আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্তাচলের রবির আলো। (১)

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
কালিম্পং থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ফেরার পর কবিগুরুর শরীর ক্রমশ ভেঙ্গে পড়লো। কানে কম শোনেন। চোখের দৃষ্টি আবছা। প্রখরতা হারিয়ে রবির আলো যেন শান্ত হয়ে এসেছে। প্রখ্যাত চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের মত লোকও মত দিলেন অস্ত্রপচার করতেই হবে।

মুত্রাশয়ের গোলমালটা জটিল আকার ধারন করেছে। জাতির প্রয়োজনে বিশ্বকবির আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা দরকার। গোটা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধান্ধ আবহাওয়া। ভারতবর্ষেও স্বাধীনতার লড়াই বিচিত্র আকার ধারন করেছে। এই সন্ধিক্ষনে কবিগুরুর মৃত্যু-সম্ভাবনা কেউ মেনে নিতে পারছেন না।

জোড়াসাঁকোয় কবির রোগশয্যার পাশে গান্ধীজির চিঠি নিয়ে মহাদেব দেশাই উপস্থিত হন। স্বয়ং গান্ধীজির প্রার্থনা- “প্রিয় গুরুদেব, আপনাকে এখনও কিছুকাল বাঁচিতেই হইবে। বিশ্বমানবের জন্য আপনাকে প্রয়োজন”। চিনের প্রেসিডেন্ট-পত্নী মাদাম চিয়াং কাইশেক, নেহরুজি, উদয়শংকর, লর্ডবিশপ, অসগড়ের রাজা, সেরগুজার মহারাজা, নেপালের মহারাজা, বাংলার গভর্নর- গন্যমান্যদের মাঝে সবাই ব্যাকুল, সবাই চান রবীন্দ্রনাথের আরোগ্য। অপারেশনে কবি সম্মত নন।

কিছুটা সুস্থ হতেই তিনি জোড়াসাঁকো ছেড়ে শান্তিনিকেতনে ফিরে উদয়নে উঠলেন। অগনিত মানুষের ভিড় থেকে তাঁকে আড়াল করে রাখা ও নিরন্তর পর্যবেক্ষন, পরিচর্যার কারনেই তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসা। কারন চিকিৎসকেরা মনে করছেন, সামান্য উত্তেজনাও কবির জন্য চরম ক্ষতিকর। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি অনিল চন্দ বিবৃতি প্রকাশ করতে বাধ্য হন- “গুরুদেব আশ্রমে ফিরিবার নিমিত্ত অত্যধিক আগ্রহ প্রকাশ করায় এবং শান্তিনিকেতনের মনোরম পরিবেষ্টনী এবং সুখপ্রদ আবহাওয়া তাঁহার স্বাস্থ্যলাভের অনুকুল হইবে- চিকিৎসকগণ এইরুপ অভিমত প্রকাশ করায় তাঁহাকে এখানে আনা হইয়াছে। তিনি এখনো ঘরের বাহির হন না, এবং বর্তমানে তাঁহার নিয়মিত চিকিৎসা চলিতেছে।

তিনি আগন্তকগণের দেখা-সাক্ষাত করিতে অথবা নিজে চিঠিপত্রের উত্তর দিতে সক্ষম নহেন। সুতরাং, বন্ধুগণকে অনুরোধ করিতেছি, তাহারা যেন কবিগুরুর সহিত সাক্ষাত করিবার নিমিত্ত শান্তিনিকেতন না আসেন অথবা উত্তর পাইবার আশা করিয়া তাঁহার নিকট কোন পত্র না লিখেন। গৃহবন্দি কবির সৃজন কিন্তু থামেনি। “রোগশয্যা”র কবিতাগুলো এই সময়ই রচিত। কিছু জোড়াসাঁকোয় থাকাকালিন, বাকিগুলো লিখলেন শান্তিনিকেতনে ফিরে।

উৎসর্গ করলেন নন্দিতা ও অমিতাকে। নন্দিনি কৃপালিনি, কনিষ্ঠা কন্যা মিরাদেবীর কন্যা, আর অমিতা ঠাকুর বাড়ীর বধু, অজিতকুমার চক্রবর্তীর কন্যা। গুরুতর অসুস্থ কবিকে নিরলস সেবা করেছেন এই নন্দিতা, অমিতা। সেই সাথে অনিল চন্দ, রানী চন্দ, সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, সুরেন কর, রানী মহলানবিশ, মৈত্রয়ী দেবী, বিশ্বরুপ বসুর নাম উল্যেখযোগ্য। সবাই অবাক হয়ে দেখেছেন, যার জন্য দেশবাসী উদ্বিগ্ন, তিনি নিজের রোগ-যন্ত্রনা আড়াল করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করে চলেছেন।

ক্লান্ত গলায় হাসি-ঠাট্টা করে নিজেকে ভারমুক্ত করতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথ কারো কাছে সেবা নিতে সংকোচ বোধ করতেন। কিন্তু এখন অসহায় ভাবেই সব মেনে নিতে হচ্ছে। বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। অস্তাচলকে মানসচক্ষে যেন দেখতে পেতেন।

বলতেন, “মন ক্লান্ত হয়ে গেছে রে, এবার বিদায় নিলেই হয়”। জীবনের শেষ সাতই পৌষ ঘরের বাইরে যেতে পারেন নি। সাতই পৌষের ভাষনটি মুখে বলে গিয়েছিলেন, লিখে নিয়েছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। “আরোগ্য” নামে সেই বক্তব্যে বলেছিলেন, “আজ আমি রোগের দশা অতিক্রম করছি বলেই আরোগ্য কাকে বলে সেটা বিশেষ ভাবে অনুভব করি...”। জীবনের প্রতিটি পর্বকেই তিনি অর্থময়, ব্যঞ্জনাময় হিসেবে দেখেছেন।

শেষ বয়সের অসুস্থতাকেও দার্শনিক দিক থেকে দেখেছেন। ছোট্ট কবিতায় লিখলেন,- “ হেরি আমি আপন আত্মারে মৃত্যুর অতীত”। আত্বত্রুটি বিশ্লেষনে বরাবর অভ্যস্ত ছিলেন। শেষের দিকের কবিতায় বার বার প্রকাশ করেছেন নিজের অক্ষমতাকে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবির স্বীকৃতি পেয়েও রুগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে জীবনের শেষ শীত ঋতুতে লিখলেন- “ আমার কবিতা জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।

যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বানী লাগি কান পেতে আছি”। শেষ সময় সমাসন্ন উপলব্ধি করেই যেন কবি বিচিত্র রচনা-কার্যে মেতেছেন। “জন্মদিন” এবং “আরোগ্য” পর্যায়ের কবিতা লিখা ছাড়াও হাত দিয়েছেন শিশুদের দ্রুতপাঠ-উপযোগি সরস গ্রন্থ রচনায়, যা শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের পাঠগ্রন্থমালায় অন্তর্ভুক্ত হবে। “গল্পসল্প” নামের বইটিতে ষোলটি গল্প ও ষোলটি কবিতা থাকল। চরিত্রগুলির মাঝে ছাপ পড়ল রবীন্দ্রনাথের ছেলে-বেলায় দেখা মানুষদের।

ছন্দে ছন্দে নেচে উঠল সবগুলি কবিতা। কোথাও কোন অবসাদের চিহ্ন নেই। চলবে...। সুত্রঃ বাইশে শ্রাবনঃ বিভাস রায়চৌধুরী।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।