ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...
অপবিত্রতা অথবা ভালবাসার সূচনা..
‘তুই ঐ দিকে তাকা। ’ দীর্ঘ নীরবতার পর মুখ খোলে মেয়েটি।
‘কেন?’ ছেলেটির অবাক প্রশ্ন। মেয়েটি বসে আছে ছেলেটির বাম পাশে, আর তাকানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে ডান পাশে।
‘আমি তোর কাঁধে মাথা রাখবো।
’ অনুচ্চ স্বরে বলে মেয়েটি।
ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড চমকে ওঠে ছেলেটি। পূর্ণ দৃষ্টিতে সরাসরি তাকায় মেয়েটির মুখের দিকে। প্রায়-পূর্ণ চাঁদের আলোয় এতটা কাছ থেকে ওর মুখের সকল রেখাই পড়তে পারে ছেলেটি। সেখানে দুষ্টুমীর কোন চিহ্ন খুঁজে পায় না।
তবুও কিছুণ ঝিম মেরে বসে থাকে সে। বসে থাকে মেয়েটিও। দ্বিতীয়বার অনুরাধ করে না। ধীরে মাথাটা ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকায় ছেলেটি। তাদের সমান্তরালে থাকা ভবনগুলোর উঁচু উঁচু ছাদের দিকে নয়, তার দৃষ্টি হারায় আরো উপরে- নগরের আলোতে ফিকে হয়ে থাকা আকাশের নত্রের ভীড়ে।
টের পায়, মেয়েটি ধীরে মাথাটা এলিয়ে দেয় তার কাঁধে। ছেলেটি শক্ত কাঠের মতো নিঃসাড় হয়ে থাকে। কিন্তু হৃদয়ে তখন ভূমিকম্প। আনন্দ-বেদনার দ্বন্দ্ব। তার প্রতি মেয়েটির এই নির্ভরতা তাকে উদ্বেলিত করে, অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে ওঠে মন।
কিন্তু একই সাথে মেয়েটির কষ্টের পরিধিও যেন তার উপলব্ধির জগতকে আলোড়িত করে। সে বোঝে, অন্তরে কতটা ঝড় বইছে মেয়েটির, নিজের সাথে কতটা যুদ্ধ করে অবশেষে কান্তির কাছে আত্মসমর্পন করতে চাইছে বাহ্যতঃ দৃঢ় মেয়েটি।
নিশ্চুপ কতকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ছেলেটি টের পায়, কাঁধে মাথা রাখতে মেয়েটির সমস্যা হচ্ছে। তারা দুজনে এতটা পাশ ঘেঁষে বসেনি যে সহজেই একজনের কাঁধে অপরজন মাথা রাখতে পারে। অতটা পাশ ঘেঁষে তারা কখনোই বসেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে তাদের মাঝে বন্ধন দিন দিন দৃঢ় হয়েছে। পাশাপাশি এলাকায় বসবাস বলে দুজনের অবাধ যাতায়াত পরস্পরের বাসায়, দু পরিবার তাদের বন্ধুত্বকে তাদের মতো করে গড়ে উঠতে বাধা দেয়নি। এমনকি মেয়েটির প্রেমিকও প্রথমে ইতস্ততঃ করলেও পরবর্তীতে নির্ভার থাকতে পেরেছে। কিন্তু বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে শ্রদ্ধার আসনে রাখতে দুজনেই শরীরকে সচেতনভাবে দূরে রেখেছিল।
মেয়েটির তিন বছরের প্রেম ভেঙ্গে গেছে।
ছেলেটি জানতো, মেয়েটির সাথে তার প্রেমিকের সমস্যা হচ্ছে কিছুদিন ধরে। তবে ঠিক কি কারণে সমস্যা তা কখনোই বলেনি মেয়েটি। আজ বিকেলে ফোন করে মেয়েটি ছেলেটিকে জানায় তার সম্পর্কের পরিণতির কথা। সন্ধ্যে বেলায় ছেলেটি আসে মেয়েটির বাসায়, মেয়েটির কষ্টের এই সময়ে পাশে থাকাটা তার কর্তব্য বলে মনে হয়।
নির্জন এই ছাদে দুজন পাশাপাশি বসার পর থেকে কোন কথা বলেনি মেয়েটি।
তার মুখে বিষাদের অন্ধকার ছেলেটিকেও নিশ্চুপ করে রেখেছিল। দীর্ঘণ পর মেয়েটিই হঠাৎ বলে- ‘তুই ঐ দিকে তাকা। ’
