেহ থেকে প্রানশক্তি শুষে নিয়ে বেড়ে উঠছে তার গর্ভে। যে প্রানের সকল নিরাপত্তার ভার রুবিনার উপর। তাই সে চাইলেও আগের মত দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরন করতে পারে না।

আজকের রুবিনা তাই অন্য দিনগুলোর চেয়ে একটু বেশি সচেতন। রুবিনার আজ রাস্তায় বের হওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না। আজকের রাত সে কাটাতে চেয়েছিল একদম নিজের মত করে। রাতে খাওয়ার জন্য ডিম ভুনা আর ঘন মসুরের ডাল রান্না করেছিল। অনেকদিন পর নিজের খাবার নিজের হাতে রান্না করল সে।

তরকারির রঙ দেখে মনে হয়েছিল ভালোই হবে খেতে। ঘ্রান ও ছিল মনমাতানো। অল্প একটু ঘি বেশ যত্ন করে রাখা ছিল মিটশেফের এক কোনায় ছোট প্লাস্টিকের বয়ামে। ইচ্ছে ছিল চুলা থেকে সদ্য নামানো গরম ভাতে এক চামচ ঘি ঢেলে দিয়ে আয়েশ করে রাতের খাবার খাবে। তারপর কলের ঠান্ডা পানির ঝাপটা মুখে দিয়ে ঘুমকে যতদূর সম্ভব তাড়িয়ে রাতের অর্ধেকটা কাটাবে ভিডিও চ্যানেলে হিন্দী সিনেমা দেখে।

ঠিক যেমনটা করে আর সব সংসারের বউরা। ভাত হওয়ার আগেই কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে দেখে কিসমত আলী দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে যথারীতি আধপোঁড়া গোল্ড লীফ সিগারেট। পরনে চেকের লুঙ্গি আর ম্যাড়ম্যাড়ে লাল পাঞ্জাবী।

গলায় কাইতনের সাথে ঝুলানো তাবিজ আর বাম হাতে চামড়ার বেল্টের ঘড়ি। ইদানিং আবার গোঁফ রাখা শুরু করেছে। দরজা খুলতেই রুবিনার বুকের দিকে তাকিয়ে ভাড়া চায় কিসমত। মান্ধাতা আমলের পাঁচতলা এই বাড়িটির মালিক কিসমত আলী। এই বাড়ির দোতালার একটি ইউনিট বছর দুয়েক আগে ভাড়া নেয় রুবিনা আর জাহিদ।

মেয়েদের সাথে যখন কথা বলে তখন কিসমতকে দেখে যে কারো মনে হতে পারে মেয়েদের চোখের অবস্থান তাদের দুই স্তনে। রুবিনা কিসমতকে প্রথমে কিছু বলতে পারে না। কারন তার কাছে একদমই কোন টাকা নেই। তারপর আমতা আমতা করে বলে, সামনের শনিবারে দিয়ে দিব। কিসমত তার চোখ আগের জায়গাতে রেখেই বলে, ‘ঠিকাছে, তয় টাইমমত দিয়া দিয়েন কইলাম’ বলেই সে উল্টো ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

তারপরই রুবিনার আবার সব মনে পরে যায়। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাড়ি ভাড়া নিলেও রুবিনা আর জাহিদের নিয়মমাফিক বিয়ে হয়নি। তারা বছর খানেক প্রেম করার পর একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটাও তো দুবছর হয়ে গেল। দুজনেই তারা চাকরী করে।

জাহিদ একটি পত্রিকা অফিসের এডিটোরিয়ালে কাজ করে আর রুবিনা একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। তাদের কারোরই কাজের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তাই তাদের দেখা সাক্ষাত খুব কম হয় আর হলেও তা এই বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে যেদিন আগে বাসায় আসে সে সেদিন বাজার করে আনে। একজন বুয়া সন্ধ্যার পর এসে রন্না করে দিয়ে যায়।

সংসারের টুকিটাকি যা লাগে প্রায় সবই তারা মোটামুটি কিনে ফেলেছে। দুইজন মিলে এই কয়দিনে বেশ ভালোই গুছিয়ে নিয়েছে। সব গোছালেও নিজের সম্পর্কটা গোছায়নি বলেই হয়তো আজ রুবিনার এই অবস্থা। কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস যেন বুক নিংড়ে বেড়িয়ে আসে তার। কত ছেলেমানুষী, কত আহ্লাদ, কত পরিকল্পনা; সব ছুঁড়ে ফেলে জাহিদ আজ চলে গেছে।

