মানুষ না,অমানুষ
মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়-অবিচার বাল্য বয়সেই গভীরভাবে দাগ কাটে তার হৃদয়ে। আর এ কারণে তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে যোগ দেন তৎকালীন বিপ্লবী দল যুগান্তর-এ। আর এর মাধ্যমে তিনি সংস্পর্শে আসেন চার বিপ্লবীর। এরা হলেন- মাস্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও মধুসূদন দত্ত।
আর এদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শৃংখলিত ব্রিটিশ ভারত থেকে ১৮ থেকে
২২ এপ্রিল এই চার দিনের জন্য চট্টগ্রাম স্বাধীন হয়েছিল। বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর শততম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে শীর্ষ নিউজ ডটকম মুখোমুখি হয় এই বিপ্লবীর। তার এই একান্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে আসে তার দীর্ঘ শতবর্ষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা।
চট্টগ্রামের বোয়াখালীর পি.সি.সেন সারোয়াতলী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেখানে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা মাঠে ব্রিটিশ ভারত সরকারের বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে আলোচনা করত। বৃদ্ধ, মধ্যবয়স্ক, তরুণসহ সব বয়সের মানুষ তাতে অংশ নিত।
বিনোদ বিহারীও মাঝে মাঝে যেতেন সেখানে। আর সেখান থেকে অল্প অল্প করে বিদ্রোহের বীজ দানা বাঁধে তার ভিতরে। আর এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার স্কুলের বিতর্ক প্রতিযোগিতায়।
সেই দিন এক এক করে বক্তব্য দেন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানতে চান আর কেউ বক্তব্য দিবে কি না।
ঠিক এমন সময় ছোট্ট বালকটি হাত উপরে তুলে। সেই দিনের বালকটি আর অন্য কেউ না, তিনিই হলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী। সেই দিন তার পুরো ভাষণ জুড়ে ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ আর বিদ্বেষ। পুরো হলরুম প্রকম্পিত করে বাজছিল তার ভাষণ। পুরো হল জুড়ে বিরাজ করছিল পিনপতন নীরবতা।
সেই দিন হল রুমের কারো বুঝতে বাকি ছিল না এ ক্ষোভ একদিন বিদ্রোহে রূপ নিবে। ভাষণের সুবাদে পরিচয় হয়ে গেল একই স্কুলে দশম শ্রেণীর পড়া রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এর সাথে। সেই সময় রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বিনোদ বিহারীকে কার্লমার্ক্স-এর বইসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বই পড়তে দিতেন। আর এভাবেই তার মধ্যে আস্তে আস্তে বিপ্লবের বীজ বপন হতে থাকে। আর এভাবেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে যোগ দেন তৎকালীন বিপ্লবী দল যুগান্তর-এ।
গোপনে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার পাশাপাশি পূর্ণোদ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে যান বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায় বাহাদুর বৃত্তি লাভ করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে পাঠরত অবস্থায় তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বাহিনীর সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নেন। এরপর ১৯৩০-এর ১২ এপ্রিল স্থানীয় কংগ্রেস ভবনে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে বিনোদ বিহারী অন্য চার সহযোদ্ধাসহ ১৮ এপ্রিল বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে পুলিশের অস্ত্রাগার দখলে নেন।
এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষ। অস্ত্রাগার দখল করে তারা ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পতাকা উত্তোলন করেন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী গণতন্ত্রী বিপ্লবী সরকারের ঘোষণা দেন। আর এর পরেই একই দিনে পৃথক পৃথকভাবে ফৌজি অস্ত্রাগার, টেলিফোন ভবন, টেলিগ্রাফ অফিস দখলে নেয় বিদ্রোহীরা। এরপরে লাঙ্গলকোট ও ধুম স্টেশনের রেল লাইন উৎপাটন করে চট্টগ্রামের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আর এভাবে ১৮ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারত থেকে চার দিনের জন্য স্বাধীন হয় চট্টগ্রাম।
১৯৩০-এর ২২ এপ্রিল বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে বিদ্রোহীদের চলে সম্মুখ যুদ্ধ। যেটা ইতিহাসে জালালাবাদ যুদ্ধ নামে স্থান করে নিয়েছে। কর্নেল ডেলার স্মিথ ও ক্যাপ্টেন টেইনট-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর তিন শতাধিক সৈন্য সাধারণতন্ত্র বাহিনীর ৫৪ জন সদস্যের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। এ যুদ্ধে বিপ্লবী দলের ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন লোকনাথ বল। যুদ্ধে ১২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হন।
আহতদের একজন ছিলেন বিনোদ বিহারী।
সেই যুদ্ধে গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি, তবে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। এরপর তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হন বিনোদ বিহারী এবং ১৯৩৪ সালে জেলে থাকা অবস্থায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ইংরেজিতে এম.এ. ও বি.এল. পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন।
৪১ সাল থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত তাকে আবার জেলে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। সেই থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ যুক্ত নির্বাচনের আন্দোলনেও বিনোদ বিহারী সোচ্চার ছিলেন। এরপরে তিনি ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতি বিনোদ বিহারী চৌধুরীর যে গভীর ভালোবাসা তারই স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশের নানা প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মানিত করেছে। দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদকেও ভূষিত করা হয়েছে তাকে।
কিন্তু বিপ্লবী বিনোদ বিহারী মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যে মুক্তির জন্য সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন সেই মুক্তি এসেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না সেই মুক্তি বাংলার জনগণ এখনো পায়নি। তবে যে মুক্তির জন্য তিনি সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন বাংলার মানুষ একদিন সেই মুক্তি লাভ করবে সে বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।