. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
রবীন্দ্রনাথ কাছের মানুষদের সব সময় লেখার জন্য উৎসাহ, প্রেরনা দিতেন। কখনো জোর করতেন। রানী চন্দকে যেমন করেছিলেন। বলেছিলেন, “ গল্প কবিতা না লিখিস, এই যে আমায় কাছ থেকে দেখছিস, এ সবই নাহয় লিখে রাখ রানী। সময় নষ্ট করিস নে”।
কবির সে মরিয়া স্বরের মাঝে যেন কোনো নির্দেশ খুঁজে পেয়েছিলেন রানী।
জোড়াসাঁকোয় থাকাকালীন সময় পাশের বাড়ী থেকে রোজ সকাল বিকেল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির খোঁজ খবর নেবার জন্য আসতেন। দশ বছরের ছোট অসম্ভব গুনী এই ভাইপোটি কবির অনেক আদরের ছিলো।
খোঁজ নিতে এলেও অবনীন্দ্রনাথ কখনও কবির রোগ-শয্যা পাশে যান নি। কেউ জোর করলে বলতেন, “ রুগ্ন সিংহ বিছানায় পড়ে আছে, সে দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারবো না”।
একদিন ‘বিচিত্রা’ হলে বসে স্মৃতি-কাতর অবনীন্দ্রনাথ আপন মনে অনেক কথা বলেছিলেন। রানীর মনে হয়েছিলো, পাথর সরিয়ে এক অপুর্ব ঝর্না ছুটে এসেছে চোখের সামনে। নিজের সৌভাগ্যে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন তিনি। বিদায়-বেলায় ঘুরে দাঁড়িয়ে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ রানী, কত কথা এসে গেলো আজ। অনেকে জিজ্ঞেস করে, কাউকে বলতে পারিনে কিছু।
এই সব কথা তুমি নষ্ট করনা। ধরে রেখ কিন্তু”।
কবির ঘরে রাত-প্রহরার সময় লন্ঠনের মৃদু আলোয় পর পর সব লিখে রেখেছেন রানী। অবনীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন, হুবহু ঠিক তেমনি করে। ভেবেছিলেন কোন ভালো লেখক এই নোট দেখে ভালো লেখা তৈরী করবে।
কবির কাছ থেকে লেখার তাড়া খেয়ে অনতি-অতীতের এই ঘটনা কবিকে খুলে বলেন রানী।
এখন রবীন্দ্রনাথ যেন পাতা ঝরা বৃক্ষ। প্রকৃতির নিয়মে ক্ষত নেমেছে সর্বাঙ্গে। কিন্তু চোখদুটি আজও আগের মত উজ্জ্বল। রানীর কথা শুনে মুহুর্তে সে চোখে বিদ্যুত খেলে গেলো।
ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন সে লেখা দেখবার জন্য। ছুটে গিয়ে পাশের কোনার্ক থেকে কাগজগুলি এনে দিলেন রানী। গোগ্রাসে পড়তে লাগলেন কবি। দু’চার পাতা পড়ার পরিশ্রমেই ঘেমে উঠলেন তিনি। ভয়ার্ত রানীর মৃদু আপত্তি কবির কানে পৌঁছুলো না।
মুখ লাল হয়ে গিয়েছে, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, চেহারায় হাসি-কান্না খেলা করছে। সে এক দৃশ্য!
যে জীবন ফেলে এসেছেন, শেষ বেলায় তাকে ফিরে দেখতে গিয়ে কবি আবেগে ভেসে গেলেন। তাঁর নির্বিকার ভাবটি একটু সময়ের জন্যও যে বদলে গেলো, তাতেই তো প্রকাশিত হয় তিনিও মানুষ। সাধারন মানুষ যাকে দেবতার আসনে বসিয়েছে। র-বী-ন্দ্র-না-থ এই ভাবমুর্তির আড়ালে একলা বাঁচে ক্ষত-বিক্ষত যে বাউল মানুষটি, তাঁকে যে নিয়ত কত মূল্য দিতে হয়েছে, তা উপলব্ধি করেছে ক’জন ভক্ত?
