অচিরেই বোঝা যায় ব্যবসার নতুন এক মাধ্যম চলচ্চিত্র । ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রশিল্প। ১৯৩০ নাগাদ মুম্বাই (তখন বোম্বে) ও কলকাতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় নির্বাক সিনেমার নির্মাণ হতে থাকে। সে সময় মুম্বাইতে বছরে প্রায় দুশ’ সিনেমা নির্মিত হত। সিনেমার দর্শকও বাড়তে থাকে।
ভারতের অন্যান্য শহরেও সিনেমা নির্মাণ হতে থাকে। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা শুধু মুম্বাইয়ের সিনেমা নিয়েই কথা বলছি।
১৯৩০ এ নির্মিত হয় ভারতের প্রথম সবাক সিনেমা ‘আলম আরা’। এর পরিচালক ছিলেন আরদেশির ইরানি। ইরানির নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইমপেরিয়াল মুভিটোন সিনেমাটি প্রযোজনা করে।
গল্পটি ছিল এক রাজকুমারের সঙ্গে বেদের মেয়ের প্রেমকাহিনি। এই সিনেমায় এক কাল্পনিক কুমারপুর রাজ্যের কাহিনি তুলে ধরা হয়। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার উজিরের শিশুকন্যা আলম আরা লালিত হয় বেদের দলে। বেদের মেয়ে হিসেবেই বড় হয় আলম আরা। পরে রাজকুমার প্রেমে পড়ে বেদের মেয়ের।
সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন ভিথাল ও জুবায়দা। উজিরের ভূমিকায় ছিলেন পৃথ্বিরাজ কাপুর। সিনেমার গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অভিনেতা অভিনেত্রীরাই গান গাইতেন তখন, প্লেব্যাকের চল ছিল না। ১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ বোম্বের ম্যাজেস্টিক সিনেমা হলে মুক্তি পায় ১২৪ মিনিটের আলম আরা।
আলম আরার প্রিন্ট এক সময় হারিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে সেই প্রিন্ট খুঁজে পাওয়া যায়।
সে সময় সবাক সিনেমাকে বলা হত টকি। আলম আরার ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে আরও অনেক নির্মাতা টকি নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সে সময় কলকাতাতেও হিন্দি সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
হিন্দি সিনেমার প্রথম তারকা ছিলেন গায়ক-অভিনেতা কুন্দনলাল সায়গল বা কে এল সায়গল। সায়গল প্রথমে কলকাতায় নির্মিত হিন্দি ও বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের পর মুম্বাইতে চলে আসেন ১৯৪১ সালে। মুম্বাইয়ে তার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ‘ভক্ত সুরদাস’ (১৯৪২) এবং ‘তানসেন’ (১৯৪৩) ছিল দারুণ ব্যবসা সফল। সায়গল কাজ করতেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রঞ্জিত মুভিটোনে।
১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিল্ম স্টুডিও বোম্বে টকিজ।
পরবর্তীতে বোম্বে টকিজ হয়ে ওঠে বিশাল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। হিমাংশু রায়, রাজ নারায়ণ দুবে এবং দেবিকা রানি ছিলেন নামি নির্মাতা। বোম্বে টকিজের প্রধান প্রযোজক ছিলেন দেবিকা রানি। শশধর মুখার্জি এবং অশোক কুমার ছিলেন তার সহকারী।
১৯৩৬ সালে মুক্তি পায় অশোক কুমার ও দেবিকা রানি অভিনীত চলচ্চিত্র ‘অচ্ছুত কন্যা’।
চলচ্চিত্রটি দারুণ ব্যবসা সফল হয়। অশোক কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্রের তারকা অভিনেতার খ্যাতি পান। পান বিপুল জনপ্রিয়তা।
৩০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী মন্দার ঢেউ আছড়ে পড়ে চলচ্চিত্রশিল্পেও। সে সময় অনেক শিল্পী, নির্মাতা, পরিচালক তীব্র অর্থকষ্টে পড়েন।
সুখের পায়রারা ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে চলে গেলেও শিল্পকে ভালোবেসে মাটি কামড়ে টিকে থাকেন অনেকে। সে সময় ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলেন দেবকী বোস, নীতিন বোস, চেতন আনন্দ, এস এস ভাসানের মতো নির্মাতা।