যে শরীরকে সচেতনভাবে দূরে রেখেছে এতদিন, তা হঠাৎ এত কাছে চলে আসায় ছেলেটির ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। উপভোগ আর অস্বস্তির মাঝামাঝি অনুভূতি নিয়ে অনেকণ কেটে যাবার পর বার কয়েক ঢোক গিলে ছেলেটি আস্তে করে বলে, ‘তুই কি কোলে মাথা রেখে শুবি?’ ছেলেটিকে বিস্মিত করে দিয়ে মেয়েটি শরীর ঘুরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে তার কোলে মাথা রেখে। ছেলেটি নিজেই দ্বন্দ্বে পড়ে যায়- কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? ও যদি কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়, তবে কেন নয় - মনের এক অংশ উত্তর দেয়।
আরো কিছু সময় নীরবতায় কেটে যায়।
হঠাৎ ফোঁপানীর আওয়াজ শোনে ছেলেটি - মেয়েটি কাঁদছে। ছেলেটির কষ্ট হয়। মন চায় এক লহমায় মেয়েটির সমস্ত যন্ত্রণা যে কোনভাবে দূর করে দিতে। কিন্তু এটাতো মেয়ের একার যুদ্ধ।
নির্জন মাঠে নিথর বৃরে সামনে কষ্টাতুর মানুষের চোখের জলেও যেমন বৃরে পাতায় কাঁপন পর্যন্ত লাগে না, তেমনি অথর্ব বৃ মনে হয় নিজেকে ছেলেটির। মেয়েটির দুঃখ ঘোচানোর এই অমতা তাকে আরো অস্থির করে তোলে।
মেয়েটির চুলে হাত দেয় ছেলেটি। চুলে বিলি কেটে দেয়। মেয়েটির কষ্টের নদীতে যেন বান ডাকে।
ছেলেটির কোমর আঁকড়ে ধরে আরো জোরে ফুঁপিয়ে ওঠে। যেন ছেলেটির ভেতর সেধিয়ে গিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়। ছেলেটিও মেয়েটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের কোলের সাথে।
ধীরে ধীরে কান্নার বেগ কমে। মেয়েটি কোলের উপরই চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ছেলেটি ঝুঁকে পড়ে মেয়েটির দিকে। তার মুখ নামতে থাকে, নামতে থাকে ঠোঁট। মেয়েটির ঠোঁটজোড়াও উঠে আসতে থাকে ধীরে। মেয়েটির চোখের দিকে তাকায় ছেলেটি, সে চোখে নীরব সম্মতি। দু’জোড়া ঠোঁট এক ইঞ্চি দূরে থাকতে থমকায় ছেলেটি।
বিপন্ন আবেগমাখা অস্ফূট স্বরে বলে- ‘কি করছিস?’
তেমনি অস্ফূটে সব হারানোর আর্তি ফোটে মেয়েটির স্বরে- ‘মরছি। ’
মুখ সরিয়ে আনে ছেলেটি। আস্তে করে ঠেলে উঠিয়ে দেয় মেয়েটিকে। মেয়েটি দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। মেঘেরা স্থান পাল্টায়, চুপে সরে বসে চাঁদ, বাতাসে পুরনো গন্ধ মুছে যায়।
কিছুণ পর সব দ্বিধা ঝেড়ে সচল হয় ছেলেটি। মেয়েটির গালে আঙুল রাখে আলতো করে। ইঙ্গিত বোঝে মেয়েটি। সে-ও মুখ ঘুরিয়ে তাকায় ছেলেটির দিকে। এবার নিঃসংকোচে দুজোড়া ঠোঁট এগোয় পরস্পরের দিকে।
-‘অধরের কানে যেন অধরের ভাষা,
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে-
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে। ’
ঐ তীর্থে ভালবাসা কতটুকু ছিল, তা দুজনের কেউই নিশ্চিত নয়, কিন্তু তাতে মেয়েটির কষ্ট মোচনের সুতীব্র প্রয়াস যে ছিল, তাতে কারো সন্দেহ থাকে না।
কিন্তু অতটুকুতেই থেমে থাকে না ছেলে-মেয়ে দুটি। একবার লাজের বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়ার পর অবিমৃষ্যকারী হয়ে যায় দুজনেই। ছেলেটির কোলের উপর আবার শুয়ে পড়ে মেয়েটি।
মুখ নামিয়ে মেয়েটির ঠোঁট থেকে সমস্ত কষ্ট শুষে নেয়ার চেষ্টা করে ছেলেটি। মেয়েটিও ছেলেটির দুঠোঁটে একটুখানি শান্তি, একটুখানি স্বস্তি খোঁজে। তারপর এক সময় ছেলেটি মেয়েটির বুকের উপর আলগোছে তার হাতখানি ফেলে রাখে। কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আভাস দেখা যায় না। ছেলেটি আলতো আদরের ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে যায়।
