জামাল হোসেন বিষাদ :: আমি অত বড় সাংবাদিক নই, যত বড় হলে প্রশাসন আমাকে ভয় পাবে। তবে এটা নিঃসংকোচে কিংবা নির্দ্বিধায় বলতে পারি মফস্বলের একজন পেশাদার সংবাদ শ্রমিক। এ সংবাদ বিকিকিনির ফলেই যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তারা সম্মানীর নামে (আদতে অসম্মানী কিনা ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে) নামমাত্র পারিশ্রমিক দেয়। তাতেই বলা চলে টুনাটুনির সংসার (নুন আনতে পান্তা ফুরোয়) চলে! ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান নই। এক সময় পিতার ছিলো এখন আমরা নিঃস্বই বলা যায়।
লেখালেখির সুবাদে সংবাদপত্র অথবা আজকের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংশ্রবে আসা। যেখানে এসে বরং সৃজনশীল অনেক কাজের ‘সঙ্গ’ আমাকে চেতনে অথবা অবচেতনে ত্যাগ করতে হয়েছে। সাংবাদিকতার প্রতি এক ধরনের মোহ’ই আমাকে গিলে খেয়েছে। সম্মান ও নৈতিকতাবোধের মোহ’ই এখানে প্রধান। আজকের লেখার বিষয় আমার আত্ম প্রচারণা নয় বরঞ্চ আত্মদহনের ও প্রবঞ্চণার যন্ত্রণাকাতরতা’ই উপজীব্য।
মফস্বলের সংবাদ শ্রমিক হিসেবে আমার একেবারে পুরোপুরি পেশাদারি যাত্রা শুরু দু’ হাজার সালে। গত পাঁচ বছর একটি বেসরকারি টেলিভিশনে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। অনেক আশা নিয়ে, জেলার মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভূখা-নাঙ্গা মানুষের মুখাবয়ব ওই চলমান সম্প্রচার যন্ত্রে তুলে ধরবার দুর্নীবার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই শুরু করেছিলাম। অপেক্ষাকৃত কম বয়স হওয়ায় জেলার বাঘা বাঘা (!) সাংবাদিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে যেমন অর্থের অযথা অপচয় হয়েছে আবার অনেক বাঘা (!) সাংবাদিকদের ধমক ও চাতুরতাও আমাকে বিস্মিত করেছে, কখনো কখনো বিচলিতও করেছে নিশ্চয়’ই। তবুও আজ অবধি টিকে আছি।
হয়তো আগামিতেও টিকে থাকবো।
এখন প্রশ্ন হলো কার জন্য টিকে থাকা? আমি যে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছি সে প্রতিষ্ঠান কি আমাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে কখানো? না এখনো করছে? উল্টো তাদের টেকাতে গিয়ে, নৈতিকতা, সামাজিক দায়বোধ বিবেচনা করতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানের গয়না, নিজের শখের বাইক বিক্রি করতে হয়েছে আমাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে আমার চেয়েও দৈন্যে রয়েছে আমাকে শ্রমিকের চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠানটি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ধাক্কা খাওয়া, আগুনে পুড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য অনেক উচিলায় সারাদেশের প্রতিনিধিদের মত আমিও পারিশ্রমিক পাইনি কয়েক বছর। কিন্তু চ্যানেল চলেছে।
ব্রাহ্মণরাও তাদের সুবিধাসমূহ নিশ্চয়’ই নিয়েছেন। ঝামেলা আর দৈন্য কেবল অচ্ছুত: মফস্বল শ্রমিকদের। ইতোমধ্যে আরেকবার মালিকানা পরিবর্তন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো আরো শ্রমিকদের দায়বোধ বেড়েছে। এমন চিত্র মফস্বলের সকল সংবাদ শ্রমিকের বলেই ধারণা বাহুল্য হবে না।
আমাকে মাসিক তিন হাজার টাকা সম্মানি, ফুটেজ, প্যাকেজ ও উভ সংবাদের জন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের শর্তানুযায়ী সুবিধাসমূহ দেবার কথা থাকলেও গত প্রায় পাঁচ বছরে কয়েক মাসের পারিশ্রমিক ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয়নি। কারণ প্রতিষ্ঠান মনে করে আমরা ‘লগো’ আর মিডিয়ার ‘নাম’ বেচে খাই। ওটাই অনেক বড় কিছু। অন্য পেশার মানবেতর জীবনযাপনের সংবাদ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনৈতিকতার সংবাদ, বৈষম্যের সংবাদ দিতে গিয়ে মিডিয়া যেখানে নৈতিকতালয় (নীতি চর্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) সেজে বসে, সেখানে নিজের নীতি নৈতিকতা চর্চার এমন হাল হলে তার জবাবদিহি কি হতে পারে? সেই জবাবদিহিতার সামনে কে আসবে?