প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ একটু একটু করে পড়েন অবনীন্দ্রনাথের মুখে বলা গল্পগুলি, আর উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন।
মন হারিয়ে যায় অবনের লেখার সময়ের মাঝে। যাবার বেলা এক লহমা যেন নিজেকে ফিরে দেখা- সেই স্বদেশী উন্মত্ততা... বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন... কত গান... রাখী... সে যুগ কেটে যাবার পর শান্তিনিকেতন। আসবাব-পত্রহীন, খেড়ো, মাটির ঘর... সে সংগ্রাম... অবনীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে রবীন্দ্রনাথকে এ ভাবে তুলে ধরবে? পুত্র রথীন্দ্রনাথকে ডেকে লেখাগুলি প্রেসে পাঠাতে নির্দেশ দিলেন।
এক সকালে রবীন্দ্রনাথ আপনমনে কত কিছু বলে যেতে লাগলেন। ক্ষীন কন্ঠস্বর, জড়ানো উচ্চারন।
রানী চন্দ যতটা পারলেন লিখে নিলেন। স্রোতের মত বলে যাওয়া কথা লেখায় ধরে রাখা কঠিন। বলছেন, “ মেয়েরা যে শুধু শুশ্রুষা করে তা তো নয়, একটু বেশীই পাই- তা হল সান্তনা। বয়স বেশী হলে মনটা যে এমন শিশু হয় তা এখন বুঝতে পারি, কারন মায়ের স্নেহ পেতে ইচ্ছে করে। এই বয়সে না পৌঁছলে এই এক্সপেরিয়েন্সটা আমার হতো না।
মামনি( প্রতিমা দেবী ) কোন কারনে এখানে না থাকলে নিজেকে মাতৃহীন অসহায় মনে হয়”।
জীবনের সেই সব দিনগুলো, যা কেবল কল্পনা আর সৃজনে কাটত, সেসব আচ্ছন্ন করে রেখেছে কবির শেষ বেলার মন। ক-ত দূর উড়ে এসে পাখীর এখন মনে পড়ছে কবেকার সেই ফেলে আসা আকাশ।
বড় মানুষের কান্না থাকে গোপনে, গভীরে। সহজ সরল যে শিল্পী-জীবনটা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন, আর কোন দিনও যে জীবনের কাছে পৌঁছানো হয়নি, তাকে যখন উচ্চারন করেন, সে এক রকম কান্নাই।
ঘোর লাগা স্বরে কবি বলেন, “ শিলাইদহের দিনগুলি... বোটে বসে ঋতুর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা... ধুধু বালু চর... উড়ে যাওয়া হাঁসের ঝাক। কথা বলেন থেমে থেমে। অনেক কথা মনে পড়ে না। অধৈর্য হয়ে শ্রোতাকেই বলেন, “ আঃ বলো না, কি বলতে যাচ্ছি”। অপকট সিকারক্তির মত জানান, “ যদি এখন কেউ এসে বলে- রবীন্দ্রনাথ, তোমার এই দন্ড-মুকুট খসিয়ে নিয়ে যদি তোমাকে শিলাইদহের অখ্যাত দিনগুলি শুধু ফিরিয়ে দিয়ে যাই, রাজি হবে? তখন কিন্তু আমি বলব, ‘না’।
এই খ্যাতি, এই সন্মান, এই দায়ভার, এসবের মোহ আমার নেই, সে কথা তো মিথ্যে। এটাও চাই, ওটাও চাই। মানুষের মন কি বিচিত্র! কি মজার”!
ওষুধ-পত্র সব সহকারী কমলাকান্তকে বুঝিয়ে দিয়ে বিমলানন্দ কলকাতা ফিরে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ধৈর্য হারিয়ে কিছুক্ষন পর পরই ছোট কবিরাজকে খবর দেন। তার আসতে একটু দেরী হলেই কবির মেজাজ রুক্ষ হয়।
যত এমনটি হচ্ছে, তত প্রমাদ গুনছেন কাছের মানুষেরা। অপারেশনের তারিখ স্থির করার জন্য কলকাতা যাবার আগে রথীন্দ্রনাথ বাবার সাথে দেখা করতে তাঁর ঘরে এসেছিলেন। কি করে যেন ব্যাপারটা আন্দাজ করে কবি পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ রথী, কবিরাজ তো খুবই আশাবাদী তাঁর ওষুধেই আমাকে ভালো করে তুলবেন, তবে একটু সময় লাগবে। আহঃ বাঁচি, যদি কাটা-ছেঁড়া না করতে হয়”। গম্ভীর চিন্তিত মুখে রথীন্দ্রনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
দৃশ্যটা সহ্য করা তাঁর পক্ষে খুবই কঠিন। কোন দিনও বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেন নি। কিন্তু এখন বাবার জীবন-মরন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। আর তিনি তো শুধু তাঁর বাবা নন। কবি এখন দেশবাসীর, বিশ্বের।
সবাই তাঁর দ্রুত আরোগ্য চান। পরিনত বয়সের কবিকে তাঁরা বাঁচিয়ে রাখতে চান আরও অনেক দিন। একমাত্র ডাক্তার নীলরতন সরকার ছাড়া সব ডাক্তাররাই অপারেশনের পক্ষে। বাবার মনোভাব রথীকে বিচলিত করলেও আশু কর্তবকে স্মরন করে কলকাতা যাত্রা বাতিল করলেন না রথীন্দ্রনাথ।
রথীন্দ্রনাথ কলকাতা চলে যাওয়ার পর বিমর্ষ কবি ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে পড়লেন।
হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। কলকাতা থেকে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ছুটে এলেন।
রাতে প্রবল আচ্ছন্নতার মাঝে কবি বিড়বিড় করছিলেন। শিয়রে বসে থাকা রানী মহলানবিশ চমকে উঠে তা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। অস্পস্ট জড়ানো কথা...... আওয়াজ ক্ষীন... সবটা ধরে রাখতে পারলেন না রানী।
হঠাত করে কবি সজাগ হলেন। “ লিখে নিচ্ছিলে? ও কিছু না। এমনি মনে এলো, তাই বলে গেলুম।
...... দাও এবারে গুলকুশ খাওয়াও একটু। আমার লীলমনি ভালো নাম দিয়েছে- গুলকুশ(গ্লুকোজ)”।
সকালে লিখলেন কবিতা। তাঁর মনে ছিল সবটাই। নিজের জীবনের শেষটুকু নিজেই নির্মান করেছেন এ ভাবে। জীবনের শেষ পর্বের সঙ্গিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এ কবিতায়।
“বহু লোক এসেছিলো জীবনের প্রথম প্রভাতে
কেহ বা খেলার সাথী, কেহ কৌ্তুহলী,
কেহ কাজে সঙ্গ দিতে, কেহ দিতে বাধা।
আজ যারা কাছে আছে এ নিঃস্ব প্রহরে,
পরিশ্রান্ত প্রদোষের অবসন্ন নিস্তেজ আলোয়
তোমার আপন দ্বীপ আনিয়াছ হাতে,
খেয়া ছাড়িবার আগে তীরের বিদায়-স্পর্শ দিতে।
তোমরা পথিক বন্ধু,
যেমন রাত্রির তারা
অন্ধকারে লুপ্ত-পথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষনে”।
চলবে...।
সুত্রঃ বাইশে শ্রাবন/ বিভাস রায়চৌধুরী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।