আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলমান সম্প্রচারযন্ত্র: মফস্বলের প্রতি বৈষম্যের তির্যক তর্জনী

সুবোধের কথামালা

আমি অত বড় সাংবাদিক নই, যত বড় হলে প্রশাসন আমাকে ভয় পাবে। তবে এটা নিঃসংকোচে কিংবা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমি মফস্বলের একজন পেশাদার সংবাদশ্রমিক। এ সংবাদ বিকিকিনির ফলেই যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তারা সম্মানীর নামে (আদতে অসম্মানী কি না ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে) নামমাত্র পারিশ্রমিক দেয়। তাতেই বলা চলে, টুনাটুনির সংসার (নুন আনতে পান্তা ফুরোয়) চলে! ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান নই। একসময় পিতার ছিল, এখন আমরা নিঃস্বই বলা যায়।

লেখালেখির সুবাদে সংবাদপত্র অথবা আজকের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংস্রবে আসা। যেখানে এসে বরং সৃজনশীল অনেক কাজের ‘সঙ্গ’ আমাকে চেতনে অথবা অবচেতনে ত্যাগ করতে হয়েছে। সাংবাদিকতার প্রতি একধরনের মোহই আমাকে গিলে খেয়েছে। সম্মান ও নৈতিকতাবোধের মোহই এখানে প্রধান। আজকের লেখার বিষয় আমার আÍপ্রচারণা নয়, বরং আÍদহনের ও প্রবঞ্চনার যন্ত্রণাকাতরতাই উপজীব্য।

মফস্বলের সংবাদশ্রমিক হিসেবে আমার একেবারে পুরোপুরি পেশাদারি যাত্রা শুর“ ২০০০ সালে। গত পাঁচ বছর একটি বেসরকারি টেলিভিশনে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। অনেক আশা নিয়ে, জেলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের মুখাবয়ব ওই চলমান সম্প্রচারযন্ত্রে তুলে ধরার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা নিয়েই শুর“ করেছিলাম। অপেক্ষাকৃত কম বয়স হওয়ায় জেলার বাঘা বাঘা(!) সাংবাদিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেমন অর্থের অযথা অপচয় হয়েছে, আবার অনেক বাঘা(!) সাংবাদিকের ধমক ও চাতুরতাও আমাকে বিস্মিত করেছে, কখনো কখনো বিচলিতও করেছে নিশ্চয়ই। তবুও আজ অবধি টিকে আছি।

হয়তো আগামীতেও টিকে থাকব। এখন প্রশ্ন হলো, কার জন্য টিকে থাকা? আমি যে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছি, সেই প্রতিষ্ঠান কি আমাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে কখনো? না এখনো করছে? উল্টো তাদের টেকাতে গিয়ে, নৈতিকতা, সামাজিক দায়বোধ বিবেচনা করতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানের গয়না, নিজের শখের বাইক বিক্রি করতে হয়েছে। মনে হয়েছে, আমার চেয়েও দৈন্যে রয়েছে আমাকে শ্রমিকের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানটি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ধাক্কা খাওয়া, আগুনে পুড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য অনেক উছিলায় সারা দেশের প্রতিনিধিদের মতো আমিও পারিশ্রমিক পাইনি কয়েক বছর। কিš‘ চ্যানেল চলেছে।

ব্রাহ্মণেরাও তাদের সুবিধাসমূহ নিশ্চয়ই নিয়েছেন। ঝামেলা আর দৈন্য কেবল অ”ছুত মফস্বল শ্রমিকদের। ইতোমধ্যে আরেকবার মালিকানা পরিবর্তন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো আরও শ্রমিকদের দায়বোধ বেড়েছে। এমন চিত্র মফস্বলের সব সংবাদ শ্রমিকের বলেই ধারণা বাহুল্য হবে না।

আমাকে মাসিক তিন হাজার টাকা সম্মানী, ফুটেজ, প্যাকেজ ও উভ সংবাদের জন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের শর্তানুযায়ী সুবিধাসমূহ দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায় পাঁচ বছরে কয়েক মাসের পারিশ্রমিক ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয়নি। কারণ প্রতিষ্ঠান মনে করে, আমরা ‘লোগো’ আর মিডিয়ার ‘নাম’ বেচে খাই। ওটাই অনেক বড় কিছু। অন্য পেশার মানবেতর জীবনযাপনের সংবাদ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনৈতিকতার সংবাদ, বৈষম্যের সংবাদ দিতে গিয়ে মিডিয়া যেখানে নৈতিকতালয় (নীতিচর্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) সেজে বসে, সেখানে নিজের নীতি-নৈতিকতা চর্চার এমন হাল হলে তার জবাবদিহি কী হতে পারে? সেই জবাবদিহির সামনে কে আসবে? আমাদের দৈনন্দিনের আড্ডায় তর“ণ সতীর্থরা নানা কথা তোলেন, নানা কথা বলেন। যাদের পেশাগত স্ব”ছতা নিয়ে এখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।