চল্লিশের দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় অনেক মুসলমান শিল্পী, নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও কলাকুশলী ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান। আবার লাহোর থেকে ভারতে আসেন অনেক হিন্দু কলাকুশলী ও অভিনেতা অভিনেত্রী।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের মুম্বাই চলচ্চিত্রজগতের কাহিনি পাওয়া যায় সাদাত হাসান মান্টোর ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ ও ‘লাউড স্পিকার’ বইতে। ৪৭ সালের পর ধীরেধীরে জমজমাট হয়ে ওঠে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রজগত। ভারতভূষণ, পৃথ্বিরাজ কাপুর, রাজ কাপুর, অশোক কুমার, দেব আনন্দ, সুরাইয়া, দেবিকা রানি, মমতাজ শান্তি, কামিনি কৌশল, নাদিরা, নূরজাহান, লীলা চিতনিশের মতো তারকারা সে সময় রাজত্ব করতেন মুম্বাইতে।
৫২ সালে মুক্তি পায় বলিউডের প্রথম সুপারডুপার হিট সিনেমা ‘বৈজু বাওরা’। বৈজু বাওরা চরিত্রে ভারতভূষণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
অভিনেতা নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার ভারতভূষণ ছিলেন পৌরাণিক গল্পের জন্য আদর্শ নায়ক। তাকে বলা হয় হিন্দি সিনেমার প্রথম ‘চকলেট হিরো’। ‘বৈজু বাওরা’ শুধু ভারতভূষণকেই প্রতিষ্ঠা এনে দেয়নি। সেই সঙ্গে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে মোহাম্মদ রফি, নায়িকা মীনা কুমারী এবং সংগীত পরিচালক নওশাদের মতো তারকারও সৌভাগ্যের সূচনা করেছিল। ভারতভূষণ মিথভিত্তিক সিনেমায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
‘আনন্দ মঠ’, ‘সোনি মাহিওয়াল’, ‘বসন্তবাহার’-এর মতো অনেক ব্যবসা সফল সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন।
পঞ্চাশ ও ষাট দশককে বলা যায় হিন্দি সিনেমার সোনালি যুগ। দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, রাজকুমার,গুরু দত্তের মতো প্রতিভাবান অভিনেতা সে সময় সিনেমায় অভিনয়কে উচ্চমাত্রায় উন্নীত করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন পর্দাকাঁপানো অভিনেত্রী সুরাইয়া, নার্গিস, বৈজয়ন্তিমালা, মীনা কুমারী, নূতন, মধুবালা, ওয়াহিদা রহমান ও মালা সিনহা। রাজ কাপুর, গুরু দত্ত শুধু প্রতিভাবান অভিনেতাই ছিলেন না, তারা ছিলেন নির্মাতা।
কামাল আমরোহি, বিজয় ভাট, বিমল রায়, প্রকাশ অরোরা ছিলেন নামজাদা নির্মাতা। সে সময় সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, কাইফি আজমির মতো লেখকরা ছিলেন বোম্বের সিনেমাজগতের সঙ্গে যুক্ত।
দিলীপ কুমার তার অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৪৪ সালে ‘জোয়ার ভাটা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। চল্লিশের দশকে তার ‘মেলা’, ‘জুগন’, ‘মিলানে’র মতো হিট সিনেমা মুক্তি পেলেও পঞ্চাশেই তিনি তারকা হিসেবে বেশি খ্যাতি পান। হিন্দি সিনেমার সফল জুটি ছিলেন দীলিপ কুমার ও মধুবালা।
নায়িকা হিসেবে মধুবালার অভিষেক ঘটে ১৯৪৯ সালে কামাল আমরোহি পরিচালিত ‘মহল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। ষাট দশকের শুরুতেই মধুবালা অসুস্থতার জন্য চলচ্চিত্রজগত ত্যাগ করেন। মাত্র এক দশকের ক্যারিয়ারে তিনি তার সৌন্দর্য ও অভিনয়ের জন্য বিপুল খ্যাতি লাভ করেন। তাকে বলা হয় হিন্দি সিনেমাজগতের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী।
সে সময়ের সেরা সিনেমাগুলো হল, বিমল রায় নির্মিত বলরাজ সাহানি অভিনীত ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩), অশোক কুমার ও মীনা কুমারী অভিনীত বিমল রায়ের ‘পরিণীতা’ (১৯৫৩), গুরু দত্ত নির্মিত এবং গুরু দত্ত ও ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘পিয়াসা’ ( ১৯৫৭) এবং ‘কাগজ কি ফুল’ (১৯৫৯), রাজ কাপুর নির্মিত রাজ-নার্গিস জুটির ‘আওয়ারা’ (১৯৫১), ‘শ্রী ৪২০’ (১৯৫৫), প্রকাশ অরোরা পরিচালিত আর কে ফিল্মসের ‘বুটপলিশ’ (১৯৫৪), সোহরাব মোদির ‘মির্জা গালিব’ (১৯৫৪), সত্যেন বোসের ‘জাগৃতি’ (১৯৫৪), ভি. শান্তারামের ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ (১৯৫৫), দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রহমান অভিনীত বিজয় আনন্দের ‘গাইড’ (১৯৬৫), ‘নাগিন’, মেহবুব খান নির্মিত নার্গিস ও সুনীল দত্ত অভিনীত ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), দিলীপ কুমার অভিনীত ‘দাগ’ (১৯৫২), ‘সাংদিল’ (১৯৫২), বিমল রায় পরিচালিত দিলীপ কুমার ও মধুবালা অভিনীত ‘মধুমতি’ ( ১৯৫৮)।
