ছোট বেলায় রমজান মাস এলেই খুব মজা লাগত। একটা উৎসব উৎসব ভাব আর কি। একে তো স্কুল ছুটি, তার উপর ইফতারিতে মজার মজার খাবার, আর ঈদের জামা-জুতা কেনা তো আছেই। জামার সাথে জুতার কথা বললাম ঠিকই, কিন্তু ছোটবেলায় ঈদ উপলক্ষ্যে জুতা কেনা হয়েছে খুব কম। সাধারণত বছরের কোন এক সময় এক জোড়া জুতা কেনা হত (পায়ের চেয়ে একটু বড় মাপের), সেটা যতদিন পরা যেত পরতাম, যখন আর পা ঢুকত না তখন আবার নতুন জুতা কেনা হত।
সেটা যদি ভাগ্যক্রমে ঈদের সময় হয়ে যেত তো তখন ঈদের জুতা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হত।
ক্লাস ফোর বা ফাইভে থাকতে একবার আব্বা ঈদের আগের দিন হঠাৎ বললেন, চল তোকে জুতা কিনে দিই। মটর সাইকেলে করে শুধু আমাকে নিয়ে আব্বা মার্কেটে গেলেন। নিজে পছন্দ করে জুতা কেনা সেই প্রথম। এক জোড়া টকটকে লাল জুতা কিনেছিলাম সেদিন।
খুব প্রিয় ছিল জুতা জোড়া, সব জামার সাথে ঐ লাল জুতা পরতাম। ম্যাচিং করা নিয়ে মাথা ঘামানোর বয়স তখনও হয়নি।
ইফতারের সময়টা ছিল আমার জন্য খুব মজাদার। কত মজার মজার সব খাবার। রোজা না রাখলেও সবার মত খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকা আর আযান দিলে শরবত আর খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা, এই জিনিসটা খুব ভালো লাগত।
আমি অনেক খেতাম। মুড়ি, পেঁয়াজু, ছোলাভাজা খেয়ে খেয়ে পেটটাকে একেবারে জয়ঢাক বানিয়ে ফেলতাম। একবার তো এত খেয়েছিলাম যে আমার ফ্রকের সামনে পেটের দিকের অংশ ছিড়ে গিয়েছিল, সত্যিই। সেই নিয়ে বড়পা-মেজপার সে কি হাসাহাসি। এখনও মাঝে মাঝে ঐ কথা তুলে আমাকে পচায়।
সেহরীর সময় সাধারণত ঘুম ভাঙত না, তবে মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙলে সবার সাথে খেয়ে নিতাম, রোজা রাখি বা না রাখি। পাহাড়াদার চাচ্চু টিন পিটিয়ে সবাইকে ডাকত। প্রথম যেদিন সেই ডাক শুনেছিলাম, চরম ভয় পেয়েছিলাম। ক্লাস ওয়ানে পড়তাম মনে হয় তখন। "ওঠেন, সাহরী খান, সাহরী খাওয়ার সময় হয়েছে" বলে সুর করে চিৎকার করত।
কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারিনি প্রথমে। আমি শুনেছি, "ওঠেন, সাইরঘা, সাইরঘা আসার সময় হয়েছে। " আমার মনে হয়েছিল সাইরঘা কোন ভয়ংকর প্রাণী, সেটা আসার সময় হয়েছে, তাই সবাইকে উঠে সাবধান হতে বলছে।
ভয়ে ঠান্ডা হয়ে জমে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম আর কেউ এই ব্যাপারটায় পাত্তা দিচ্ছে না।
আম্মা নির্বিকারভাবে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করতে থাকলেন। এটা নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছিলাম না। কয়েকদিন পর আব্বার কাছে পাহাড়াদার চাচ্চু টাকা নিতে আসল, তখন জানলাম যে সেহরীর জন্য সে যে সবাইকে ডাক দেয়, সেজন্য বখশিশ নিতে এসেছে। আর আমি কি বোকাটাই না হয়েছিলাম।