চলতি মাসের এক দিনের আড্ডায় এক সতীর্থ বললেন, আমাদের কোনো ঝামেলা নেই, মাসের বেতন মাসে পাই। ফুটেজ বিলও দেয়। তবে একটা কথা আছে, সেটা হলো; আমাদের ফুটেজ প্রচার যা হয়, তার চেয়ে কমসংখ্যক প্রচারিত হয়েছে বলে তারা চালিয়ে দেন। আমার এমন প্রমাণ আছে যে, (এই প্রতিনিধি এক মাসের প্রচারিত প্রতিটি সংবাদ ফুটেজ ক্যাপচার/সংরক্ষণ করে রেখেছেন) প্রচারিত হয়েছে ১৫টি, অথচ বিল ধরা হয়েছে ৭ থেকে ১০টির। অনেক নৈতিকতালয় সাম্প্রতিক সময়ে দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের ঘটে যাওয়া অ¯ি’তিশীলতার সংবাদ দিয়েছেন।

নানামাত্রিক নির্যাতন, বেতন বৈষম্যসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির দাবির কথা তুলেছেন। এ দাবি অনেকের কাছে গ্রাহ্য হয়েছে অথবা হয়ওনি। কিš‘ আমাদের নৈতিকতালয়ের কর্তাব্যক্তিদের (দু-চারজন বাদে) মনে একটিবারের জন্যও কি এমন প্রশ্ন উঁকি দেয়নি যে তাদের সংবাদ শ্রমিকেরা তো ওই দুই-তিন-চার হাজারের বাইরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো ওভারটাইম বাবদও কিছুই পান না। তাদের সন্তানসন্ততি নিয়ে আরও বেশি মানবেতর জীবন কাটাতে হয়। নীতি ও আদর্শ এবং সামাজিক দায়বোধ বোধ করি মালিকপক্ষ আর ব্রাহ্মণ সাংবাদিকেরাই লালন করেন।

আর মফস্বলের ‘হরিজন’ তারা তো চাঁদাবাজ, ধান্ধাবাজ, বাটপার। তাদের কোনো নৈতিকতা নেই, সামাজিক দায়বোধ নেই! তাহলে আমাদের দায়বোধ, নৈতিকতা বোধ জাগাতে একটা কিছু কি করা যাবে? একটিবারের জন্য কি আমাদের নিয়ে ভাববার ফুরসত পাবেন এসব নৈতিকতালয়ের কর্ণধার (অধিকাংশ) কিংবা কর্তাব্যক্তি (যথারীতি দু-চারজন বাদে, ছড়ি ঘোরানো ব্যক্তিরা যারা কখনোই শ্রমিকের স্বার্থ দেখেন না)। সেই সব আড্ডার আলোচনার আরেকটি বিষয় একটু আলোকপাত করতে চাই। ঢাকার নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ডেস্কে থাকা ব্যক্তিরা (উল্লেখযোগ্যসংখ্যক) মফস্বলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন না। একটি সংবাদ পাঠাতে বার কয়েক গাঁটের পয়সা খরচ করে ফোন করলেও তারা বিষয়টি গুর“ত্ব দেন না।

ফোন করি আমরা আর কেটে দেন তারা। এটা কোন ধরনের আচরণ, তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। তারা নিজেদের কী ভাবেন, তাও ঠিক বুঝতে পারি না। অন্যান্য বৈরী আচরণ তো করেনই। যেমন ধর“ন, নোয়াখালীর দুর্গম দ্বীপ হাতিয়া।