১৯৫৪ সালে সুপারহিট হয় নন্দলাল যশোবন্তলাল পরিচালিত ‘নাগিন’। প্রদীপ কুমার ও বৈজয়ন্তিমালা অভিনীত সিনেমাটি বলিউডের অন্যতম সেরা মিউজিকাল হিট। হেমন্ত মুখার্জির সুরে মিউজিশিয়ান কল্যাণজি এমন বীণ বাজান, যা পরবর্তীতে সব সাপভিত্তিক সিনেমার আদর্শে পরিণত হয়।
কে আসিফ নির্মিত দিলীপ কুমার ও মধুবালা অভিনীত ‘মুঘল-এ-আজম’কে (১৯৬০), বলা হয় সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা। ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গানের সঙ্গে মধুবালা, দিলীপ কুমার ও পৃথ্বিরাজ কাপুরের অভিব্যক্তি অনন্য।
এই সিনেমার সেট নির্মাণে যেমন বিপুল অর্থব্যয় হয়েছিল তেমনি বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফলও হয়েছিল সিনেমাটি।
‘মাদার ইন্ডিয়া’ অস্কারের আসরে সেরা বিদেশি ভাষার সিনেমা ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পায়। সে সময় বাংলা ভাষার অনেক সিনেমা হিন্দিতে রিমেক হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিমল রায়ের দেবদাস। দিলীপ কুমার, বৈজয়ন্তিমালা ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমাটি ছিল দারুণ ব্যবসা সফল।
রাজ কাপুরের আর কে ফিল্মস সে সময় জাঁকিয়ে ব্যবসা করে।
ষাটের দশকে জুবিলি হিরো রাজেন্দ্র কুমারের নাম না বললেই নয়। তাকে জুবিলি হিরো বলা হত। কারণ তার অভিনীত বেশ কয়েকটি সিনেমা বক্স অফিসে জুবিলি করেছিল। পঞ্চাশের দশকে অভিনয় শুরু করলেও তিনি মূলত খ্যাতি পান ষাটের দশকে।
রাজেন্দ্র কুমার অভিনীত ‘ধুল কি ফুল’, ‘মেরে মেহেবুব’, ‘আরজু’, ‘পেয়ার কি সাগর’, ‘গেহরা দাগ’, ‘দিল এক মন্দির’, ‘আয়ি মিলান কি বেলা’, ‘তালাশ’, ‘সংগম’ সুপার হিট হয়েছিল।
ষাটের দশকের নায়ক মনোজ কুমার দেশপ্রেমিক নায়ক হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয়। ‘শহীদ’, ‘পুরব আওর পশ্চিম’, ‘উপকার’, ‘ও কৌন হ্যায়’, ‘রোটি কাপড়া আওর মাকান’, ‘নীলকমল’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় সিনেমা। কুস্তিগির দারা সিং পৌরাণিক সিনেমায় অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
এই সময় বলরাজ সাহানি, মেহবুব, ওম প্রকাশ, জীবন, প্রাণ, দীনা পাঠক, উৎপল দত্ত, সুলোচনা, নিরুপা রায় ছিলেন নামি চরিত্রাভিনেতা।
কৌতুক অভিনয়ে মেহবুব, জনি ওয়াকার ছিলেন নামকরা। ষাটের দশকেই বলিউডের প্রথম সুপার স্টার রাজেশ খান্নার আগমন। ষাট ও সত্তরের দশকে রাজেশ খান্না ছিলেন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে অপ্রতিদ্ব›দ্বী। রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর জুটির ‘আরাধনা’, ‘অমর প্রেম’, ‘রাজারানি’ ‘সফর’, রাজেশ খান্না ও মুমতাজ জুটির ‘আপ কি কসম’, ‘রোটি’, রাজেশ-হেমা মালিনীর ‘মেহবুবা’ রোমান্টিক ধারার সিনেমা।
বলিউডে তখন রোমান্টিক প্রেমকাহিনির পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক কাহিনির জনপ্রিয়তা ছিল।
বিয়োগান্তক প্রেমকাহিনিতে সেরা ছিলেন দিলীপ কুমার ও মীনা কুমারী। দিলীপ কুমার, নার্গিস, রাজ কাপুর অভিনীত বিয়োগান্তক সিনেমা ‘দিদার’ সুপারহিট হয়েছিল। দিলীপ কুমারকে ট্র্যাজেডি হিরো আর মীনা কুমারীকে বলা হত ট্র্যাজেডি কুইন। কামাল আমরোহি ছিলেন সে সময়ের নামকরা নির্মাতা। মীনা কুমারীর স্বামীও তিনি।
ট্র্যাজেডি সিনেমা নির্মাণে তিনি ছিলেন দারুণ সফল। সামাজিক অসংগতিকে চিত্রায়ন করেছিলেন রাজ কাপুর। এদিক থেকে ‘আওয়ারা’, ‘শ্রী ৪২০’-এ রাজ কাপুর অনেকটা চার্লি চাপলিন স্টাইলে হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক অসংগতিকে তুলে ধরেন। সোনালি সময়ের আরেক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নায়ক-গায়ক কিশোর কুমার। অশোক কুমারের ছোটভাই হিসেবে চলচ্চিত্রে আসলেও জনপ্রিয়তায় তিনি ছাড়িয়ে যান অশোক কুমারকে।
মধুবালা ও কিশোর কুমার অভিনীত ‘হাফটিকেট’, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছিল দারুণ জনপ্রিয় সিনেমা। কমেডি নায়ক হিসেবেই নাম করেন কিশোর কুমার। ষাট দশকে কাপুর পরিবার থেকে আসেন আরেক প্রতিভাবান অভিনেতা শাম্মি কাপুর। রক এন রোল নাচের স্টাইল আর চটুল প্রেমকাহিনির নায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। ‘জংলি’, ‘জানোয়ার’, ‘চায়না টাউন’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমার নায়ক তিনি।
