আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানবিক ও দানবিক বিবেচনার অনুপাত-সমানুপাত



মানবিক ও দানবিক বিবেচনার অনুপাত-সমানুপাত ফকির ইলিয়াস ===================================== বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি ইস্যুতে বিএনপির হাইকমান্ডের নেতারা বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন তারা রাজপথে বিষয়টির সুরাহা করবেন। খোন্দকার দেলোয়ার ও আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেছেন বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা হোক। এটা খুবই স্পষ্ট, আইনের ধারাবাহিকতার কাছে বিএনপির খেলোয়াড়রা হেরে গেছেন। তারা আটকে গেছেন তাদেরই পাতানো ফাঁদে।

এখন তারা যা বলছেন, তা অযৌক্তিক। একান্তই ইমোশনাল কথাবার্তা। কথা তারা আরও বাড়িয়ে বলছেন। তারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে সেনানিবাস থেকে উচ্ছেদ করা হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরও বুলডোজার দিয়ে উড়িয়ে দেবেন। কথাগুলো চরম ধৃষ্টতার শামিল।

কারণ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এখন কোন মানুষজন বসবাস করেন না। বাড়িটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সেই বাড়িটি জাতির জনকের উত্তরসূরিরা জাদুঘরের জন্য দান করেছেন ট্রাস্ট গঠন করে। তাহলে কী পঁচাত্তরের সেই হায়েনা চক্রের উত্তরসূরিরা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের ওপরও আঘাত হানার উদ্যত ফণা মেলতে চায়? ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। সেই সরকার গণভবন দান করেছিল বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয়কে।

বিতর্ক উঠেছিল তা নিয়েও। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাকে দিয়ে দেয়া হয়েছে এ জিগির তুলে বিএনপি আন্দোলন করেছিল। ২০০১-এর নির্বাচনে জিতে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার সেই বরাদ্দ বাতিল করেছিল। আওয়ামী লীগ তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্যই করেনি। শেখ হাসিনা সেই ভবনটি ছেড়ে দিয়েছিলেন সহাস্যেই।

পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে মঈনুল রোডের বাসার ভেতরে নাকি আরেকটি ভবন নির্মাণ করেছেন তারেক রহমান। তিনতলা সেই ভবনটির নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ থাকলেও, যা করা হয়েছে তা হয়েছে সেনাকল্যাণ বোর্ডের অনুমোদন না নিয়েই। কোন রাষ্ট্রে সামাজিক, রাজনৈতিক আগ্রাসন কতটা নগ্ন হতে পারে, তার চরম নমুনা স্থাপন করেছিলেন তারেক রহমান। তার আগ্রাসী মনোভাবের কারণেই এদেশে ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি হয়েছিল, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে এবং এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে, মঈন উ আহমেদ সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েই বাংলাদেশ, দেশের মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন। তা না করলে দেশটি চরম গৃহযুদ্ধের দিকেই ধাবিত হতো।

অবশ্য পরবর্তী রাজনীতি বা মাইনাস টু ছিল অগ্রহণযোগ্য একটি ষড়যন্ত্র। আমি এখনো মনে করি, জামায়াতের পাল্লায় পড়ে বিএনপি যদি দেশকে চরম জঙ্গিবাদী রাহুর কবলে ঠেলে না দিত তবে, বিএনপির এত রাজনৈতিক পরাজয় হতো না। জঙ্গিবাদকে সহচর করে রাজনীতি করা কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টা মানেই গণতন্ত্রকে প্রকারান্তরে গলাটিপে হত্যা করা। চারদলীয় জোট সরকার ছিল তার প্রত্যক্ষ শক্তি। সবচেয়ে দুঃখ এবং লজ্জাজনক কথা হচ্ছে, বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাও সব বিবেকের মাথা খেয়ে এ রাজাকার শক্তির হোতাদের পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হয়ে ছিলেন।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় তাই হয়েছে খালেদা জিয়ার। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন পবিত্র ঈদুল আজহার পরপরই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে এবং সরকারের পতন ঘটানো হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে কোন নির্বাচিত সরকারকেই আন্দোলনের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করা যায়নি। এটা খালেদা জিয়া নিজেও জানেন, আওয়ামী লীগ এমন কোন খড়কুটোর ঘর নয় যে, ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। যারা পঁচাত্তরে সেই স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেছিল, তাদের বাসনা দুঃস্বপ্নই থেকে গেছে।

