আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হালদা নদী ভরাট করে ইটভাটা : প্রশাসন আছে বলে মনে হয় না

মানুষ নিদ্রিত এবং মৃত্যুর পরপরই সে জেগে উঠবে।



পাহাড়, সাগর ও নদীবেষ্টিত চট্টগ্রামের হালদা নদী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র৷ এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়৷

হালদার কথামালা


হালদা নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের বাটনাতলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ফটিকছড়ির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে৷ এটি এরপর বয়ে চলছে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, ও অন্যান্য অংশ, হাটহাজারি, রাউজান, এবং চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালী থানার মধ্য দিয়ে৷ এরপর কালুরঘাটের কাছে কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে এই নদী৷ দৈর্ঘ্য ৯৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর ২৯ কিলোমিটার অংশ সারা বছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে৷



বর্ষার আমাবস্যা রাতে

প্রতিবছর হালদা নদীতে বর্ষার ঘনবৃষ্টির আমাবস্যার রাতের একটি বিশেষ মূহূর্তে রুই জাতীয় মাতৃমাছ ডিম ছাড়ে৷ ডিম ছাড়ার সেই বিশেষ সময়কে তিথি বলা হয়৷ স্থানীয় জেলেরা ডিম ছাড়ার তিথির আগেই নদীতে অবস্থান নেন এবং ডিম সংগ্রহ করেন৷ ডিম সংগ্রহ করে তারা পোনা তৈরি করেন সনাতনি কায়দায়৷ পৃথিবীর আর কোন জোয়ার-ভাটার নদী থেকে সরাসরি ডিম আহরণের নজির আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি৷ রুই জাতীয় মাছ, যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বাঁক কাটা, মা-মাছ নিধন, দূষণ, সরকারের উদসীনতা প্রভৃতি কারণে হালদা নদী এখন বিপর্যয়ের মুখে৷ ফলে প্রতি বছর মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে৷ আজ হতে ২০ বছর আগে যেখানে হাজার কেজি রেণু উৎপাদিত হয়েছিল ২০০৯ সালে তা কমে প্রায় ৭০ কেজিতে এসে দাঁড়িয়েছে৷

মিঠা পানির উৎস হালদা

হালদা নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয় এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস৷ চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে এ নদী থেকে৷ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকটি প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে হালদা অন্যতম৷ কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং পরিবেশ দূষণসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাকৃতিক এ মৎস্যভান্ডার এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে৷

দেশের নদ-নদীগুলো নিয়ে যে কারও মাথাব্যথা নেই প্রতিদিনের সংবাদপত্রগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। হালদা নদী ভরাট করে ইটভাটা নির্মাণের খবরটিও সেই ধারাবাহিকতা মাত্র। এ দেশের ঐতিহ্যে, অস্তিত্বে, জীবনদর্শনে, ভূ-প্রাকৃতিক গড়নে, সংস্কৃতিতে নদীর ভূমিকা অসামান্য হলেও দুঃখজনক হলো, এই নদীই এখন নির্বিচার লুণ্ঠনের শিকার হচ্ছে ভূমি-রাক্ষসদের হাতে। এদের ব্যক্তিগত লোভের কাছে উপেক্ষিত হচ্ছে জাতীয় সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির বিষয়টি।

জাতীয় অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনী শিরা-উপশিরার ভূমিকায় এই নদীগুলো করুণ চিত্র উঠে এসেছে হালদা নদীর অপ্রতিরোধ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

জনৈক ব্যক্তি দেশের একমাত্র ও এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মত্স্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার বিশাল অংশ ও জেগে ওঠা চর ভরাট করে দখলে নিয়ে চাষাবাদ ও ব্রিকফিল্ড নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রাউজান, মোবারকখিল, হাটহাজারী, গরদুয়ারা ও বোয়ালখালীতে চর দখলের যে অভিযোগ উঠে এসেছে তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না সংশ্লিষ্ট নদীগুলো একটি মহলের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার লক্ষ্যবস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। চর দখল আর বালি উত্তোলনকে কেন্দ্র করে হত্যা, গুমের ঘটনায় প্রমাণিত হয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রশ্নে এ কলামে নদী নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনার তাগাদা সরকারকে একাধিকবার দেয়া হলেও প্রশাসনের কানে পানি ঢুকছে বলে মনে হয় না।

আর এ জন্যই দুদিন পর পর আমাদের শুনতে হয় ঢাকা বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য নগরী, বাংলাদেশের বাতাস সবচেয়ে দূষিত।
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মত্স্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে হালদার গুরুত্ব অনেক। এখানকার স্বাদু পানির মাছের কদরই আলাদা। দেশের মত্স্য চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ করে হালদা। আমিষের চাহিদা মেটানোর আল্লাহ প্রদত্ত এমন একটি উত্সকে হত্যা করে আবু বক্কররা ইটভাটা নির্মাণের সাহস পেল কোথা থেকে? এদের খুঁটির জোর কোথায়? বেদনাদায়ক হলো, এই আবু বক্কররা প্রশাসনের নাকের ডগায় বছরের পর বছর এহেন অপকর্ম করে যাচ্ছে।

সঠিক তদন্ত হলে দেখা যাবে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে। অন্তত সদ্য বিগত নির্বাচনের হলফনামার অভিজ্ঞতা থেকে সেটি অস্বীকার করা যাবে না।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, হালদা নদী দখল করে চাষাবাদ ও ব্রিকফিল্ড নির্মাণ করায় এর আকার ছোট হয়ে পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে নদীভাঙন চরম আকার ধারণ করছে। নদী নিয়ে এহেন উদাসীনতা, গাফিলতি, দুর্নীতি, অবহেলা আর কত দেখতে হবে।



দেশের প্রায় সবগুলো নদী ও জলাধার পুনরুদ্ধার যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে তখন হালদা নদীর এই চিত্রে প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকা অমার্জনীয়।

সরকার যতই সাফল্যের গলাবাজি করুক, নদীগুলোর আর্তচিৎকারই বলে দেয় তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভূমিদস্যু ও নদী-রাক্ষসদের এহেন তত্পরতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের মানচিত্র পাল্টে যেতেও সময় লাগবে না। এইসব পরিবেশ শত্রুকে এখনই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া ফরজ হয়ে গেছে।


সমাপ্ত।




 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।