আমাদের দৈনন্দিনের আড্ডায় তরুণ সতীর্থরা নানা কথা তোলেন নানা কথা বলেন। যাদের পেশাগত স্বচ্ছতা নিয়ে এখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
চলতি মাসের এক দিনের আড্ডায় এক সতীর্থ বললেন, আমাদের কোনো ঝামেলা নেই, মাসের বেতন মাসে পাই। ফুটেজ বিলও দেয়। তবে একটা কথা আছে: সেটা হলো; আমাদের ফুটেজ প্রচার যা হয়, তার চেয়ে কম সংখ্যক প্রচারিত হয়েছে বলে তারা চালিয়ে দেন। আমার এমন প্রমাণ আছে যে, (এ প্রতিনিধি এক মাসের প্রচারিত প্রতিটি সংবাদ ফুটেজ ক্যাপচার/সংরণ করে রেখেছেন) প্রচার হয়েছে ১৫টি, অথচ বিল ধরা হয়েছে ৭/১০ টি’র।
অনেক নৈতিকতালয় সাম্প্রতিক সময়ে দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের ঘটে যাওয়া অস্থিতিশীলতার সংবাদ দিয়েছেন।
নানামাত্রিক নির্যাতন, বেতন বৈষম্য-সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির দাবির কথা তুলেছেন। এ দাবি অনেকের কাছে গ্রাহ্য হয়েছে অথবা হয়ওনি। কিন্তু আমাদের নৈতিকতালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের (দু’ চার জন বাদে) মনে একটিবারের জন্যও কি এমন প্রশ্ন উঁকি দেয়নি যে, তাঁদের সংবাদ শ্রমিকেরাতো ওই দুই/তিন/চার হাজারের বাইরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মত ওভার টাইম বাবদও কিছুই পান না। তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে আরো বেশি মানবেতর জীবন কাটাতে হয়। নীতি ও আদর্শ এবং সামাজিক দায়বোধ বোধ করি মালিকপক্ষ আর ব্রাহ্মণ সাংবাদিকরাই লালন করেন।
আর মফস্বলের ‘হরিজন’ তারাতো চাঁদাবাজ, ধান্ধাবাজ, বাটপার। তাদের কোনো নৈতকতা নেই, সামাজিক দায়বোধ নেই! তাহলে আমাদের দায়বোধ, নৈতিকতা বোধ জাগাতে একটা কিছু কি করা যাবে? একটিবারের জন্য কি আমাদের নিয়ে ভাববার ফুসরৎ পাবেন এসব নৈতিকতালয়ের কর্ণধার (অধিকাংশ) কিংবা কর্তাব্যক্তিগণ (যথারীতি দু’ চারজন বাদে, ছড়ি ঘোরানো ব্যক্তিগণ যারা কখনোই শ্রমিকের স্বার্থ দেখেন না)। সেইসব আড্ডার আলোচনার আরেকটি বিষয় একটু আলোকপাত করতে চাই। ঢাকার স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের ডেস্কে থাকা ব্যক্তিগণ (উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক) মফস্বলের প্রতিনিধিদের সাথে ভালো আচরণ করেন না। একটি সংবাদ পাঠাতে বার কয়েক গাঁটের পয়সা খরচ করে ফোন করলেও তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না।
ফোন করি আমরা আর কেটে দেন তারা। এটা কোন ধরণের আচরণ তাও ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে। তারা নিজেদের কি ভাবেন তাও ঠিক বুঝতে পারিনা। অন্যান্য বৈরি আচরণতো করেনই।
যেমন ধরুন, নোয়াখালীর দুর্গম দ্বীপ হাতিয়া।
সে দ্বীপের চারপাশে আরো অনেক ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। নিঝুম দ্বীপের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ যথাসময়ে একজন সংবাদশ্রমিক পাঠালে ডেস্ক থেকে সাথে সাথে ফোন আসে সংশ্লিষ্ট সংবাদের ফুটেজ পাঠান। এটা তাহলে কি হলো? দিনে দিনে আমার পক্ষে ঢাকা থেকে ঘুরে এসে ফুটেজ পাঠানো সম্ভব। কিন্তু নিঝুমদ্বীপ! যেখানে যেতে এবং আসতে দু’দিন সময় লাগে সেখান থেকে ফুটেজ’টা কিভাবে পাঠাই? তাদের কি ভৌগলিক জ্ঞানটাও ন্যূন্যতম কাজ করে না? ডেস্কে কাজ করেন বলে সব জানেন এমন ভাব দেখানোটা কি সমীচিন কিনা তাও বিবেচনায় আনা দরকার। কারণ যিনি স্থানীয় প্রতিনিধি তার কাজ ও অভিজ্ঞতাকে খাটো করে দেখবার কোনো অবকাশ আছে বলে বোধকরি ঠিক নয়।