বড়দের মত আমারও রোজা রাখতে ইচ্ছা হত।
যেদিন সেহরী খেতাম, আম্মাকে বলতাম যে রোজা রাখব। আম্মা বলতেন, ঠিক আছে রেখো, ছোটদের দুপুর ১২টা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলেই রোজা হয়ে যায়। পরদিন ১২টার সময় আম্মা খেতে বসিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার সব সময় এই ব্যাপারটা নিয়ে খটকা লাগত, এভাবে কি আদৌ রোজা রাখা হচ্ছে? একদিন ঠিক করলাম, নাহ্, বড়দের মত পুরো রোজা রাখব, অন্তত একটা। তখন পড়ি ক্লাস টু-থ্রিতে।
ছোট বোনও আমার দেখাদেখি রোজা রাখবে বলে ঠিক করল।
পরদিন আব্বা বাজার থেকে কাঁচা আম এনেছিলেন। আম্মা আচার বানাবেন। বড় দুই বোন আম কেটে দিচ্ছিল, আমরা দুজনও টুকটাক সাহায্য করছিলাম। মাঝখানে ছোট বোন এক টুকরো আম নিয়ে কচকচ করে খাওয়া শুরু করল।
মেজপা বলল,
-এই তুমি আম খাচ্ছ কেন?
--এক টুকরা খাচ্ছি তো শুধু, বেশি খাবো না।
-আরে তুমি না রোজা?
তখন ছোট বোনের মনে পড়ল আর চোখ ছলছল করতে থাকল। আম্মা বললেন, ভুলে খেয়ে ফেললে রোজা ভাঙে না তো, আর তোমার এমনিতেই রোজা হয়ে গেছে, ১২টা তো প্রায় বাজে। ছোট বোন আমের টুকরাটা ফেলে দিয়ে কুলি করে নিল। আম্মা এরপর আমাকেও খাওয়ানোর ধান্দা করেছিলেন, কিন্তু আজকে আমি নাছোড়বান্দা।
বিকালের দিকে একটু ক্ষুধাবোধ করছিলাম বটে, সহ্য করে নিলাম। ছোট বোনটা সারাদিনে আর কিছু খায়নি, কিন্তু বিকালে আর পারল না। ইফতারের আধা ঘন্টা আগেই সে পেট ভরে খেয়ে নিল। আম্মা অবশ্য তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে সে তো ছোট মানুষ, তার সারাদিনে তিনটা রোজা রাখা হয়ে গেছে। সে মহানন্দে সবাইকে বলে বেড়াত যে সে এইবার তিনটা রোজা রেখেছে।
আমাকেও আম্মা বুঝিয়েছিলেন যে আমারও কমপক্ষে দুইটা রোজা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি এটাকে একটা রোজাই মানতাম।
ছোট ভাইটা যখন একটু বুঝতে শিখেছে তখন আমরা সবাই বড় হয়ে গেছি আর সব রোজা রাখি। আমাদের দেখে তারও খুব শখ হত রোজা রাখবে। কিন্তু সে কিছুতেই সেহরীর সময় উঠতে পারত না।
আমাদেরকে বলত, তোমরা আমাকে ডাক দিবা, যদি না উঠি তো আমার গায়ে পানি ঢেলে দিবা, না হলে বিছানা থেকে টেনে মেঝেতে ফেলে দিবা, আর নাহলে আমার গায়ের লেপ সরিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিবা। (তখন খুব শীতের মধ্যে রোজার মাস পড়ত। ) কিন্তু তাকে উঠানোর জন্য এত ঝামেলার মধ্যে কেউ যেতে চাইত না, তাই ছোট থাকতে ওর আর রোজা রাখাও হয়নি।
ভাগ্নেও হয়েছে মামার আদর্শে উজ্জীবিত। ওকে যদি বলি সেহরীর সময় উঠতে পারো তো? বলে, উঠতেও পারি না, কেউ উঠাতেও পারে না।
দেখা যাক কবে সে তার প্রথম রোজা রাখতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।