আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বহুদিন পর গাঁয়ে ফেরার অভিজ্ঞতা যেভাবে মিশে আছে আমার ভাবাবেগের সাথে

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গাঁয়ে যাচ্ছি আমি। না না, গাঁ নয়। গাঁ বললে আমার যাত্রার গন্তব্যটা কোন নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যাবে যে! আমি যাচ্ছি আমার শৈশবের কাছে, আমার স্মৃতির কাছে, সুখ পবনের নায়ে চড়ব বলে। সেখানে বাঁশ ঝাড় আর আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা গ্রাম থাকবে, পথের ধূলোয় সাথে পায়ে চলা মানুষের বন্ধুত্ব থাকবে, আমার স্বর্ণালী শৈশবকে আগলে ধরে শস্যক্ষেত থাকবে, মটরশুটি আর ফুলের গায়ে প্রজাপতির নাচন দোলায় ঘাসফুলের লোভাতুর চাওনি থাকবে, দীঘির শান্ত জলে হংস মিথুনের খেলার মাতমে পানকৌড়িদের ছুটোছুটি থাকবে।

আর থাকবে নবান্নের পিঠে-পায়েস বানাবার ব্যস্ত মুহূর্তে বেজে উঠা মায়ের হাতের কাঁকনের রিনিঝিনি সুর। আমি যাচ্ছি নয়, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভিতর থেকে উঠে আসা এক কূলপ্লাবী আবেগ। আচ্ছা, আমি কি করব? আমি কি কেঁদে ফেলব শৈশবের আলিঙ্গনে নিজকে আবিস্কার করে? নাকি আনন্দ-উত্তেজনা আর সুখের উল্লাসে নিজের চারপাশকে কিংবা বয়সের গন্ডীকে ভুলে ছুটোছুটি শুরু করে দিব ক্ষেত-মাঠ-প্রান্তর জুড়ে? কিন্তু ওদেরকে কোথায় পাব? শৈশবের সোনালী জালে জড়িয়ে থাকা আমার সেই খেলাঘরটা এখনও আমাকে ডাকে। বউছি আর এক্কা-দোক্কা খেলার সাথীদের আজ আমার বড় দরকার। ওদেরকে ছাড়া আমার ছুটোছুটির প্রান্তর নির্জীব শূণ্যতায় ভরে থাকবে যে! রিকশা এগিয়ে চলছে।

এই তো আর একটু দূরেই আমার গ্রাম। আমার সেই ছোট্র আমিটা সেখানে আমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। ওকে আমি আমার আসার খবর দেইনি কিন্তু! তবু ও জানে আমি ঠি--ক আসব। তাই তো ওর এমন উন্মুখ প্রতীক্ষা। কিন্তু আমার যে এখানেই নেমে পড়তে ইচ্ছে করছে! স্কুলের ঘন্টা পড়ার শব্দটা কানে বেজেই চলছে।

ঐ তো স্কুলের মাঠের কোণে খালের পাশের তেতুল গাছটা। আমাকে হাত ইশারায় ডাকছে। ওর পাতার ঝির ঝির কাঁপুনির ভাষা আমি ঠি--ক বুঝতে পারছি। ও আমাকে চিনেছে, আমাকেই ডাকছে। ঐ তো তেতুল গাছের ছায়ায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সহপাঠীরা।

ওদের সাথে সুর করে এক দুই এর নামতা পড়ব আমি। এই রিকশা থামো! তেতুল গাছের গোড়ার মোটা শেকড়টা ওরকমই আছে। বুড়ো চাচার দোকান থেকে বুট-বাদাম কিনে সেগুলো তো ওর গায়ে বসেই সাবাড় করতাম। সামনের খালের পানিতে ছুড়ে মারতাম খোসাগুলো। স্রোতের টানে ওগুলো ভেসে যেত ল্ক্ষ্যহীন কোন উদ্দেশ্যের পাণে।

কিন্তু এত শীর্ণকায় কেন খালটা? ওর স্রোতস্বীনি রূপটাই বা কোথায় হারিয়ে গেল? আর মাথার উপরের ঐ তেতুল গাছটা! সেটাও তো কেমন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে। এর ছায়াটাও যেন আগের মতো স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে না। ছড়াবে কেমন করে? আমি তো ভুলেই গেছি। আমারই তো সাথী সে। বয়সটা তো ওরও বেড়েছে।

