বেঁচে থাকার মহত্তম উদ্দেশ্যটা খুজে ফিরছি ‘বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ ১৯৭২’ : ঘাতকদের রক্ষাকবচ
শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারের অন্যান্য সদস্যদের এ ধরনে বক্তৃতা বিবৃতির পাশাপাশি চলতে থাকে দালালদের সুরক্ষার আয়োজন। বিভিন্ন মহল থেকে দালালদের বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালোতের দাবীকে উপেক্ষা করে ২৪ জানুয়ারী জারী করা হয় ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’। দালালদের বিচারের জন্য এই আদেশ অনুযায়ী আসামীর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করার অধিকার থাকলেও ফরিয়াদীকে ট্রাইব্যুনালের বিচার্য অপরাধের জন্য অন্য কোন আদালতের বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
গণহত্যাকারী ও দালাল নেতাদের সুকৌশলে রক্ষার জন্যই প্রণীত হয়েছিল এই আইন। কারণ আইনের ৭ম ধারায় বলা হয়েছিল, থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না বলেন তবে অন্য কারো কথা বিশ্বাস করা হবে না, অন্য কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার হবে না ট্রাইব্যুনালে।
অন্য কোন আদালতেও মামলা দায়ের করা যাবে না। দালালদের আত্মীয়-স্বজনের ওসিকে তুষ্ট করার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, স্বজন হারানো নির্যাতিত দরিদ্র জনসাধারণের তা ছিল না।
২৮ মার্চ দালাল আইনে বিচারের জন্য সারাদেশের সমস্ত জেলায় মোট ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যেসব অপরাধের বিচার করা হবে তা অন্য কোন আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়। এপ্রিল মাস থেকে দালাল আইনের বিচার কাজ শুরু হয়।
দালাল আইন কুখ্যাত খুনী দালালদের জন্য রক্ষাকবচ হিসাবে দেখা দেয়।
যে শান্তি কমিটির মূল কাজ ছিল নিরপরাধ বাঙ্গালীদের হত্যা তালিকা প্রস্তুত করা এবং তাদের হত্যার জন্য পাকসেনাকে সহায়তা করা, তার সদস্যরা সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ড পেয়ে নিস্তার পেয়ে যায়। শান্তি কমিটির নিজস্ব ঘোষণা অনুযায়ীই এর মূল কাজ ছিল তাদের ভাষায় ‘দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় চরদের তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদেরকে নির্মূল করা’, সুতরাং যে কোন দালালের সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার জন্য তার শান্তি কমিটির সদস্য প্রমাণিত হওয়াই ছিল যথেষ্ট।
৩০ নভেম্বর ১৯৭৩ তারিখে তথাকথিত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে ৩১ অক্টোবর ১৯৭৩ পর্যন্ত দালাল-অধ্যাদেশে অভিযুক্ত মোট ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জনের মধ্যে ২ হজার ৮ শত ৪৮ জনের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল ৭ শত ৫২ জন, বাকী ২ হাজার জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। এর মধ্যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় মাত্র একজন রাজাকারকে।
সুতরাং সহজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি গণহত্যাযজ্ঞের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে দালালরা কোন মানুষকে হত্যা করে নি, নির্যাতিত লক্ষ কোটি মানুষের জবানবন্দী কি সবই মনগড়া গল্প ছিল? নারকীয় বধ্যভূমিগুলিতে প্রাপ্ত বহুবিধ নৃশংস নির্যাতনের চিত্রসহ বিকৃত লাশগুলির সবই কি ছিল শুধু পাক সেনার শিকার?
