শিক্ষক জাতির বিবেক। আর ছাত্রছাত্রী আপন সন্তানের মত। শিক্ষক মিজানুর রহমান জীবন দিয়েছেন সন্তান সম ছাত্রীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। তার নিজ সন্তানের প্রতীক্ষা দেখে মনে হয় এ সন্তান আপনার বা আমার হতে পারতো। জাতির বিবেক কি কোন দিন জাগবে না ?
‘বাবা জুস আর চিপস আনতে গেছে।
আসছে না কেন বুঝতে পারছি না। এত লোক কেন আমাদের বাড়িতে? বাবা কখন আসবে? রাতে বাবার কাছে পড়তে বসব। রাত তো হয়েই গেল। ’ বিড় বিড় করে গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে কথাগুলো বলছিল নাটোরের লোকমানপুর কলেজের রসায়নের শিক্ষক মিজানুর রহমানের চার বছরের মেয়ে নুসাইবা রশিদ মম।
মমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল মিজানুরের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপুরে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়েছে। মম তখনো জানে না, তার বাবা আর কোনো দিনই তার জন্য জুস বা চিপস নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না। প্রতিদিনের মতো আর কখনোই তাকে পড়াতে বসবেন না। মমের মা (মিজানুরের স্ত্রী) রাজিয়া সুলতানাও রাত সোয়া নয়টা পর্যন্ত জানেন না, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই। জানেন না, শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) চিকিৎসকেরা মিজানুরকে মৃত ঘোষণা করেছেন।
রাজিয়াকে যে গতকাল দুপুর থেকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তিনি হূদরোগ ও উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। মিজানুরের মা জাহেরা বেগমকেও (৬৫) ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি।
বন্ধ হয়ে গেছে হূৎপিণ্ড: ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বখাটে আসিফ ও রাজন ১২ অক্টোবর নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজের রসায়নের প্রভাষক মিজানুর রহমানের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেয়।
তাঁর মাথা, বুক ও চোখে গুরুতর আঘাত করে। প্রথমে বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মিজানুরকে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৪ অক্টোবর বিএসএমএমইউর আইসিইউতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ২০ অক্টোবর চিকিৎসকেরা তাঁকে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ঘোষণা করেন। এর পর থেকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে মিজানুরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল।
বিএসএমএমইউর আইসিইউর সহযোগী অধ্যাপক কামরুল হুদা গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিজানুর রহমানের হূৎপিণ্ড সচল থাকায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে হূৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ’
বিএসএমএমইউ হাসপাতালে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিজানুরের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর দেড়টার দিকে তাঁর লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চারঘাটের লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে রওনা হন ঢাকায় অবস্থানরত দুই ভাই।
মিজানুরের ভাতিজা আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আজ সোমবার সকাল আটটায় লোকমানপুর কলেজ প্রাঙ্গণে মিজানুরের প্রথম জানাজা হবে।
তারপর গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। কিন্তু যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ডাক দিয়ে গেছেন তিনি, তা কি ব্যর্থ হবে তাঁর প্রস্থানে? নিজের জীবন দিয়ে যে আদর্শের বীজ বুনে দিয়ে গেলেন, তাকে কি লালন করে না তরুণ প্রজন্ম? এমন প্রশ্নও ছিল মিজানুরকে চিরবিদায় জানাতে আসা সবার মধ্যে।
সবার গন্তব্য লক্ষ্মীপুর: গণমাধ্যমের সুবাদে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা মিজানুরের অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী জেনে ফেলে, মিজানুর আর নেই। প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখতে গতকাল দুপুর থেকে বাগাতিপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষের গন্তব্য ছিল লক্ষ্মীপুর গ্রামে মিজানুরের বাড়ি। লোকমানপুর কলেজ থেকে লক্ষ্মীপুর গ্রামের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার।
বিকেলে মিজানুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকার্ত হাজারো মানুষ। স্তব্ধ হয়ে আছে সবাই। সবাই জানে, মিজানুর নেই। জানে না শুধু মিজানুরের ছোট্ট মেয়ে, অসুস্থ মা ও স্ত্রী।
রাস্তার দুই পাশে বড় বড় আমবাগান আর ধানখেতের মধ্য দিয়ে মিজানুরকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স যখন বাড়িতে পৌঁছায়, তখন রাত সোয়া নয়টা।
সপ্তাহের পাঁচ দিন তিনি এই পথেই মোটরসাইকেলে করে লোকমানপুর কলেজে যাতায়াত করতেন। সর্বশেষ ১২ অক্টোবর সকালেও তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে কলেজে গিয়েছিলেন। এরপর আর ফেরা হয়নি। অবশেষে ফিরলেন, তবে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ হয়ে।
মিজানুরের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছামাত্র মানুষের আহাজারি শুরু হয়।
ভুল ভাঙে তাঁর বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ের। প্রিয়জনের নিথর মুখটা দেখে আর সইতে পারলেন না। স্বজনদের আহাজারিতে হাজার হাজার মানুষ ডুকরে কাঁদতে শুরু করলেন। একসময় সবাই থামলেন, থামলেন না প্রিয়জনেরা। মেয়ে মম তখনো বলছে, ‘আমার বাবার কী হয়েছে? আমি বাবাকে নিয়ে ঈদ করতে নানাবাড়ি যাব।
বাবা আমার জন্য দুইটা ঈদের পোশাক কিনে দিয়েছে। বাবা ঘুমিয়ে আছে কেন?’
মিজানুরের ভাই মামুনুর রশিদ উপস্থিত সবার কাছে জানতে চান, ‘শিক্ষক হয়ে আমার ভাই কি তাঁর ছাত্রকে ইভ টিজিংয়ের জন্য শাসন করে অন্যায় করেছেন। তা না হলে ওরা তাঁকে মারল কেন? তাহলে কি এখন থেকে কোনো শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে শাসন করবে না। ’
সহোদর হারুন উর রশিদ (ব্যাংকার) বলেন, ‘আমার ভাই অন্য চাকরি করতেন। তিনি ছাত্র পড়াতে পছন্দ করেন বলে ওই চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন।
এটাই তাঁর জীবনের কাল হলো। ’
এদিকে শিক্ষক মিজানুরের মৃত্যুতে লোকমানপুর কলেজ ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। লোকমানপুর রেলস্টেশন, বাজার ও কলেজে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নাটোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক সুলতান আবদুল হামিদ গতকাল লোকমানপুর এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরে তিনি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা শান্ত রাখার তাগিদ দিয়ে বক্তব্য দেন।
বখাটে আসিফ জেলহাজতে: বাগাতিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সালাম বলেন, শিক্ষক মিজানুরের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসিফকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আজ সোমবার তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। একই সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। এ ছাড়া অপর আসামি রাজনকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন: মিজানুরের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গতকাল মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ স্টুডেন্টস ফোরাম, আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রুরাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি যৌথভাবে মানববন্ধনের আয়োজন করে। বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ইভ টিজিং প্রতিরোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের শোক: মিজানুরের মৃত্যুতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন গতকাল শোক প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি এক বিবৃতিতে বলেছে, ইভ টিজিং প্রতিরোধে দেশে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা এবং জনসচেতনতার অভাবে এ অপরাধের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মিজানুরের ওপর হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন সমিতির নেতারা।
এ ছাড়া প্রথম আলো অনলাইনের প্রচুর পাঠক, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি মানিকগঞ্জ জেলা শাখা, সিলেট লেখক ফোরাম, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরাম মিজানুরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন। সেই সঙ্গে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
সূত্র : Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।