তাই নিজের পায়ের নিচে মাটির শঙ্কা অনুভব করে খালেদা জিয়া এমন হঠকারী কথাবার্তা বলছেন কেন? দুই বর্তমান মহাজোট সরকারের নানা সমালোচনা করতে গিয়ে বিশেষ একটি শ্রেণী সরকারের নানা প্রতিশ্রুতির উদাহরণ তুলে ঘোলা জলে মাছ শিকারে ব্রতী হচ্ছেন। বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি একটি ফ্যাশন মাত্র। ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট যে নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল তার শতকরা কত ভাগ পূরণ করতে পেরেছিল? '৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের ওয়াদা কতটা পূরণ করতে পেরেছিল? এর অনুপাত-সমানুপাত বিবেচনা করা দরকার। ১৫ কোটিরও বেশি মানুষের এ জনবহুল দেশ। যে দেশটিতে টাকা দিয়ে ভোট ক্রয়-বিক্রয় করা যায়।

যে দেশের বিবেকবান কথিত শ্রেণীও বিক্রি হয়ে যান কেউ কেউ অর্থ-বিত্তের কাছে। যে দেশে ক্ষমতার পালাবদল হলেই ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী ভোগের জন্য হামলে পড়ে। এটা তো কঠিন কাজ যে নির্বাচনী ওয়াদার সিংহভাগ পূরণ করা যাবে। ধরা যাক বর্তমান সময়ের কথা। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে তাদের দখলদার বাহিনী যে কাজগুলো করেছে, সেই একই পথ অনুসরণ করছে আওয়ামী লীগেরও কিছু নেতা-কর্মী।

তাদের সামাল দেয়া যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না? কারণ তারা বিভিন্ন অঞ্চলের এমপি-মন্ত্রীদের মদতপুষ্ট। ন্যায়নীতির কোন আপ্তবাক্যই তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। না পারার কারণ হচ্ছে, তাদের বাঁচানোর লোক রয়েছে। কিন্তু এ বাঁচিয়ে রাখা তো চিরস্থায়ী নয়।

বরং এ দুর্বৃত্তপনার পৃষ্ঠপোষকতাই একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্রমে গণবিচ্ছিন্ন করে তোলে। রাজনীতিতে দাম্ভিকতার কোন ঠাঁই থাকা উচিত নয়। সম্প্রতি একটি সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন স্বীকার করে নিয়েছেন, শেখ হাসিনার জন্য গণভবন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তারা সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মহাসচিব জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সমাবেশে আরও বলেছেন, 'আমি সংকীর্ণ ছিলাম, তাই বলে আপনি উদার হবেন না কেন?' সেনানিবাসের বাড়ি ইস্যুতে মহাসচিব সরকারকে মানবিক বিষয়ে উদার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ভাবতে খুবই অবাক লাগে পরাজিত রাজাকার শক্তির সঙ্গে জোট করে যারা ক্ষমতায় গিয়েছিল, তাদের আচরণ ছিল চরম দানবিক।

দেশজুড়ে একযোগে বোমা হামলার পরও তারা এমন অভিনয় করেছিলেন, যেন কিছুই হয়নি। এখন তারাই কী না অন্যের কাছে মানবিক সহানুভূতি খুঁজছেন। বাংলাদেশে মানবিক ও দানবিক বিবেচনার অনুপাত-সমানুপাত পর্যালোচিত হওয়া উচিত। রাজনীতিতে কারা দানবিক হয়ে রাষ্ট্র, জনগণ এবং প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে জঙ্গিবাদীদের দখলে তুলে দিতে চেয়েছে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া খুবই জরুরি দরকার। কারণ এভাবে ভন্ডামির রাজনীতি আর চলতে পারে না।

চলা উচিতও নয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ দেশ গড়ার কথা অনেকেই বলেন। কিন্তু এ দেশ গড়ার মূল চেতনা যে 'মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার' হওয়া দরকার তা অনেকেই বলেন না। সম্প্রতি প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সংগঠক, শিল্পী কলিম শরাফী তার বিভিন্ন বক্তব্য বলতেন, গণমানুষের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে যে দাগ গায়ে লাগে তা আর কখনোই মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে গণমানুষের কাতারে গিয়ে মন-প্রাণ দিয়ে দাঁড়ান ক'জন? তার কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য।

হ্যাঁ, ক'জন জননেতা হতে পারেন? ভোগবাদী রাজনীতি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণে যদি রাজনীতিকরা আদর্শবান হতেন, তবে এ দেশটি ৪০ বছরে অবশ্যই অন্য আলোয় বিভাসিত হতে পারত। এখন একমাত্র ভরসা হচ্ছে, আগামী প্রজন্ম। তারা একদিন সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে, তারা একদিন সব অপশক্তিকে তাড়াবে- সেটাই একমাত্র ভরসা। নিউইয়র্ক, ১০ নভেম্বর ২০১০ ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ১২ নভেম্বর ২০১০ শুক্রবার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।