আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের নতুন চক্রান্তমূলক তত্পরতা বদরুদ্দীন উমর

মানুষের সমাজে এক মুহূর্ত বাঁচতে চাই

বাংলাদেশকে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী গাঁটছড়ায় আরও মজবুতভাব বেঁধে রাখার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা এক নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ ধরনের যে কোনো উদ্যোগকে দুই হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাতে উদগ্রীব ও প্রস্তুত বাংলাদেশ সরকার সাম্রাজ্যবাদের এই সর্বশেষ উদ্যোগকেও স্বাগত জানিয়েছে। শুধু স্বাগত জানিয়েছে তা-ই নয়, এ ব্যাপারে যা কিছু করণীয় তার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা পালন করার সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় ঢাকায় একটি আঞ্চলিক কাউন্টার টেররিজম সেন্টার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের বিষয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য গোটা দক্ষিণ এশিয়া থেকে লোকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা এই প্রস্তাবিত সেন্টারে করা হবে।

বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের রাষ্ট্রদূত ডক্টর স্টিফেন ফ্রাউয়েন বলেন, এই আন্তর্জাতিক কেন্দ্রটি আগামী বছরের প্রথম দিক থেকেই তার কার্যক্রম শুরু করবে। (ডেইলি স্টার, ২০.১০.২০১০) ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞরা তদন্তকারী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। তিনি আরও বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো বাংলাদেশে এই কাউন্টার টেররিজম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। বাংলাদেশকে এর জন্য নির্বাচন করা হয়েছে এ কারণে যে সব ধরনের সন্ত্রাস নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাছাড়া জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের লাইনকে সমর্থন করাও এর অন্যতম কারণ।

তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৫ লাখ ইউরো বরাদ্দ করা হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং অন্য কয়েকটি দেশ থেকে নিরাপত্তা কর্মী, তদন্তকারী, পুলিশ কর্মচারী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা প্রশিক্ষণের জন্য এই কেন্দ্রে আসবে। ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের এক বৈঠকের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ফ্রাউয়েন বলেন, এই বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে জ্বালানি, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি, মানবাধিকার ও সন্ত্রাসবিরোধিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। (ডেইলি স্টার, ২০.১০.২০১০) ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূত কাউন্টার টেররিজম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ছাড়াও অন্য একটি বিষয়ের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ শিগগিরই ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘এশিয়া-ইউরোপ মিটিং’ (অঝঊগ) নামক সংস্থাটির সদস্য হতে যাচ্ছে।

এর মাধ্যমে সব পর্যায়ে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সম্পর্ক যাতে গভীরতর হয় সেটাই করা হবে। অঝঊগ হলো একটি আন্তঃআঞ্চলিক ফোরাম যার সদস্য হলো ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ এবং অঝঊঅঘ-এর ১৪ সদস্য দেশ। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এর কাজ হবে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যদের মধ্যে নিয়মিত আলাপ-আলোচনার জন্য একটি ব্যবস্থার কথা বলেছেন। এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য তাদের মতামত তারা দিয়েছেন।

(ঐ) এসব উদ্যোগ থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই কত গভীরভাবে গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত হয়েছে এবং এই চক্রান্তের শরিক হিসেবে সবকিছু করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বাংলাদেশে আঞ্চলিক কাউন্টার টেররিজম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্য এক মারাত্মক বিপজ্জনক ব্যাপার। বাংলাদেশে এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের কোনো প্রয়োজন নেই এ কারণে যে, এখানে এমন কোনো রাজনৈতিক সন্ত্রাস নেই যা দমন করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত কোনো সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসবিরোধী তত্পরতার প্রয়োজন আছে। সত্য কথা স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, বাংলাদেশে অরাজনৈতিক অনেক ধরনের সন্ত্রাসী তত্পরতা দেখা গেলেও রাজনৈতিক সন্ত্রাস যা দেখা যায় তার মূল চালিকাশক্তি হলো খোদ বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশে এখন সরকারি পর্যায়ে যেভাবে রাজনৈতিক সন্ত্রাস করা হচ্ছে এর কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত নেই।

সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি তো আছেই। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল সন্ত্রাসী শক্তি হলো আওয়ামী লীগ দল ও তাদের সরকার। এ পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এ কারণে যে, শুধু তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নয়—সরকারি দলের এমপি, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত খোলাখুলি ও বেপরোয়াভাবে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের উস্কানি দিচ্ছেন, তাকে উত্সাহ প্রদান করছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সরকারের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধিতার সঙ্গে জড়িত করে আমাদের দেশকে অস্থিতিশীল করার এক চক্রান্তই প্রকৃতপক্ষে কার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। এর জন্য তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্য এখন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে চক্রান্ত চালাচ্ছে।

১৯ অক্টোবরের উপরোক্ত বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা এদিক থেকে তাত্পর্যপূর্ণ। ভারতে এখন মাওবাদীরা নিজেদের লাইনে কাজ করছে এবং সরকারের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হচ্ছে। কাশ্মীরের জনগণ ভারতের চরম নির্যাতন ও সামরিক শাসনের মুখে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চলছে। এসব রাজনৈতিক আন্দোলনকেই ভারত সরকার সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্টসুলভ তত্পরতা জারি রেখেছে।

বাংলাদেশে যে আঞ্চলিক কাউন্টার টেররিজম কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা এখন হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদিতে যে রাজনৈতিক আন্দোলন সেখানকার সরকার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে, তার মোকাবিলা করা। বাংলাদেশ কেন এই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের সঙ্গে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সহচর প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিজেকে জড়িত করবে, এ প্রশ্ন এদেশের জনগণ অবশ্যই করতে পারেন। তারা সরকারের কাছে জবাবদিহি চাইতে পারেন, কেন তারা এ ধরনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করবে, কেন তারা ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোনো আঞ্চলিক দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করে নানা সঙ্কটে জর্জরিত এই দেশ ও জনগণকে আরও বিপজ্জনক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ঠেলে দেবে? ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের যোগদানের কথাও বলা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্যোগে গঠিত এ ধরনের বিভিন্ন সংস্থার চরিত্র কী, কোন উদ্দেশ্যে এগুলো গঠিত হয়—এটা এখন আর কারও অজানা নয়। কাজেই বাংলাদেশ কেন এ ধরনের সংস্থারই-বা সদস্য হবে, এর জবাবদিহিতাও সরকারকে করতে হবে।

এমনিতেই যেখানে আমাদের সমস্যার অন্ত নেই, যেখানে আমরা এসব সমস্যার কোনো সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থা এখনও দেখি না, সেখানে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে এ ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে কেন আমরা জড়িত হব? কেন আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যার সঙ্গে জড়িত হয়ে নিজেদের সঙ্কট বৃদ্ধি করব? এসবের কোনো সঙ্গত ও গ্রাহ্য যুক্তি নেই। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী একটি ফ্যাসিস্ট সরকার হিসেবে আমাদের এই দেশের স্বার্থ এখন মার্কিন এবং ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের খেদমতে জলাঞ্জলি দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছে। শাসক শ্রেণীর কোনো অংশেরই ভাঁওতাপূর্ণ কথাবার্তা বা তথাকথিত কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের এবং সাম্রাজ্যবাদীদের এই চক্রান্তের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এই চক্রান্তের মোকাবিলা এবং এই জনশত্রুদের শক্তি নির্মূল করা একমাত্র জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমেই সম্ভব। এটাই এখন এদেশের শ্রমজীবী ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন জনগণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি কর্তব্য।

[সূত্রঃ আমার দেশ, ২১/১০/১০]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.