সে দ্বীপের চারপাশে আরও অনেক ছোট দ্বীপ রয়েছে। নিঝুম দ্বীপের একটি গুর“ত্বপূর্ণ সংবাদ যথাসময়ে একজন সংবাদশ্রমিক পাঠালে ডেস্ক থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসে সংশ্লিষ্ট সংবাদের ফুটেজ পাঠান। এটা তাহলে কী হলো? দিনে দিনে আমার পক্ষে ঢাকা থেকে ঘুরে এসে ফুটেজ পাঠানো সম্ভব। কিš‘ নিঝুম দ্বীপ! যেখানে যেতে-আসতে দুই দিন লাগে, সেখান থেকে ফুটেজটা কীভাবে পাঠাই? তাদের কি ভৌগোলিক জ্ঞানটাও ন্যূনতম কাজ করে না? ডেস্কে কাজ করেন বলে সব জানেন এমন ভাব দেখানোটা সমীচীন কি না, তাও বিবেচনায় আনা দরকার। কারণ যিনি ¯’ানীয় প্রতিনিধি তার কাজ ও অভিজ্ঞতাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ আছে বলে বোধকরি ঠিক নয়।

জেলা প্রতিনিধিরা সব ধরনের সুযোগসুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তরের পিয়নদেরও বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা প্রতিবছর বাড়ে কিš‘ বছরের পর বছর মফস্বলের সংবাদশ্রমিকদের এক চ্যানেলে একই পদে কাজ করেও ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েও কোনো পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না। বরং কথায় কথায় শোকজ খান জেলার সংবাদশ্রমিকেরা। বছরের ধর্মীয় উৎসবসমূহেও দৈন্যর কারণে স্ত্রী-সন্তানদের কিছুই দিতে পারেন না। অনেক চ্যানেল আছে এমন উৎসবেও সংবাদশ্রমিকদের পারিশ্রমিক সময়মতো দিতে পারেন না।

উল্টো কোনো কোনো চ্যানেলের কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘আমরা তো যা হোক একটা কিছু দিই, কিš‘ অন্য (এক্স-ওয়াই-জেড) চ্যানেল তো তাও দেয় না। এটা কোনো উত্তর হলো? দেশে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো চ্যানেল গজিয়েছে। কালো টাকা সাদা করার তাগিদ অথবা ধনের পাহাড় গড়ার অদম্য আগ্রহ, গ্র“প অব কোম্পানিজের স্বার্থরক্ষার তাগিদে এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি টেকানোর জন্য দেদার গজা”েছ এ চ্যানেলগুলো। কিš‘ সে অনুপাতে মান কি তৈরি হ”েছ? যে সকল মফস্বল প্রতিনিধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন সারা দেশে, তাদের কি কোনো মূল্যায়ন হ”েছ? যদি সাংবাদিকদের প্রতি মালিকপক্ষের বৈষম্য থেকেই যায়, তাহলে চ্যানেল বাড়িয়ে লাভ কী? শুধুই কি মালিকপক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ? ধনাঢ্য মালিকদের গজিয়ে ওঠা এসব চ্যানেলকে কেন্দ্র করে সারা দেশে কাজ করে যাওয়া সংবাদশ্রমিকেরা কি অপুষ্টই থাকবেন? এমন একটা সময় ছিল, মফস্বলের সাংবাদিকেরা অন্য পেশার পাশাপাশি দেশের জাতীয় দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন। তারা সম্মানীর নামে কিছু পেতেন কিংবা না পেলেও অন্য কাজ করে জীবন-জীবিকা চালাতেন।

কিš‘ এখনকার ঘটনাবহুল (প্রতিযোগিতার বাজারে) সময়ে চলমান সম্প্রচারযন্ত্রে (চ্যানেলে) কাজ করে অন্য কোনো পেশায় কিংবা কাজে মনোনিবেশ করা কি আজকের প্রেক্ষাপটে সম্ভব? আর সম্মানীর নামে যা করা হয়, তা আসলে কি? মফস্বলের প্রতি বৈষম্যের তির্যক তর্জনী নির্দেশ করে না? মালিকপক্ষ অথবা ব্রাহ্মণ সাংবাদিক (সাংবাদিকতার ইজারাদার, আমাদের ওপর যারা ছড়ি ঘোরান) তাহলে বলবেন, পোষালে কাজ কর“ন নতুবা ছেড়ে দিন। উল্টো টাকা দিয়ে কাজ করার লোক আছে। বেশ। তাহলে তা-ই হোক। তাহলে এমন নৈতিকতালয়(?) বন্ধ হোক।

তাহলে এমন শঠতা বন্ধ হোক। প্রিয় পাঠক ও মফস্বলের সতীর্থরা, ক্ষমা করবেন। লজ্জায় অনেক দৈন্য আড়াল করেছি। অনেক কষ্ট-ক্ষত বুকে পুষে রেখেছি। একদিন সংবাদশ্রমিকেরও কথা বলার দিন আসবে নিশ্চয়ই।

http://www.prothom-aloblog.com/posts/3/108409

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।