শোকের মাসে সুখের খবর পাওয়া যেন সত্যিই দুষ্কর হয়ে গেছে। আগস্ট এমনিতেই দেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে। তিন দিন আগে সেই কালো তালিকাটা যেন আরও দীর্ঘ হলো। ১৩ আগস্ট ঢাকার হোটেল রেডিসনে আনুষ্ঠানিকভাবে কলঙ্কিত হলো মানুষের একমাত্র আস্থার প্রতীক ক্রিকেট। বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে নয় জনকে অভিযুক্ত করল আইসিসির নিরাপত্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশন (আকসু)।
কলঙ্কের নায়ক নয় জনের মধ্যে ছয় জনই বাংলাদেশি। দেশের জন্য কলঙ্ক বয়ে আনায় ভক্তরা অভিযুক্ত ক্রিকেটারদের ধিক্কার দিচ্ছেন, ছি-ছি করছেন। কঠিন শাস্তি দাবি করছেন। ভক্তরা মনে করছেন, ক্রিকেটারদের কোনো ক্রমেই এমন অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত হওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু দেশের কোনো ক্রিকেটার না থাকলেও কি কালিমা থেকে রেহাই পেতাম আমরা, মোটেও না! যেখানে খোদ ক্লাবের মালিকই জড়িত সেখানে ক্রিকেটারদের আর কি-ইবা বলার আছে?
আকসুর তদন্ত প্রতিবেদনে বিপিএল ক্লাব ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের মালিক সেলিম চৌধুরী ও তার ছেলে শিহাব চৌধুরীর নাম এসেছে।
কিন্তু এ অভিযোগ বার বার অস্বীকার করছেন বাবা-ছেলে দুইজনই। অথচ আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন সংবাদ সম্মেলনে বার বার বলেছেন, তারা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সতর্কতার সঙ্গে দীর্ঘ ৫ মাস ধরে অনেকের সঙ্গে কথা বলেই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের মালিক চার্জশিট পাওয়ার পর আইসিসির কর্মকাণ্ড নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি ক্ষমতা থাকলে তিনি আইসিসি-কে দেখে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন।
এটা তো ঠিক যে বিপিএলে ফিক্সিং হয়েছে।
৪ জুন মোহাম্মদ আশরাফুলের স্বীকারোক্তির পর বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। অ্যাশ মিডিয়াকে বলেছেন, ২ ফেব্রুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারি ম্যাচ দুটিতে মালিকদের ইচ্ছাতেই ফিক্সিং করতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের মালিক প্রথম দিকে বলছিলেন, আশরাফুল কোন উদ্দেশ্য নিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আর এখন বলছেন, 'আশরাফুল জড়িত থাকতেই পারেন। মাঠে কি হয় না হয় তাতো মালিকের জানার কথা নয়।
'
এখানে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, এ কথা তো কারোর অজানা নয় যে, বিপিএলের মতো ব্যবসানির্ভর ক্রিকেট লিগে মালিকের কথা বাইরে এক চুলও এদিক-সেদিক হওয়ার উপায় নেই। খেলোয়াড় তো দূরের কথা কোচ, ম্যানেজাররাও মালিকদের কথার বাইরে কিছু করতে পারেননি। যেহেতু মালিককে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়, তাই সোজা কথায় সবাইকে মালিকের গোলাম হয়ে থাকতে হয়! তাছাড়া নিলাম পদ্ধতি নিয়েও তো অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। এই সভ্য যুগে কী সেই বর্বর যুগের মতো ক্রীতদাস কেনার কায়দায় দেশ-বিদেশের সেলিব্রেটিদের (তারকা ক্রিকেটার) কেনা মানায়! লিগ শুরুর প্রক্রিয়া থেকেই সর্বেসর্বা মালিকরা।
তাই মালিক জড়িত না থাকলেও তো খেলোয়াড়রা জড়িয়ে পড়লে সেই দোষে দোষী হওয়ার কথা! তাছাড়া আকসু সরাসরি অভিযোগ এনেছে সেলিম চৌধুরী ও শিহাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয়ত, ২ ফেব্রুয়ারি এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে চিটাগং কিংসের বিরুদ্ধে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের ম্যাচের দর্শকরাই তো ফিক্সিংয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী! হঠাৎ করে ম্যাচের পূর্ব মুহূর্তে মাশরাফির পরিবর্তে আশরাফুল অধিনায়ক। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ঢাকার ইচ্ছা করে হারার বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। ম্যাচপরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও সেদিন ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের কোনো খেলোয়াড় আসেননি। অনেকে মনে করছেন, যদি সেলিম চৌধুরী নির্দোষ হবেন, তবে সেদিনের ম্যাচ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কেন?
তৃতীয়ত, আকসুর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী মোহাম্মদ আশরাফুলের পাঁচ বছর থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হওয়ার কথা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের এতো বড় তারকার কি এমন স্বার্থ রয়েছে যে, তিনি মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়ে আজীবন নিষিদ্ধ হবেন! সেলিম চৌধুরীই বা আশরাফুলের কি এমন ক্ষতি করেছেন যে কারণে তাকে ফাঁসাতে হবে? তাছাড়া মোহাম্মদ আশরাফুল যেভাবে মিডিয়ার সামনে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, আবার ক্রিকেটে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন, এরপর আর বলার কিছু থাকে না।
একজন মালিককে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখলেও তার খুব বেশি কিছু যায় আসে না, তার খুব বেশি ক্ষতিও হওয়ার কথা নয়। অথচ এটিই একজন ক্রিকেটারের জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি। আর সেই শাস্তি বোধহয় পেতে যাচ্ছেন আশরাফুল-রুবেল-রবিনরা। তাহলে যাদের নির্দেশে তারা কাজটি করেছেন তাদের কী আরও কঠোর শাস্তি পাওয়ার কথা নয়! অবশ্য এটি ট্রাইব্যুনালের ব্যাপার।
তবে সেলিম চৌধুরী যদি সত্যিই নির্দোষ হন, তিনি ১৪ দিনের মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য আপিল করতে পারেন। অযথা আইসিসি-কে হুমকি-ধামকি দেওয়ার কি প্রয়োজন! তাছাড়া আইসিসি তো আর স্বেচ্ছায় আসেনি, বিসিবি তদন্তে স্বচ্ছতার স্বার্থে আকসুকে ডেকেছিল। ক্রিকেটামোদীদের আশঙ্কা- এমনিতেই ফিক্সিং দেশের ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছে, আবার সেলিম চৌধুরীর এমন বাড়াবাড়ি মন্তব্য না জানি আবার কোনো বিপদ ডেকে আনে!
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।