. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
প্রচন্ড গরমের কারনেই শান্তিনিকেতনে বৈশাখ মাসে গ্রীস্মের ছুটি দেওয়া হত। আর সে কারনেই পয়লা বৈশাখ পালিত হত গুরুদেবের জন্মোৎসব। জীবনের শেষ জন্মদিন ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ অনাড়ম্বর, ঘরোয়া ভাবে পালিত হল। শেষ জন্মদিন পালনের মুহুর্তে যে গান বাঁধলেন, তাতে ফুটে উঠলো অনাবিল জীবনাকাংক্ষা।
“ হে নতুন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষনে শেষ জন্মদিনে”।
জন্মদিন উপলক্ষে অভিনিত “বশীকরন” নাট্টাভিনয়ের বিশেষ আকর্ষন ছিল, কবিগুরুর পুরাতন ভৃত্য বনমালীর অভিনয়। কবি যাকে আদর করে লীলমনি বলে ডাকতেন। বনমালী ভৃত্যর ভূমিকাতেই মঞ্চে এলেন। ‘হ্যা মা’; ‘যাই মা’ জাতীয় টুকরো সংলাপ আর জলখাবার পরিবেশন করা ইত্যাদি ভালভাবেই মঞ্চে করলেন তিনি। সবার মনে হল, বনমালী এ ভাবেই যেন কবিকে খুশী করে শ্রদ্ধার অর্ঘ তুলে দিলেন কবির পায়ে।
অভিনয় শেষে কবির পাশে গিয়ে দাড়াতেই সারা মুখে কৌ্তুক ছড়িয়ে কবি বললেন, “তোর তো বেশ ভালোই হয়েছে রে”। অন্যদের উদ্যেশ্যে বললেন, “আমার লীলমনির কত গুন তোমরা দেখেছো? বাঁদরটা আমার কাছে থেকে থেকে নাটক করতেও শিখে গেলো”।
পয়লা জুলাই রথীন্দ্রনাথের চিঠি পেলেন প্রশান্তচন্দ মহলানবিশ। তাতে লেখা-
“বাবার শরীর খুবই খারাপ হয়ে গেছে। রোজ রাতেই ১০০.৪ ডিগ্রি জ্বর উঠছে।
ইউরিন এক একদিন খুব কম হচ্ছে। ব্লাডার বেশ বড় হয়ে গেছে। ডাঃ জিতেন বাবু অপারেশনের জন্য তাড়া দিচ্ছেন। এতো দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে সব সময় শুয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই বিশেষ রকম চিন্তিত হয়ে পড়েছি।
চিঠি পড়েই প্রশান্তচন্দ স্ত্রী রানীকে নিয়ে শান্তিনিকেতন রওনা হলেন। রবীন্দ্রনাথ সারাদিন শুয়েই কাটান। ক্লান্ত, অবসন্ন। তবুও অপারেশনে মত দিচ্ছেন না। কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থের উপর কবির অনেক ভরসা।
সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তিনি আগের চাইতে অনেক সুস্থ-বোধ করছেন। কিন্তু জ্বর কিছুতেই একশোর নিচে নামছে না।
সন্ধ্যার পর বারান্দায় এনে কবিকে বসানো হয়। মাঝে মাঝে ক্ষীন কন্ঠে গল্পের প্লটও বলছেন দু’একটা। সেগুলো লিখে নেয়া হচ্ছে।
এ রকমই একটি গল্প, “বদনাম”।
বারান্দার বাইরে অন্ধকারে দৃষ্টি ভাসিয়ে দিয়ে কবি ধ্যান-মগ্ন হন। কত অনুভুতির প্রবাহ বয়ে যায় শুন্যে-মহাশুন্যে। চোখের সামনে ডাকঘর নাটকেরর শেষ দৃশ্য ভেসে উঠে।
সুধাঃ অমল।
রাজকবিরাজঃ ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
সুধাঃ আমি যে ওর জন্য ফুল এনেছি- ওর হাতে কি দিতে পারবো না?
রাজকবিরাজঃ আচ্ছা, দাও তোমার ফুল।
সুধাঃ ও কখন জাগবে?
রাজকবিরাজঃ এখনই, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।
সুধাঃ তখন তোমরা ওকে একটি কথা কানে কানে বলে দেবে?