দালাল আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনালের বিচারও ছিল প্রহসন মাত্র। একটি দৃষ্টান্ত এ প্রসংঙ্গে দেয়া যেতে পারে। সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের অপহরণকারী আল বদরটির বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্যে শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণের অভিযোগ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, কিন্তু তবু তাকে মাত্র ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। গণহত্যার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ইত্যাদি দলে যোগদানকারী ব্যক্তিদের এইভাবে লঘু শাস্তি দিয়ে কিছু দিনের জন্য কারাগারে রেখে বিক্ষুব্ধ জনতা এবং তাদের হাতে নির্যাতিতদের রোষানল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
দালাল রক্ষার এই ষড়যন্ত্র কুখ্যাত দালালদের তথাকথিত বিচার হওয়ার পূর্বে জনসাধারণের কাছে ধরা পড়ে নি।
তবে সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রথম থেকেই এই চক্রান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এরপর যখন দেখা গেল সরাসরি গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী দালালরা নামমাত্র শাস্তি পেয়ে নিষ্কৃতি পাচ্ছে তখন এ ব্যাপারে সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পায়।
২৩ জুলাই ১৯৭২ তারিখে দৈনিক বাংলায় এ বিষয়ে ‘দালাল আইন সংশোধনের প্রয়োজন’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে লেখা হয় — ‘দেশ স্বাধীন হবার পর দালাল বলে যাদের আটক করা হয়েছে তদের শতকরা ৭৫ জনেরই মুক্তি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এই বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
‘পুলিশের সংখ্যা এমনিতেই অপ্রতুল।
তদুপরি কোলাবরেটরস অ্যাক্ট-এ অভিযোগ তদন্তের ভার দেয়া হয়েছে শুধু থানার ওসিকে। কিন্তু ওসির পক্ষে একা অসংখ্য মামলার তদন্ত করা এক প্রকার অসম্ভব।
‘এ ছাড়া দালাল আইন সম্পর্কেও কিছু বক্তব্য রয়েছে আইন বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলেছেন, দালাল আইন করা হয়েছে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য। কাজেই সে অপরাধ প্রমাণের জন্য অনুসরণ করতে হয় একশ বছরের পুরনো ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট’।
এই অ্যাক্ট হয়েছে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য। কাজেই বিশেষ পরিস্থিতির অপরাধের প্রমাণের জন্য প্রণীত এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুসরণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নানা জটিলতা। ফলে অপরাধ প্রমাণ করা হয়ে উঠেছে অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য। ......
‘একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে পরিষ্কার ভাবে। ধরা যাক একজন রাজাকার অপহরণ করেছে কোন এক ব্যক্তিকে, তার পর থেকে সে ব্যক্তির আর সন্ধান মেলেনি।
এই অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এই সিদ্ধান্ত করা যায় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু যদি সেই রাজাকারটির বিরুদ্ধে মামলা চলে দালাল আইনে, তবে তার বিরুদ্ধে আনা যাবে না হত্যার অভিযোগ। অভিযোগ আনা হবে হত্যার জন্যা অপহরণ করা হয়েছে। কারণ এভিডেন্স অ্যাক্টে হত্যার চাক্ষুষ সাক্ষ্য প্রমাণ না এনে খুনের অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং এক্ষেত্রে যদিও লোকটি খুন হয়েছেন তবুও আইনের মার-প্যাচে আসামীকে খুনী প্রমাণ করা যাবে না।
’
বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয় এ বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য। ৪ আগস্ট ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভা সাব কমিটির এক বৈঠকে অপরাধীধের সর্বোচ্চ শাস্তি দানের বিধান রাখার জন্য দালাল আইন সংশোধনের বিষয় নিয়ে আরোচনা করা হয়। তবে বৈঠকে কোন সদ্ধান্ত নেয়া হয় নি।
এইভাবে কালক্ষেপণের খেলা চলতে থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলই তত্কালীন আইন মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর গণহত্যাকারীদের সহায়তাকারীদের বিচারের জন্য রাষ্ট্রকে ক্ষমতা দেবার উদ্দেশ্যে আনীত সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেন।
বিলটিতে বাংলাদেশ সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে গণহত্যাকারীদের দোসরদের বিচার করার জন্য রাষ্ট্রকে নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেবার কথা বলা হয়।
(চলমান.....) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।