বদলে গেছি
আজ ২২ সেপ্টেম্বর ২০১০। তারিখটা সবারই জানা তারপরও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। গত ২০০৯ সালের এই দিনে আমি আমার প্রিয়তমা ন্যান্সির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। সে এক হুটহাটের বিয়ে। যদিও আমাদের কয়েক বছরের দীর্ঘ প্রেম- অভিসারে ন্যান্সি আর আমি এ কাঙ্খিত বিয়ের দিনটি নিয়ে অজস্র স্বপ্ন দেখেছি, অনেক কল্পনা করেছি তারপরও আমাদের হুটহাটের বিয়ে।
আমার বাবার অফিসের ছুটি, আত্মীয় স্বজনের ঈদের ছুটি আর স্বল্প পয়সার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বৈবাহিক বাজেট ইত্যাদি কারণে আমাদের বিয়েটা হয়ে যায় ‘বলা নেই কওয়া নেই’ গোছের। ন্যান্সির স্বপ্ন ছিল বিয়ের দিন তার বাড়িটা মরিচ বাতি দিয়ে সাজাবে। দুইদিন দুই রাত ধরে সে মরিচ বাতি আশে পাশে জানান দিবে আজ ন্যান্সির বিয়ে। আমি অনেক দিন ধরে বিয়ের ভিডিও’র ওপর পড়াশুনা করেছি। খুঁজে পেয়েছি কীভাবে একটা বিয়ের ভিডিওকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া যায়।
কিন্তু এসবের কিছুই হয় নি আমাদের বিয়েতে। আমরা আমাদের সব বন্ধু আর শুভানুধ্যায়ীদের দাওয়াত করতে চেয়েছিলাম, সময় স্বল্পতায় তাও সম্ভব হয়ে উঠে নি। যে সব বন্ধুকে শেষ পর্যন্ত দাওয়াত পৌঁছানো গিয়েছিল তার মধ্যে একজন মাত্র উপস্থিত থাকতে পেরেছিল। আমার ছোট ভাইরা বহু আশা করে আমার বিয়েতে গিয়েছিল। ওরা ভেবেছিল বিয়ে বাড়িতে হয়তো দুই একটা সুন্দরী বেয়াইন জুটে যেতে পারে।
কিন্তু তাদের সে আশার গুড়ে শুধু বালিই পড়েছিল বললে ভুল হবে ইট, কাঠ, রড, সিমেন্টও পড়েছিল। সে দুঃখের বিশাল হাইকোর্ট ওরা আমাকে এখনও মাঝে মাঝে দেখায়।
কিন্তু আমি আজ বসেছি সাল তামামি লিখতে বিয়ের অনুষ্ঠানের কাসুন্দি ঘাটতে নয়। বিয়ের রাতেই ন্যান্সি আমাকে সোজা সাপ্টা জানিয়ে দেয় বিয়ের কোন ছবি, ভিডিও না থাকাতে সে কষ্ট পেয়েছে। আর রংপুর থেকে টাঙ্গাইলে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আসার বিশাল ভ্রমণ ধকলে সে ক্লান্ত।
আমিও তো ক্লান্ত কম ছিলাম না, একদিন পর বৌভাত, হাতে সময় নেই বাজার ঘাট করতে হবে আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বৌভাতের পর দিন আমাদের দুজনকেই অফিসে উপস্থিত হতে হবে। সুতরাং জীবন ছুটতে থাকল ইন্টারসিটি ট্রেনের গতিতে। আর চোখে চোখ রেখে মুখস্ত করে রাখা কবিতাটা বলা হল না।
এরপর শুধুই সংসারের ডেভেলপমেন্ট।
যেমন বিয়ের পরে ন্যন্সি তার প্রথম দুই মাসের বেতন জমিয়ে কিনে ফেলল একটা ফ্রিজ। কিস্তিতে। তিন মাসে সে কিস্তি পরিশোধ করেছি আমরা দুজনে। এরপর খাট, ওয়ারড্রোভ এসব কিনতে কিনতে কোন দিক দিয়ে সময় চলে গেল টের পেলাম না। টিভি কার্ড কিনতে লেগে গেল প্রায় ছয় মাস।
স্যাটেলাইট কানেকশন নিতে লেগে গেল এক মাস। টিভির কানেকশন নেওয়ার পরপরই ন্যান্সির প্রোজেক্ট শেষ হয়ে গেল। ও এখন কমপ্লিট গৃহিনী কিংবা বেকার। ও যখন চাকরি করতো আমাদের মধ্যে রাতে খাওয়ার সময় আর সকালে অফিস যাওয়ার সময় দেখা হত। রাতে ফিরে দুজনেই এত ক্লান্ত থাকতাম যে রাতের খাবার খেয়ে আর কাব্য করা হত না শুধু ঘুম।
তখনও বলা হয় নি আমার মুখস্ত করে রাখা কবিতাটা।
এখন ন্যান্সি পুরোদস্তুর গৃহিনী। আমিও এখন বেশ সময় পাই। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে পারি। কিন্তু বাসায় ফিরেই আমাকে পত্রিকা পড়তে হয়।
মাঝে মাঝে স্থানীয় সংবাদপত্রের জন্য কলাম লিখতে হয়। গবেষণার জন্য সাহিত্য পর্যালোচনা করতে হয়, অবসর পেলে টিভি দেখতে হয়, নতুন সিনেমা আসলে রাত জেগে তাও দেখতে হয়। ন্যান্সিও সারাদিনের গৃহ কাজে ক্লান্ত থাকে আর হয়ে ওঠে না আমার মুখস্ত করে রাখা কবিতা টা বলা।
ভাবি শুক্রবারে ছুটির দিনে না হয় বলব। ছুটির দিনে আমাকে সকালে উঠে ছুটতে হবে বাজারে তাই বৃহস্পতিবার রাতে আর্লি টু বেড।
বাজার থেকে ফিরেই ছুটি গোসল করতে, শেভ করতে। তারপর জুমার নামায। নামায শেষে ফিরে আমরা এক সঙ্গে লাঞ্চ করি কিন্তু তখন কথা বলার পরিস্থিতি নেই। কারণ শুক্রবারেই ন্যান্সি ঘরদোর ঝাড়মোছ, কাপড় ধোয়ার মত ভারি কাজ করে। খাওয়া শেষে আমরা বিছানায় শুয়ে কথা বলতে চাই।
আমি আমার মুখস্ত করে রাখা সেই কবিতাটা বলতে চাই। কিন্তু কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। বিকেলে উঠে আমরা কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাই। রিক্সাওয়ালাদের ভাড়া চাওয়ার নমুনা দেখে মেজাজ খিচড়ে যায়। বেড়ানোর জায়গা খুঁজে না পাওয়ায় খুব বিরক্ত হয়ে যাই।
আর কাব্য করার মুড থাকে না।
এবার ভেবেছি ২২ সেপ্টেম্বর আমার বিবাহ বার্ষিকীর প্রথম প্রহরে ওকে কবিতাটা বলব। কিন্তু ও ২১ তারিখ রংপুর থেকে এসেছে। অনেকক্ষণ জ্যামে পড়েছিল। রাতে দেখি কান্ত পরিশ্রান্ত আমার প্রিয়া, প্রিয়তমেষূ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
আজও কবিতাটা বলা হয় নি।
কিন্তু সময় তো এখনও আছে। হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে। অথচ আমি সেই কবিতাটার ঘুনাক্ষরও মনে করতে পারছি না। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে।
হে কবিতা তুমি চলে এসো। চলে এসো এ ভিখারি অভাগার কাছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।