রাজকবিরাজঃ কি বলব?
সুধাঃ বোলো যে, ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি’।
কবি আপন মনে বলতে থাকেন, ‘সুধা তোমাকে ভোলেন নি... ‘সুধা তোমাকে ভোলে নি...।
আষাঢ়ের মেঘ এসেছে জীবনে শেষবার। সেই রুপ দেখবার জন্য রবীন্দ্রনাথ অস্থির হয়ে উঠলেন। প্রতিমা দেবী তাঁকে উত্তরায়নের দোতলায় আনার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তিনি জেদ ধরে বসে রইলেন, এই বিশেষ অনুগ্রহ তিনি নিবেন না। কাউকে বিব্রত করবেন না।
অনেক পীরাপীড়ি, অনুরোধ করে তাঁকে রাজি করানো হলো।
একদিন ঝরঝর করে তাঁর ক্লান্ত চোখের সামনে বৃষ্টি নামলো। তপ্ত, গনগনে গেরুয়া মাটির সাথে কবির তৃষিত হৃদয় সিক্ত হয়ে নতুন প্রানের সঞ্চার পেলো।
ডাক্তার রামচন্দ্র অধিকারী, ডাক্তার জিতেন্দ্রনাথ দত্ত, ডাক্তার ইন্দুভুষন বসু, ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়’রা নিজেদের মাঝে পরামর্শ করে রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিয়েছেন, “আর দেরী করা চলেনা। অপারেশন ছাড়া আর কোন উপায় নেই”।
কোন আলোচনা তাঁর সামনে না হলেও প্রখর ইন্দ্রিয় দিয়ে কবি অনুমান করে নেন। বিষন্ন মনে কবিরাজ বিমলানন্দকে ডেকে বলেন,--
“ সবাই তো শরীরটা কাটা-ছেঁড়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। দাওনা একটু ভালো ওষুধ। সেরে যাই”। বিমলানন্দ বলেন, “ আমি সর্বান্তঃকরনে চেষ্টা চালাচ্ছি”।
বিমর্ষ কবি বলেন, “ কোন না কোনও ভাবে এই শরীরের তো শেষ হবে। তা এ ভাবেই হোক না কেনো! কি ক্ষতি তাতে”?
কবিরাজ সান্তনা দিয়ে বলেন, “ আপনার যা মনের জোর, অবশ্যই ভালো হয়ে যাবেন। অপারেশনের প্রয়োজনই পরবে না”। উৎফুল্ল গলায় কবি বলেন, “ আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি না কবিরাজ”?
কিন্তু কবিরাজের সান্তনাবানীতে ডাক্তার ও রবীন্দ্র-পরিবার ভরসা করতে পারছেন না। তাঁরা বিখ্যাত অস্ত্র চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায়কে শিলং থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছেন ডাক্তার ইন্দুভুষন বসুকে।
ললিতবাবু পরীক্ষা করে দেখার পর অপারেশনের দিন-ক্ষন ঠিক করা হবে। জ্বর কমার জন্য অটোভ্যাকসিন দেয়া হবে।
কবিরাজ বলছেন, “ আপনার নাড়ি খুব ভালো দেখছি”। অন্যদিকে ডাক্তাররা বলছেন, “ সার্জারি ছাড়া আরোগ্য অসম্ভব”। অদ্ভুত পরিস্থিতির মাঝে রোগ-শয্যায় পড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ।
পালা করে সেবক-সেবিকারা সেবা করছেন। ডাক্তার দীননাথ চ্যাটার্জি কলকাতা থেকে চাকরী নিয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছেন। তরুন এই ডাক্তারের মূল দায়িত্ব হল কবির অবস্থা সম্পর্কে কলকাতার ডাক্তারদের ওয়াকিবহাল করা। রোজ নাড়ি দেখা আর জ্বর মাপা ছাড়া আর কোন চিকিৎসার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেননি। কিন্তু কবি স্নেহবসত তাঁকে নিয়ে অনেক মজা করতেন।
ডাক্তার নিজেও চাকরী ভুলে কবির সর্বক্ষনের সেবা-কর্মীদের একজন হয়ে পরেছিলেন।
চলবে......
View this link
সুত্রঃ বাইশে শ্রাবন/ বিভাষ রায়চৌধুরী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।