ষাটের শেষ দিকে বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা ছিলেন রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জীব কুমার, শশী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর, মুমতাজ, আশা পারেখ, সাধনা। বিজয় ভাট, বিজয় আনন্দ, রাজ খোসলা, হৃষিকেশ মুখার্জি, শক্তি সামন্ত ছিলেন নামকরা পরিচালক।
‘অনুপমা’র রোমান্টিক ইমেজ ঝেড়ে ফেলে বলিউডে মারদাঙ্গা সিনেমার ধারা প্রথম সূচনা করেন নায়ক ধর্মেন্দ্র। সত্তরের দশকে মূলত অ্যাকশন ছবির জয়যাত্রা শুরু হয়। রাগী যুবকের ইমেজ নিয়ে আবির্ভূত হন অমিতাভ বচ্চন।
সে সময়ও ‘অনামিকা’ (জয়া ভাদুরি ও সঞ্জীব কুমার অভিনীত), ‘আঁধি’ ( সুচিত্রা সেন ও সঞ্জীব কুমার), ‘জুলি’ (১৯৭৫), ‘ববি’ (ঋষি কাপুর ও ডিম্পল কাপাডিয়া), ‘পাকিজা’, ‘উমরাও জানে’র(১৯৮১) মতো রোমান্টিক সিনেমা সুপার হিট হয়েছে। কিন্তু মূলত তখন অ্যাকশন সিনেমার যুগ। অমিতাভ বচ্চনের আবির্ভাবকে হিন্দি সিনেমার একটি বিশেষ পর্ব বলা চলে। ‘মিলি’, ‘কাভি কাভি’, ‘সওদাগর’, ‘সিলসিলা’,‘অভিমানে’র মতো রোমান্টিক সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন নিঃসন্দেহে সফল ছিলেন। কিন্তু ‘জাঞ্জিরে’র রাগী যুবকের ইমেজে তিনি ছিলেন আন-প্যারালাল।
অথচ আজ যদি অমিতাভের সেরা অভিনয়ের পরিচয়বাহী সিনেমাগুলোর তালিকা করা হয় তাতে হয়তো সিংহভাগ জুড়ে থাকবে অ্যাকশনবিহীন অথবা কম অ্যাকশনের সিনেমাগুলো। চম্বলের ডাকাত, মাফিয়া ডন--এদের বিরুদ্ধে নায়কদের সংগ্রাম নিয়ে তখন নির্মিত হয়েছে অধিকাংশ সিনেমা। অ্যাকশন সিনেমার ধারা সত্তর ও আশির দশকের মূল সুর। অমিতাভ মানেই অ্যাকশন, অ্যাকশন মানেই অমিতাভ। সত্তর ও আশির দশকের হিট অ্যাকশন সিনেমাগুলো ছিল মারপিট, প্রেম, নাচগানের এক মিশ্র রূপ।
‘শোলে’, ‘দিওয়ার’, ‘শান’, ‘মহান’, ‘ডন’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘মুকাদ্দার কি সেকান্দার’, ‘আখেরি রাস্তা’, ‘দোস্তানা’, ‘নসিব’, ‘কুলি’, ‘শরাবী’,‘লাওয়ারিশ’, ‘অমর আকবর এন্টনি’, ‘মদর্’, ‘শাহেনশা’-- অমিতাভের এসব অ্যাকশন ছবি সুপারহিট হয়।
অ্যাকশান সিনেমার নায়ক হিসেবে সত্তরের দশকে অমিতাভের সঙ্গে ছিলেন ধর্মেন্দ্র, ফিরোজ খান, শত্রুঘ্ন সিনহা, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, আশির দশকে মিঠুন চক্রবর্তী, অনিল কাপুর, জ্যাকি শ্রফ, সানি দেওল। পর্দায় এদের প্রেমিকা হয়ে আসেন সত্তরে রেখা, হেমা মালিনী, রাখি, জিনাত আমান, পারভীন ববি সত্তরের শেষ ও আশিতে শ্রীদেবী, জয়াপ্রদা, রতি অগ্নিহোত্রী, মাধুরী দীক্ষিত, মিনাক্ষী, অমৃতা সিং, টিনা মুনিম, পুনমের মতো নায়িকা। তাদের সঙ্গে শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ছিলেন আমজাদ খান, কাদের খান, দীনা পাঠক, অজিত, রঞ্জিত, ড্যানি ডেনজংপা, অমরেশ পুরী, ওমপুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, প্রেম চোপড়া, শক্তি কাপুর, বিন্দু, অরুণা ইরানি, কিরণ কুমার, গুলশান গ্রোভার, অনুপম খের, সদাশিব আম্রপুরকার প্রমুখ। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে সত্তর ও আশির দশকে বলিউডের প্রধান নায়ক ছিলেন অমিতাভ বচ্চন।
আশির দশকের দর্শকপ্রিয় সিনেমার মধ্যে হিরো, পারিন্দা, ত্রিদেব, তেজাব, শক্তি, ডিসকো ডান্সার, চাঁদনি, নাগিনা, মুকাদ্দার কি সেকান্দার, হিম্মতওয়ালা, সিলসিলা, আন্ধাকানুন, কুলি, অগ্নিপথ, খুদা গাওয়া উল্লেখযোগ্য। ইয়াশ চোপড়ার ইয়াশ রাজ ফিল্মস ও ইয়াশ জোহরের ধর্মা প্রডাকশন্সের জয়যাত্রা ছিল এই সময়। রমেশ সিপ্পি, প্রকাশ মেহরা, রাকেশ রোশন, মুকেশ ভাট, সুভাষ ঘাই, মহেশ ভাট, গুলজার, সেলিম জাভেদ, মনসুর খান ছিলেন নামজাদা নির্মাতা। সত্তরে ও আশিতে নায়িকা হয়ে আসেন হিন্দি সিনেমার দুই প্রতিভাবান অভিনেত্রী রেখা ও মাধুরী দীক্ষিত। রেখা ছিলেন এবং আছেন হিন্দি সিনেমার স্টাইল আইকন।