যেই রুবিনাকে কথায় কথায় জাহিদ তাকে বাহবা দিত সেই রুবিনাকেই আজ সে বলেছে চূড়ান্ত বেকুব। কিন্তু রুবিনার তো কোন দোষ ছিল না। জাহিদ নিজেই তো কন্ডোম ব্যবহার করতে চাইতো না। রুবিনাকে পিল খেতে বলত। রুবিনা এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করত না।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু এই মাসে পিরিয়ডটা মিস করার পরই রুবিনা কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়। সন্তান নিতে তার আপত্তি নেই কিন্তু এর জন্য এখনই সে প্রস্তুত নয়। পিল সে ঠিকই খেয়েছিল, কিন্তু কাজ করল না কেন সেটাই বুঝতে পারছে না। তবুও একটু দোনামোনা যা কাজ করছিল আজকের প্রেগনেন্সী টেস্ট পজেটিভ আসায় আর তো কোন সন্দেহই থাকল না।

তারপরই বেরিয়ে পরল জাহিদের আসল রুপ। সারাদিন দুইজনের ঝগড়া-চেঁচামেচিঁর পর জাহিদ সব সম্পর্ক চুকে-বুকে দিয়ে চলে গেছে। এমনিতে রুবিনার এতে সমস্যা হত না কিন্তু গত দুই মাস ধরে তার বেতন হচ্ছে না। এজন্য মোটামুটি ভালো সমস্যায় পরেছে সে। রুবিনা জানে যে এটা সে কাটিয়ে উঠতে পারবে।

তার জন্য একটু সময় দরকার। জাহিদ সেইসময়টা পর্যন্ত তাকে দেয়নি। প্রথমে জাহদের উপর প্রচন্ড রাগ হলেও এখন আর আলাদা কোন অনুভুতি নেই রুবিনার। আর সব সন্ধ্যার মত এই সন্ধ্যাও ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কিসমতকে দেখার পর সেই ঘৃনা আবার মাথায় চেপে বসে।

এবার শুধু জাহিদ নয়, সব পুরুষের উপরই তীব্র ঘৃনা হয় রুবিনার। এজন্যই কোন কিছু চিন্তা না করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে সে। মাথায় অনেকরকম চিন্তা খেলা করছে। একবার মনে হচ্ছে অ্যাবরশন করিয়ে নেবে, আজকাল অনেকেই তা করছে। আবার মনে হচ্ছে দেখা যাক কদ্দুর কি গড়ায়।

রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ঝিলের দিকে চলে এসেছে রুবিনা তা খেয়ালই করেনি। এখানে এসেও খেয়াল করত না যদি না হঠাৎ একটা মানবশিশুর কান্নার শব্দ তার কানে আসতো। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে তাকিয়ে রুবিনা যা দেখল তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না সে। ঝিলের পাড়ে স্যুয়ারেজের বড় বড় পাইপ এনে রাখা হয়েছে। এমন একটা পাইপের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ছোট শিশুর কান্নার শব্দ।

আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করলে মানব-মানবীর মিলনকালীন শীৎকারের শব্দও পাওয়া যায়। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে রুবিনা বুঝতে পারল পাইপের ভেতর একজন নারী আর একজন পুরুষ মিলিত হয়েছে। রুবিনা কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখল লোকটি পাইপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। লুঙ্গি ঠিক করতে করতে কিছু টাকা ছুঁড়ে দিল পাইপের ভেতরে। আর কর্কশ সুরে খেঁকিয়ে উঠল একটা গাল দিয়ে।

লোকটি চলে যাওয়ার পর রুবিনা পাইপের দিকে এগিয়ে গেল। পাইপের ভেতরে মহিলাটি ততক্ষনে বাচ্চাটিকে বুকে তুলে নিয়েছে। বাচ্চাটি মনের আনন্দে তার নগ্ন চিমসানো স্তন চুষছে। আর মহিলাটি বেদম হাঁপাচ্ছে। একটু আগের পরিশ্রমের ফল।

রুবিনা কিছুটা ঝুঁকে পাইপের ভেতর মুখ গলিয়ে বলল, এই বাচ্চার বাবা কোথায়? কাতর কন্ঠে উত্তর এলো, ‘কত মাইনষেই তো আহে, কত ভদ্দর লোক, কত চোর বাটপার। হ্যাগো মইদ্যে বাপ কেডা তা ক্যামনে কইতাম! আমি হইলাম মা, হ্যার লাইগ্যা নিজের চমড়া বেঁইচ্যা অরে বাঁচায় রাখছি’। রুবিনা আর ওখানে দাঁড়াতে পারে না। সে ও তো মা হতে চলেছে। বাপ না হয় অনাগত সন্তানকে ফেলে চলে গেছে, মা হয়ে সে তো আর সন্তানকে কষ্ট দিতে পারে না।

রুবিনা যেন তার পুরোন আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। তার ঘরে ফিরতে হবে। তার দেহ থেকে পুষ্টি নিয়ে তিল তিল করে বেড়ে উঠবে আরেকটি প্রান; স্রষ্টার মহান সৃষ্টি। স্রস্ট তাকে মনোনীত করেছে পবিত্র এক দায়িত্ব পালনের জন্য। রুবিনা আর রুবিনা থাকবে না।

তার সন্তান তাকে নতুন নাম দিবে। সেই নাম যতটা উচ্চারিত হবে তার চেয়ে অনেকটা বেশি থাকবে অব্যক্ত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.