জীবন একটাই; জীবনের জয় অনিবার্য..
চলছে ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি। বেরসিক মাঝির সাথে। মাঝি বড় একগুয়ে। আমাদের কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ঝুলে থাকা ক্যামেরাই হয়েতো মাঝির চোখে আমরা শৌখিন ভ্রমণকারী। তাই মাঝির দাবি চারশো টাকা।
আমরা তো জানি, সুন্দরের কোন টাকার পরিমাপ নাই! তবুও তিনশো টাকায় লাফিয়ে উঠলাম নৌকায়। নৌকা চলছে আমতুয়ার টানে। মদুনাঘাট থেকে আমতুয়া। মদুনাঘাট হলো হালদা নদীর এক অতি পরিচিত ঘাট। চলেছি হালদার বুক চিরে।
মাঝি সমেত আমরা চারজন। ঘড়ির কাটায় তখন চারটা। দুপুরের তেতে উঠা রোদ নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। ঠিক দুই ঘন্টা পর হালদার দুই পাড় দর্শন শেষে যখন আবার মদুনাঘাট ফিরে আসবো তখন বাজবে সন্ধ্যা ছয়টা। যে কৌতুহল নিয়ে যাত্রা শুরু- ফিরে এসে মনে মনে বলবো, এই যে সেই 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া'র মতই!
নদীর মা বাংলাদেশ।
হালদাও করে নিয়েছে তার আপন পরিচিতি। বলা হয় বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এই নদী। পাহাড়ী স্রোত, নিয়মিত জোয়ার-ভাটা আর অসংখ্য বাঁক এই নদীকে মাছের প্রজননের জন্য আদর্শ জায়গা হিসেবে গড়ে তুলেছে। পার্বত্য চট্রগ্রামের খাগড়াছড়ির বদনাতলী পাহাড় থেকে শুর এই হালদা ফটিকছড়ির বুকের উপর গিয়ে পড়েছে চট্টগ্রামে। বিবিরহাট, নাজিরহাট হয়ে হাটহাজারী, রাউজান, কোতোয়ালীর দুই পাশকে অপূর্ব নৈসর্গিক সুন্দর বিলিয়ে কালুরঘাটের কাছে গিয়ে হয়েছে কর্ণফুলীর বাহুলগ্না।
বন্ধু নিলয় ঢাকায় থাকে। হালদার ছবি তুলবার তার বহুদিনের শখ। সেই সাধ বাস্তব হয়নি আমারই অলসতার ব্যস্ততার কারণে! এইবার পুজার ছুটিকে মোক্ষম কাজে লাগিয়ে দে ছুট- হালদার পাড়ে। সাথে ছিল নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়া বুয়েটের ছাত্র জয়। কথা বলছিলাম নদী মরার প্রসংগ নিয়ে।
ওদের মুখেই শুনছি বুড়িগঙ্গার জল কৃষ্ণকালো হওয়ার কথা। কিন্তু এই কী হালদা, স্বচ্ছ নিটোল জলে পিট পিট করে ডিগবাজি খাচ্ছে ছোট ছোট মাছেরা। নদীতে যখন মাছের ডিগবাজি তখন পাড়ের দুই পাশে দেখছি বুনো মহিষের পাল, বকের ঝাঁক, কত নাম না জানা পাখির দুরন্ত ব্যস্ততা। দেখলাম তরুণ আলোকচিত্রী নিলয়ের ক্যামরার শাটারে একের পর এক চাপ পড়ছে।
নদীর বুকে ইঞ্জিন নৌকা।
আমরা চারজন পরষ্পর চিৎকার করে কথা বলছি। ইঞ্জিনের খট খট খট খট শব্দে কান ঝালাপালা। নৌকার পাশেই বয়ে চলা পানিতে ভেসে চলছে শেওলা। আমাদের গন্তব্য আমতুয়া হলেও ভেসে চলা এই শেওলার গন্তব্য? নিশ্চয় সাগর! পূব পাশে সবুজ ক্ষেতে নতুন গজিয়ে উঠা ধানের চারা। যেন যেন মাথা তুলে মা নদীকে দেখছে।
ভেসে চলা মরা গরুর দেহে বসেছে কাক। মাছ ধরাতে গিয়ে জেলের সে কী বিচিত্র ভংগিতে জাল ফেলার দৃশ্য। সবে দেড়ঘন্টা। আমরা গিয়ে পৌছলাম আমতুয়া ঘাট। সন্ধ্যা লগ্ন।
আমতুয়া বাজারে দাঁড়ালাম। চায়ের দোকানে গিয়ে আলস্য ঝাড়তেই দেখি পূবদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজের ক্ষেত। এই সবুজ ইট-কাট- কংক্রিটের কঠিন চট্টগ্রাম নগরীতে নেই। এই সবুজ দেশের সবুজ। সবুজের মায়া ছেড়ে আমরা আবার নৌকায় উঠেছি।
এবার ফেরত আসার পালা। আমতুয়া ঘাটের মুড়ি-চনাচুরের প্যাকেট এবার নতুন সংগী। সন্ধ্যার আলোতে নদীর স্রোত ম্রিয়মান রূপ। আকাশে মায়াবি আলোর ছটা। ঝাঁকে ঝাঁকে নীড় ফেরা পাখির ডানা মেলে উড়ে চলা।
ফিড়ে এলাম সন্ধ্যা ছয়টায়।
অসংখ্য খাল, ছড়া হালদা নদীর সাথে মিশেছে। রাউজানের সর্তারঘাট এলাকায় পাহাড়ি সর্ত্তা নদী হালদার সাথে মিশেছে। হালদার মোট দৈর্ঘ্য ৮১ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২৯ কিলোমিটার অংশ সারা বছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। আমাদের এই সৌন্দর্য দর্শন কিন্তু সবে আট কিলোমিটার।
পরের বার আরো দীর্ঘ যাত্রার আশা রেখে সাঙ্গ হলো আমাদের নৌবিহার।
আগ্রহী সকল ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এবার হালদা নদীতে ভ্রমণের উপায় বাতলে দিলাম। চট্টগ্রাম নগরীর বহাদ্দার হাট মোড় থেকে সিএনজি অটোরিকসা যোগে সোজা চলে আসুন মদুনাঘাট ব্রিজ। ভাড়া ৫০ টাকা। অথবা নগরীর অক্সিজেন মোড় থেকে রিকসা যোগে ৪০-৪৫ টাকায় চলে আসুন মদুনাঘাট।
নদীতে প্রতি ঘন্টায় নৌকা চালিয়ে সুখ নিতে হলে আপনাকে মাশুল গুনতে হবে ঘন্টা প্রতি ৭০-৮০ টাকা। কিন্তু হলফ করে বলা যায়, নিতান্তই বেরসকি হলেই কেবল এই টাকা খরচকে আপনি থোরাই কেয়ার করবেন।
আর দেরি কেন? শীততো চলেই এলো। হালদার বুকে সূর্যের আলোর বিকেলের মায়াবি পরশ বুলাতে চলে আসুন। আর যাই করুন অন্তত ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়িটা না করে বেরসিক মাঝিকে নৌকার বন্ধু ভাবুন।
কারণ মাঝ নদীতে তিনিই আপনার প্রথম এবং শেষ ভরসা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।