রেখা ও ফারুক শেখ অভিনীত, মুজাফ্ফর আলি প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘উমরাও জান’ শুধু রেখার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয়ই নয়, সিনেমাটি বলিউড ক্ল্যাসিকেরও অন্তর্গত। মাধুরী দীক্ষিতকে বলা হয় হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে প্রতিভাবান ও নৃত্যকুশলী নায়িকা। আশিতে শ্রীদেবীর মতো প্রতিভাবান ও সুন্দরী নায়িকারও আবির্ভাব হয়।
সত্তরে অ্যাকশন সিনেমার জয়যাত্রা সত্তে¡ও মিউজিকাল ও রোমান্টিক সিনেমার নির্মাণ বন্ধ হয়নি। ১৯৭৪ এ মিউজিকাল-রোমান্স ববি সুপার ডুপার হিট হয়েছিল।
ঋষি কাপুর-ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত ববি ছিল বলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা হিট। আশিতে রোমান্টিক সিনেমার মধ্যে সুপারহিট ছিল ‘এক দুজে কে লিয়ে’। কমল হাসান ও রোতি অগ্নিহোত্রি অভিনীত সিনেমাটি ছিল বিয়োগান্তক। দক্ষিণ-ভারত থেকে যে প্রতিভাবান অভিনেতারা বলিউডে এসেছেন তাদের মধ্যে কমল হাসান নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। শ্রীদেবী-কমল হাসান অভিনীত ‘সদমা’, ‘সাগর’ (কমল হাসান ডিম্পল কাবাডিয়া, ঋষি কাপুর অভিনীত), ‘মেয়র সাহেব’, ‘আপ্পুরাজা’,এবং নব্বই দশকে ‘চাচী ৪২০’ অভিনয় কুশলতায় সুপারহিট হয়।
অবশ্য সংগীত সবসময়েই বলিউডি সিনেমার সাফল্যে এক বড় ফ্যাকটর। ‘নাগিন’, ‘মহল’, ‘আরাধনা’, ‘ববি’, ‘আশিকি’, ‘দিল’ সব হিট সিনেমাতেই গান ছিল প্রধান আকর্ষণ।
আশির দশকে ডিসকো ডান্সার (১৯৮২) সিনেমার ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য বলিউডি সিনেমায় ডিসকো ও আধুনিক নাচকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। বলিউডে নাচও একটি বড় ফ্যাকটর। বৈজয়ন্তিমালা, মধুবালা থেকে শুরু করে জিনাত আমান, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, মাধুরীসহ অধিকাংশ জনপ্রিয় নায়িকাই নৃত্যকুশলী।
নাদিরা, হেলেন, বিন্দু, অরুণা ইরানির মতো পার্শ্ব চরিত্রাভিনেত্রীরাও নৃত্যকুশলী। মিউজিকাল-রোমান্সের মধ্যে ‘নাগিন’, ‘ববি’, ‘পাকিজা’, ‘উমরাও জান’, ‘ডিসকো ডান্সার’,‘ম্যায়নে পিয়ার কিয়া’, ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, উল্লেখযোগ্য।
নব্বই দশক ও একুশ শতকে কোরিওগ্রাফি অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ফারহা খান কোরিওগ্রাফার থেকেই পরিচালক হন। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের কোরিওগ্রাফিতে ‘দেবদাস’ সিনেমায় অসাধারণ নাচেন মাধুরী দীক্ষিত।
ঐশ্বরিয়া, কারিনা, দীপিকা, সোনাক্ষির পাশাপাশি নাচে কম যান না একালের হৃত্বিক, রণবীর কাপুররাও। কমেডি নাচে গোবিন্দ নব্বই দশকে ছিলেন অনবদ্য। আর আশির দশকে নৃত্যকুশলতায় খ্যাতিমান ছিলেন কমল হাসান, জিতেন্দ্র ও মিঠুন চক্রবর্তী।
সংগীত পরিচালক ও কম্পোজারের কদর বলিউডে সবসময়েই ছিল, এখনও আছে। মদন মোহন, নওশাদ, শচীন দেববর্মণ, রাহুল দেববর্মণ, হেমন্ত মুখার্জি, লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল, আনন্দ মিলিন্দ, বাপ্পী লাহিড়ি, এ. আর রহমান বলিউডকে উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সব সুর।
নূরজাহান, লতা মঙ্গেশকার, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত, মান্না দে, কুমার শানু, অনুরাধা পাড়োয়াল, উদিত নারায়ণ, অভিজিৎ, সনু নিগম, অলকা ইয়াগনিক, শ্রেয়া ঘোষাল, শান-- বলিউডে কিন্নর কণ্ঠের অভাব হয়নি কোনো দিনই।
আশির দশকের শেষ প্রান্তে মুক্তি পাওয়া ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ (১৯৮৯) শুধু নতুন তারকারই জন্ম দেয়নি এই সিনেমাটির সঙ্গে বলিউডে আবার স্বমহিমায় ফিরে আসে প্রেমনির্ভর কাহিনি। আমির খান-জুহি চাওলা অভিনীত সিনেমাটি বলিউডের অন্যতম সেরা হিট সিনেমা ও ক্ল্যাসিক প্রেমকাহিনি। আশির শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে তিনটি হিট প্রেম কাহিনি নির্ভর সিনেমা বলিউডে প্রেমনির্ভর সিনেমার নতুন ধারা সৃষ্টি করে এবং বলিউডে তিন খানের রাজত্বের সূচনা করে। ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে শাহরুখ (বিপরীতে দিব্যা ভারতী), ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’র মাধ্যমে সালমান ( বিপরীতে ভাগ্যশ্রী) এবং ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর মাধ্যমে অভিষেক ঘটে আমির খানের (বিপরীতে জুহি চাওলা)।