জেলা প্রতিনিধিরা সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তরের পিয়নদেরও বেতন ভাতা, সুযোগ-সুবিধা প্রতি বছর বাড়ে কিন্তু বছরের পর বছর মফস্বলের সংবাদ শ্রমিকদের এক চ্যানেলে একই পদে কাজ করেও ভালো পারফরমেন্স দেখিয়েও কোনো পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনাও থাকে না। বরঞ্চ কথায় কথায় শোকজ খান জেলার সংবাদ শ্রমিকরা। বছরের ধর্মীয় উৎসবসমূহেও দৈন্যতার কারণে স্ত্রী সন্তানদের কিছুই দিতে পারেন না। অনেক চ্যানেল আছে এমন উৎসবেও সংবাদ শ্রমিকদের পারিশ্রমিক সময় মত দিতে পারেন না।
উল্টো কোনো কোনো চ্যানেলের কতৃপক্ষ বলেন, আমরাতো যা হোক একটা কিছু দিই কিন্তু অন্য (এক্স-ওয়াই-জেড) চ্যানেলতো তাও দেয়না। এটা কোনো উত্তর হলো?
দেশে এখন ব্যাঙে’র ছাতার মত চ্যানেল গজিয়েছে। কালো টাকা সাদা করার তাগিদ অথবা ধনের পাহাড় গড়ার অদম্য আগ্রহ, গ্রুপ অব কোম্পানিজের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তি টেকানোর জন্য দেদার গজাচ্ছে এ চ্যানেলগুলো। কিন্তু সে অনুপাতে মান কি তৈরি হচ্ছে? যে সকল মফস্বল প্রতিনিধিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন সারাদেশে, তাদের কি কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে? যদি সাংবাদিকদের প্রতি মালিক পক্ষের বৈষম্য থেকেই যায় তাহলে চ্যানেল বাড়িয়ে লাভ কি? শুধুই কি মালিক পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ? ধনাঢ্য মালিকদের গজিয়ে ওঠা এসব চ্যানেলকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কাজ করে যাওয়া সংবাদ শ্রমিকরা কি অপুষ্টই থাকবে?
এমন একটা সময় ছিলো, মফস্বলের সাংবাদিকগণ অন্য পেশার পাশাপাশি দেশের জাতীয় দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন। তারা সম্মানির নামে কিছু পেতেন কিংবা না পেলেও অন্য কাজ করে জীবন জীবিকা চালাতেন।
কিন্তু এখনকার ঘটনাবহুল (প্রতিযোগিতার বাজারে) সময়ে চলমান সম্প্রচার যন্ত্রে (চ্যানেলে) কাজ করে অন্য কোনো পেশায় কিংবা কাজে মনোনিবেশ করা কি আজকের প্রেক্ষাপটে সম্ভব? আর সম্মানীর নামে যা করা হয় তা আসলে কি? মফস্বলের প্রতি বৈষম্যের তীর্যক তর্জনী নির্দেশ করে না? মালিকপক্ষ অথবা ব্রাহ্মণ সাংবাদিক (সাংবাদিকতার ইজারাদার, আমাদের ওপর যারা ছড়ি ঘোরান) তাহলে বলবেন- পোষালে কাজ করুন নতুবা ছেড়ে দিন। উল্টো টাকা দিয়ে কাজ করার লোক আছে। বেশ। তাহলে তাই হোক। তাহলে এমন নৈতিকতালয় (?) বন্ধ হোক।
তাহলে এমন শঠতা বন্ধ হোক।
প্রিয় পাঠক ও মফস্বলের সতীর্থগণ: ক্ষমা করবেন। লজ্জায় অনেক দৈন্য আড়াল করেছি। অনেক কষ্ট-ক্ষত বুকে পুষে রেখেছি। একদিন সংবাদ শ্রমিকেরও কথা বলবার দিন আসবে নিশ্চয়ই।
লেখক: জামাল হোসেন বিষাদ
নোয়াখালী।
মোবাইল- ০১৭১৭৫০১২৩৭
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।