তাই তো! দোকানে বুড়ো চাচাকে তো দেখলাম না! আমরাই বুড়ো হতে চললাম। আর সে! হয়ত অনেক আগেই মায়া ছেড়েছে এই পৃথিবীর। তাহলে কি আমার স্মৃতির সুখ সরোবরটাও বয়সের ভারে এমনিভাবেই নেতিয়ে পড়েছে? আমি তো যাচ্ছি তারই কাছে, তার ডাকে। সে যে আমার জন্য অপেক্ষার প্রহরের বুকে সম্ভাব্য সুখের উল্লাসে নেচে চলছে। উঠে বসলাম রিকশায়।

দুইপাশে সোনালী ধানের কূলহারা রূপের আহবান। মাঝখানে দুই একটা বাড়ি। এই বাড়িগুলো তো আগে ছিল না! রাস্তার দূরত্ব কমাতে ক্ষেত কোণাকুণি এদিক দিয়ে কত স্কুল-বাড়ি করেছি! মানব সন্তানদের ক্রমবর্ধমান গতি মুছে দিয়েছে আমার শৈশবের সেই পথরেখা। আরে! এই তো রাস্তার উপরের বাড়িটা আগের মতোই আছে। কত এসেছি এই বাড়িতে! আচ্ছা! ফরিদাকে কি পাওয়া যাবে এখানে? পৃথিবীর অলংঘনীয় নিয়মের আবর্তে পড়ে কোন এক নতুন ঠিকানায় হয়ত সে তার নোঙর ফেলেছে।

আচ্ছা, ফরিদা কি আমাকে চিনতে পারবে? ও কি আমার মতো শৈশব স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে নিজকে খোঁজে? ক্লাসের ফাঁকের আনন্দমুখর লুকোচুরি খেলার ক্ষণগুলো কি ওর স্মরণের প্রান্তর ধরে কখনও টান দেয় না? হয়ত দেয়, হয়ত দেয় না। ও তো শৈশবের আঙিনা ঘিরেই আছে। সেই যে একবার গ্রামের খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ফরিদা প্রাইমারীর গন্ডি পেরিয়ে আর এগোতে পারেনি। বিয়ে হয়ে গেছে এলাকাতেই। কাজেই আমার মতো চাকুরীর সোনালী সূতোর টানে শহুরে জীবনকে আগলে ধরে যান্ত্রিক মানবী হয়ে উঠা হয়নি ফরিদার।

এই তো ভালো। অতীতের আবছায়া থেকে সুখ কুড়ানোর জন্য ওর মনটা আমার মতো এমন লোভাতুর হয়ে উঠে না কখনও। এই যে ভাই, আপনি এদিক দিয়ে যাচ্ছেন কেন? বড় দীঘির হাট দিয়ে গেলে তো আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছা যেত। রিকশাওয়ালাকে বললাম। রিকশার ধীর মন্থর গতি আরও ধীর হয়ে এলো।

রিকশাওয়ালার কথা কানে এসে বাজল। আপা, ঐ রাস্তা দিয়ে এখন আর রিকশা যায় না। স্কুলের হাট দিয়া নতুন রাস্তা হইছে। ঐদিক দিয়া যাইতে অইব। ঠিক আছে, যান।

আমি কি কাঁদছি? বুকের ভিতরে একটা ঘন শ্বাস যেন রিন রিনিয়ে উঠছে। হ্যাঁ, তাই তো। সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা মনটা এমন একটা ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আচ্ছা, বড় দীঘির পাড়ের হাটটা কি আগের মতো বৃহস্পতিবার আর রবিবার বিকেলে বসে? আর ঐ দীঘির পূব পাড়ের ঈদগাহের মাঠ। সেটা কি তার রূপ যৌবন হারিয়ে রাস্তাটার মতো নিজের ঐতিহ্যমাখা অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে নিভু নিভু জ্বলছে? আব্বা ছুটিতে বাড়ি আসলে উনার হাত ধরে বড় দীঘির হাটে আসাটা ছিল আমার অনেক দিনের লোভাতুর পাওয়ার মধ্যে একটি।