আশির দশকের সেক্স ও ভায়োলেন্স প্রধান সিনেমার জায়গায় নব্বই দশকে সিনেমাতে ফিরে আসে গল্প, বিশেষ করে প্রেমের গল্প। কাজল, রানি মুখার্জি, ঐশ্বরিয়া রাই, টাবু, মনিষা কৈরালা, কারিশমা কাপুর, রাভিনা ট্যান্ডন, শিল্পা শেঠি, সুস্মিতা সেন, উর্মিলা মাতন্ডকরসহ অনেক নতুন নায়িকা আসেন এই দশকে। আসেন অজয় দেবগন, সাইফ আলি খান, অক্ষয় খান্না, ববি দেওল, অক্ষয় কুমারের মতো নায়ক। গোবিন্দ ও সঞ্জয় দত্তের আগমন আশির শেষ দিকে হলেও তাদের সেরা সিনেমাগুলো মুক্তি পেয়েছে নব্বইতেই। তাদের সঙ্গে ছিলেন নানা পাটেকার, মনোজ বাজপেয়ি, পরেশ রাওয়ালের মতো চরিত্রাভিনেতা।
নব্বইয়ের শেষে আসেন অভিষেক বচ্চন, জন আব্রাহাম, বিপাশা বসু, কারিনা কাপুর, প্রীতি জিন্তা। নব্বইয়ের সেরা হিট সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘দিল’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘সাজন’, ‘রাজাবাবু’, ‘রাজা হিন্দুস্তানি’, ‘কুছ কুছ হোতা হায়’, ‘১৯৪২ : এ লাভ স্টোরি’, ‘সড়ক’, ‘মন’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘পরদেশ’, ‘বাদশাহ’, ‘রঙ্গিলা’, ‘খলনায়ক’, ‘হাম আপকে হায় কৌন’, ‘বেটা’, ‘তাল’, ‘হাম দিল দে চুকে সনম’, ‘বোম্বে’, ‘রোজা’, ‘হিরো নাম্বার ওয়ান’, ‘খিলাড়ি’, ‘মোহরা’, ‘দিল হ্যায় তো মানতা নেহি’, ‘দিল চাহতা হায়’ উল্লেখযোগ্য। নব্বই দশকেই বলিউডে আসেন কারান জোহর, মনি রত্নম, আদিত্য চোপড়া, সঞ্জয় লীলা বনসালি, রামগোপাল ভার্মা, শেখর কাপুর, অনুরাগ কশ্যপ, সুরাজ বারজাতিয়া, অনুরাগ বসুর মতো নির্মাতা।
বাণিজ্যিকধারার পাশাপাশি আর্টফিল্মের একটা ধারা হিন্দি সিনেমায় বহমান ছিল। শ্যাম বেনেগাল, মানি কাউল, গোপাল আদুরাকৃষ্ণন, কুমার সাহানি, গুলজার, কেতন মেহতা, গোবিন্দ নিহলানি, বিজয় মেহতা, মীরা নায়ার, কল্পনা লাজমি এই ধারার নামি নির্মাতা।
সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকও হিন্দি ভাষায় সিনেমা নির্মাণ করেছেন। চেতন আনন্দর ‘নিচা নগর’ (১৯৪৬) সিনেমা দিয়ে এই ধারার শুরু। ‘নিচা নগর’ সিনেমাটি প্রথম কান ফিল্ম উৎসবে গ্র্যান্ড প্রাইজ জয় করে। পরবর্তীতে এই ধারায় নির্মিত হয়েছে ‘খণ্ডহর’, ‘পার’, ‘একপল’, ‘শ্যাম সাহাব কি গুস্সা কিউ আঁতা হ্যায়’, ‘ইয়ুধ্যা’, ‘মাচিস’, ‘আর্থ’, ‘অস্তিত্ব’, ‘আস্থা’, ‘রুদালি’, ‘অঙ্কুর’, ‘মাসুম’, ‘লেকিন’, ‘সদমা’, ‘পিঞ্জর’, ‘ঈশ্বর’, ‘সালাম বম্বে’, ‘ওয়াটার’-এর মতো সিনেমা। শাবানা আজমি, অমল পালেকার, স্মিতা পাতিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, সৈয়দ জাফরি, ডিম্পল কাপাডিয়া, ফারুক শেখ, বিনোদ মেহরা, টাবু, চন্দ্রচূড়, নানা পাটেকার, মনোজ বাজপেয়ি, রাহুল বোস অভিনয় করেছেন মূলত এই ধারার সিনেমায়।
নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক ছিল বিচিত্র ধরনের গল্প, অভিনয় কুশলতা, আইটেম গান আর বিগ বাজেটের। সেই সঙ্গে বিশাল ব্যবসারও। বক্স অফিসে একশ’ কোটি রুপির ব্যবসা শুরু হয়। এই দশকেই মুক্তি পায় ‘লগন’, ‘ব্ল্যাক’, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’, ‘তারে জমিন পার’, ‘রঙ দে বাসন্তি’-র মতো সিনেমা, যা বলিউডকে পৌঁছে দেয় ভিন্ন উচ্চতায়। মুক্তি পায় ‘দেবদাস’, ‘ওম শান্তি ওম’, ‘ধুম টু’, ‘দাবাং’-এর মতো বিগ বাজেটের চোখ ধাঁধানো সুপার হিট।
‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’,‘থ্রি ইডিওটস’, ‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’, ‘বাস্তব’, ‘হাতিয়ার’, ‘গাজনি’, ‘মাই নেম ইজ খান’-এর মতো সমাজ বাস্তবতার চিত্রায়ন। বলিউডের প্রথম সুপারহিরো মুভি ‘কই মিল গায়া’ ও ‘কৃষে’র দেখা মেলে এই দশকেই। তিন খানের রাজত্ব সত্তে¡ও এই দশকে পাওয়া যায় হৃত্বিক রোশান এবং এমরান হাশমির মতো নায়ক, ঋতেশ দেশমুখ, আরশাদ ওয়ার্সি, বোমান ইরানির মতো চরিত্রাভিনেতা। ক্যাটরিনা কাইফ, কারিনা কাপুর, প্রিয়াংকা চোপড়া, বিদ্যা বালান, দীপিকা পাড়ুকোন, আনুশকা শর্মার উত্থান এই দশকে। এখনও টিনসেলে এদের বাজার রমরমা।