তাতেও বাধা না পেয়ে জামার নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেয় ধীরে। কোমর, পিঠ, পেট হয়ে সে হাত উঠে আসে আরো উপরে। নরম ঢেউয়ে ডুবে যায় ছেলেটি, ভেসে ওঠে। মেয়েটিও চোখ বুজে উপভোগ করে।
দুঃসাহসী হয়ে ওঠে ছেলেটি।
স্বস্তি দেয়ার চেয়ে এখন শরীরই যেন প্রাধান্য পায়। মেয়েটির পাজামার ফিতায় হাত দেয় সে।
তারা ভুলে যায় তাদের নিজেদের অবস্থান, সম্পর্ক। ভুলে যায়, সদ্য সন্ধ্যে-পেরুনো এই রাতের অন্ধকার প্রায়-পূর্ণ চাঁদের আলোতে অনেকখানিই ফিকে। ভুলে যায়, বয়োঃসন্ধি পেরিয়ে যাওয়া দুটি ছেলে-মেয়েকে ছাদের নির্জনে আসতে দেয়ার পেছনে কতটা ভাবনাহীন বিশ্বাস প্রোথিত মেয়েটির বাবা-মার হৃদয়ে।
ভুলে যায়, মেয়েটির মা-বাবা বা বোনের যে কোন মুহূর্তে ছাদে চলে আসার সম্ভাবনাটুকুও।
অনেকণ পর স্বাভাবিক হয় ছেলে-মেয়ে দুটি।
মেয়েটি বলে, ‘স্যরি’।
মাথা নিচু করে ছেলেটি বসে থাকে। মনে পড়ে, অনেক দিন আগে, এক সহপাঠী যখন তাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ছেলেটিকে অন্যরকম ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলেছিল, শুনে ছেলেটির যখন খুব খু-ব মন খারাপ হয়েছিল, মেয়েটি বলেছিল - ‘আর কেউ জানুক না জানুক আমরা দুজন তো জানি, আমাদের সম্পর্ক কতটা পবিত্র।
আমাদের সম্পর্ক চিরকাল এরকমটাই পবিত্র থাকবে, আমরা চিরদিন দুজন দুজনের খুব ভাল বন্ধু হয়ে থাকবো। ’
আজ সে-ই পবিত্রতা নষ্ট করেছে দুজনে। আবেগ, সময় বা পরিস্থিতির কাছে হেরে গেছে তাদের প্রতিজ্ঞা। এই প্রতিজ্ঞাভঙ্গ কি ভালবাসার সূচনা? নাকি বন্ধুত্বের সম্পর্কে শুধু অপবিত্রতার কলঙ্ক? মাথার ভেতরটা এলোমেলোই রয়ে যায় ছেলেটির।
অপরাধের বোধ মেয়েটির কন্ঠেও - ‘আজ যা হয়েছে ভুলে যা।
পারলে আমাকে মাফ করে দিস। এরকমটা আর হবে না। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ। আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই স্বাভাবিক থাকবে। ’
ছেলেটি অতটা নিশ্চিত হতে পারে না।
সত্যিই কি আগের মতো স্বাভাবিক থাকবে সবকিছু? আগের মতো সাবলীলতায় মুখোমুখি হতে পারবে দুজনে? কোন অপরাধবোধের ছায়ামাত্র ছাড়াই পরস্পরের পাশে হাঁটতে পারবে? পরস্পরের প্রতি অনুভূতির কোন ব্যত্যয় ঘটবে না? চিরন্তন বন্ধুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে মন কি বোধ করবে না অন্য কোন আকর্ষণ?
‘চল, ওঠ। বাড়ি যা। রাত হয়ে যাচ্ছে। ’ কান্ত কন্ঠে মেয়েটি তাগাদা দেয়।
উঠে দাঁড়ায় ছেলেটি।
ধীরে দুজনে হাঁটতে থাকে ছাদের দরজার দিকে। কিন্তু দরজার ওপারে যাওয়া হয় না। দরজার কাছে এসে ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরে টান দেয়। মেয়েটিও বিনা বাক্য ব্যয়ে ছেলেটির সাথে সাথে দেয়াল-ঘেঁষে দাঁড়ায়। মেয়েটিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে ছেলেটি।
আবার ‘তীর্থ-যাত্রা’। আবার নরম ঢেউয়ে অবগাহন।
.................................
'মৌচাকে ঢিল'- ঈদ-উল-ফিতর সংখ্যা - ২০১০ এ প্রকাশিত লেখার অ-(পরি)শোধিত ও অ-(পরি)মার্জিত সংস্করণ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।