আছেন রণবীর কাপুর, রণবীর সিং, ইমরান খানও।
বলিউডে সামাজিক প্রেমকাহিনি, পারিবারিক গল্প ও মারদাঙ্গা কাহিনিই সিনেমার প্রধান ধারা। ১৯৭৫ সালে ‘জয় সন্তোষি মা’ হিট করার পর ভক্তিমূলক ধারার সিনেমা নির্মাণ শুরু হয়।
পৌরাণিক কাহিনি নিয়েও অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। মহাভারতের গল্প, হনুমানের কীর্তিকলাপ নিয়ে নির্মিত সিনেমা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
নির্মিত হয়েছে ইতিহাসভিত্তিক অনেক সিনেমা। ‘মুঘল-এ-আজম’ ( সেলিম আনারকলির কাহিনি নিয়ে), ‘তাজমহল’, ‘শহিদ’, ‘শহীদ ভগৎ সিং’, ‘যোধা আকবর’, ‘অশোক’, ‘মঙ্গল পান্ডে’-র মতো সিনেমা এই ধারার। অতিপ্রাকৃত সাপের কাহিনি নিয়ে বা বলা যায় নাগ-নাগিন নিয়ে বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। যেমন-- ‘নাগিন’ (১৯৫৪), ‘নাগিন’ (১৯৭৬), ‘নাগিনা’ (১৯৮৬), ‘নিগাহে নাগিন’, ‘শীষনাগ’, ‘নাগমণি’ ইত্যাদি।
আরও এক ধরনের অতিপ্রাকৃত কাহিনি নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
এগুলোকে বলা যায় ভৌতিক সিনেমা। ‘মহল’ (অশোক কুমার ও মধুবালা) দিয়ে অতিপ্রাকৃত সিনেমার যাত্রা শুরু হলেও আশির দশকে ভৌতিক সিনেমার নামে নির্মিত হতে থাকে অখ্যাত শিল্পী অভিনীত, ভৌতিক ও যৌনতার মিশেলে এক ধরনের সিনেমা। ‘ভিরানা’, ‘বন্ধ দরওয়াজা’ ইত্যাদি এই ধারার সিনেমা। পরবর্তীতে ‘রাজ’, ‘ভূত’ ইত্যাদি ভৌতিক সিনেমার মাধ্যমে এই ধারার সিনেমা কিছুটা শিল্পসম্মত হয়ে ওঠে। অতিপ্রাকৃত ছবির ধারায় এক উল্লেখযোগ্য অংশ হল পুনর্জন্মভিত্তিক সিনেমা।
পুনর্জন্ম নিয়ে নির্মিত সিনেমার অধিকাংশই ব্যবসা সফল হয়েছে। ‘মধুমতি’, ‘বিশ সাল বাদ’, ‘মেহবুবা’, ‘বানজারান’, ‘করণ-অর্জুন’, ‘ওম শান্তি ওম’ এই ধারার সিনেমা।
হাসির সিনেমা বা কমেডি সিনেমার একটি বিশেষ ধারা রয়েছে বলিউডে। মেহমুদ ছিলেন এই ধারার অগ্রপথিক। পরবর্তীতে গোবিন্দ কমেডি সিনেমার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়করূপে আবির্ভূত হন।
ষাট, সত্তর ও আশির দশকে কমেডিয়ান হিসেবে সিনেমায় জনি ওয়াকার, জগদীপ, জনি লিভার, অনুপম খের ছিলেন। আবার পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরাও কমেডি করতেন। নতুন শতকে মূলধারার নায়ক-নায়িকারা কমেডিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বলিউডের সুপারহিট কমেডি সিনেমার মধ্যে ‘ভূতবাংলা’, ‘বোম্বে টু গোয়া’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘পড়োসান’, ‘জরু কা গোলাম’, ‘চালবাজ’, ‘খেল’, ‘হিরো নাম্বার ওয়ান’, ‘রাজাবাবু’, ‘আন্দাজ আপনা আপনা’, ‘গোলমাল’, ‘কেয়া কুল হায় হাম’, ‘ম্যায়নে পেয়ার কিউ কিয়া’, ‘ওয়েলকাম’, ‘হালচাল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
হলিউডের মতো বলিউডেও এখন চলছে সিকুয়াল ও রিমেকের ধুম।
কোনো একটি সিনেমা ব্যবসা সফল হলেই তার সিকুয়াল তৈরি হচ্ছে। যেমন, ‘রেইস’, ‘দাবাং’, ‘ধুম’, ‘গোলমাল’ ইত্যাদি।
আবার অতীতের ব্যবসা সফল সিনেমার রিমেক চলছে যেমন, ‘ডন’, ‘অগ্নিপথ’। রিমেক চলছে তামিল ও অন্যান্য ভাষার ব্যবসাসফল সিনেমারও। অতীতেও বাংলা, তামিল ও মারাঠি ভাষায় নির্মিত সিনেমা বলিউডে রিমেক হয়েছে।
কিন্তু এখন যেন চলছে রিমেক ও সিকুয়ালের উৎসব। এর কারণ হল, কোটি কোটি রুপি ব্যয় করে নির্মাতারা সহজে ঝুঁকি নিতে চান না। পরীক্ষিত গল্পেই বিনিয়োগ করতে চান তারা। বলিউডের সিনেমায় আইটেম গান আগেও ছিল। তবে এখন যেন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত।
ঐশ্বরিয়া, ক্যাটরিনা, কারিনা, দীপিকা, প্রিয়াঙ্কা, আইটেম গানে পিছিয়ে নেই কেউই। কিছুদিন আগে মাধুরীও নতুনভাবে আইটেম গানে পারফর্ম করেছেন। সিকুয়াল ও রিমেকের পাশাপাশি অসাধারণ সব সিনেমা যে নির্মিত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনুরাগ বসুর ‘বারফি!’, সুজয় ঘোষের ‘কাহানি’, মধুর ভাণ্ডারকারের ‘ফ্যাশন’, ফারহান আখতারের ‘ভাগ মিলখা ভাগ’, প্রকাশ ঝাঁর ‘রাজনীতি’র মতো সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
বলিউডে এখন ষাট, সত্তর ও আশির দশকের নির্মাতা, পরিচালক ও তারকাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের রাজত্ব চলছে।
অনিল কাপুরের মেয়ে সোনম কাপুর, অমিতাভ বচ্চনের ছেলে অভিষেক, রাকেশ রোশনের ছেলে হৃত্বিক রোশন, শত্রুঘ্ন সিনহার মেয়ে সোনাক্ষি সিনহা, আমির খানের ভাগ্নে ইমরান খান, জাভেদ আখতারের ছেলে ফারহান আখতার ও মেয়ে জয়া আখতার এসেছেন বলিউডে।
আশি ও নব্বইতেই এসেছেন ধর্মেন্দ্রর ছেলে সানি ও ববি দেওল, ইয়াশ চোপড়ার ছেলে আদিত্য চোপড়া ও উদয় চোপড়া, ইয়াশ জোহরের ছেলে কারান জোহর, তনুজার মেয়ে কাজল। ষাট দশকের নায়িকা তনুজা নিজেও ছিলেন নায়িকা শোভনা সমর্থর মেয়ে এবং নায়িকা নূতনের ছোট বোন। এসেছেন বীরু দেবগনের ছেলে অজয় দেবগন, জিতেন্দ্রর মেয়ে একতা কাপুর ও ছেলে তুষার কাপুর, বিনোদ খান্নার ছেলে অক্ষয় খান্না, ধর্মেন্দ্র ও হেমা মালিনীর মেয়ে এষা দেওল, মহেশ ভাটের মেয়ে পূজা ভাট ও নবাগত আলিয়া ভাট। এদের কেউ দারুণ সাফল্য পেয়েছেন আর কেউ বা তেমন পাননি।
রাজেশ খান্না-ডিম্পলের মেয়ে টুইঙ্কেল সিনেমায় এসেও অক্ষয় কুমারকে বিয়ে করে ক্যারিয়ার ত্যাগ করেন।
বলিউডের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাপুর পরিবারের নাম। সেই ত্রিশের দশকে পৃথ্বিরাজ কাপুরের সময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে এই পরিবারের সম্পর্কের সূচনা। সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পরিবার থেকে এসেছেন সফল অসফল অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী ও নির্মাতা। তাদের মধ্যে রাজ কাপুর, শাম্মি কাপুর, শশী কাপুর, রণধীর, ঋষি, কারিশমা, কারিনা, রণবীর সাফল্য পেয়েছেন।
বলিউডের বাজার এখন বিশ্বজুড়ে। একেকটি বলিউডি সিনেমা এখন ভারতের পাশাপাশি মুক্তি পায় ইউরোপে ও আমেরিকায়। একশ কোটি রুপি আয় করা সিনেমার তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় বলিউডে। ফিল্ম ফেয়ার, আইফা স্টার ডাস্ট ও ভারতের জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি রয়েছে আরও অনেক পুরস্কার।
কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে নন্দিত, পুরস্কৃত হচ্ছে বলিউডি সিনেমা। নন্দিত হচ্ছে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের আসরেও।
বলিউড নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই বাংলাদেশ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে। হলিউডের নির্মাতা ও অভিনয় শিল্পীরাও বলিউডের বিষয়ে আগ্রহী। টম ক্রুজসহ অনেকে অভিনয়ও করেছেন বলিউডি সিনেমায়।
সেই ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ থেকে শুরু। ‘মৃচ্ছকটিক’-এর মতো সংস্কৃত নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয় প্রথমদিকের বলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্য। পরবর্তীতে বলিউডের সিনেমার নিজস্ব স্টাইল গড়ে ওঠে। হলিউডের কাহিনি থেকে অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত হলেও বলিউডের রয়েছে নিজ¯^ বৈশিষ্ট্য। নাচ গান, সংলাপ, গল্প-- সবমিলে বলিউড মানেই জমজমাট ব্যাপার।
বলিউডি অর্কেস্ট্রার মূল সুর প্রেম। পৌরাণিক, রূপকথা, ঐতিহাসিক প্রেম পেরিয়ে সামাজিক, মারদাঙ্গা, বাস্তব, অবাস্তব ও পরাবাস্তব-- অনেক রকম প্রেমের গল্প বলিউড শুনিয়েছে এই একশ’ বছরে। কত তারকার আলো জ্বলেছে, নিভেছে। কত অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, কম্পোজার, কণ্ঠশিল্পী, কলাকুশলীর জীবনেরর ধারা এসে মিশেছে বলিউড-সমুদ্রে। এ যেন এক অন্য পৃথিবী, সুখদুঃখ হাসিকান্নার মায়াজগৎ।
এখানে অবাস্তব বলে কিছু নেই, অসম্ভব বলে কিছু নেই। এই মায়াজগতের হাসিকান্নার দোলায় দর্শক ভুলেছে নিজের জীবনের কঠোর বাস্তবতা। হোক না তা ক্ষণিকের জন্য। এই জগতে এক সময় যারা ছিলেন রাজা-রানি আজ তারা অতীতের ধূসর ছায়া মাত্র। কালের কপোল তলে এক বিন্দু নয়নের জল ছাড়া তাদের জন্য আর কিছুই নেই।
আজ যারা প্রবল দাপটে রাজত্ব করছেন টিনসেলে একসময় তারাও হয়ে যাবেন অতীত। একশ’ বছর পেরিয়ে বলিউড এগিয়ে যাচ্ছে। বিনোদনের এই জয়যাত্রায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।