আর ঈদের নামাজে পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের সাথে দল বেঁধে না আসলে যেন ঈদই করা হতো না। আমাদেরকে বড় আম গাছটার নীচে দাঁড় করিয়ে রেখে আব্বা নামাজে দাঁড়াতেন। বলে যেতেন, খবরদার কোথাও যাবে না কিন্তু। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে মুসুল্লীদের নামাজ পড়ার দৃশ্য দেখতাম। একসাথে যখন সবাই সেজদায় যেত তখন একই সমতলে এতগুলো মানুষের পিঠের যে দৃশ্য সৃষ্টি হতো তার তুলনা হয় না।

আজও সেই দৃশ্য আমার চোখের পর্দায় লেগে আছে অবিকৃতরূপে। একি, আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছ যে বড়! কথা বলছে ঈদের মাঠ, হাট, পায়ে চলার রাস্তা, রাস্তার দুই পাশের বিস্তীর্ণ মাঠ-প্রান্তর। আমি না আমার শৈশবকে ছুঁয়ে দেখতে এসেছি? শৈশবকে ছুঁয়ে দেখতে হলে তো এদেরই কাছে যেতে হবে, কান পাততে হবে এদের বুকে। এরাই আমার শৈশব, এরাই আমার সুখের সুরেলা প্রান্তর, স্মৃতির বিস্তীর্ণ সরোবর। আচ্ছা, এখন না হয় চলেই যাই।

বাড়িটা তো সামনেই। ওদেরকে নিয়ে অতীতের সরোবরে ডুব দেবার ফুরসৎ পরে করে নিব। এই রাখো, রাখো। আর যেতে হবে না। বাকীটুকু রাস্তা আমি হেঁটে যাব।

বাড়িটা তো দেখাই যাচ্ছে। দীঘির পূব পাড়ের তাল গাছটা সেই যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে! আছে তো আছেই। আমার মতো স্মৃতির অহর্নিশ পিছুটানে ছায়া বীথিঘেরা গাঁয়ের বুকে যারা ফিরে আসবে তাদেরকে পথ চিনাবার দায়িত্বটা যেন তারই। সামনের এই তিনটা ক্ষেত পেরোলেই দীঘির পাড়। দীঘির নামার ক্ষেতটা বুক জুড়ে সোনালী ধানের হিল্লোল তুলে অপেক্ষায় আছে সে তো আমারই জন্য।

ওর পাশ দিয়ে রিকশায় চড়ে গেলে ও আহত হবে নিশ্চয়ই। ওর গর্বিত শরীর সঞ্চারণ সে তো আমারই জন্য। আমি তো এসেছি এদের টানেই। তাহলে কেন উপেক্ষা করব এদের? আচ্ছা, নামার এই ক্ষেতটাতে বর্ষাকালে যে নানারকমের ছোট মাছ কিলবিল করত এখনও কি বর্ষা এলে এরা আসে? কাকে জিজ্ঞেস করব? ঐ তো পুকুরের ওপাড়ে কদবানু মাজেদা বউছি খেলার আয়োজন করছে। এই কদবানু আয়, আজ আর বউছি খেলব না।

এক্কা-দোক্কা খেলব। চল যাই বেল গাছের তলায়। উঃ। বেল গাছের মোটা শেকড়টায় হোঁচট খাওয়ার সাথে সাথে আমার কল্পনার সোনালী জালটা ছিঁড়ে যায়। আমি ফিরে আসি বর্তমানে।

পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণের বেল গাছটাই নেই! জলচৌকির মতো উচুঁ মোটা শেকড়টাও তো কেটে ফেলা হয়েছে। আমি আসলে হোঁচট খেয়েছি স্মৃতির খেলাঘরে। বউছি খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে তাহলে এখন আমি বসব কোথায়? রান্নাবাড়ি খেলার আয়োজনটাও তো হতো এই শেকড়টার উপর বসে। বুকের ভিতর পুষে রাখা ছোট্র টুনি পাখিটা আহত হয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে। ওকে থামানো দরকার।

নইলে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ওর ডানা দুটি একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যাবে। আচ্ছা কোথায় আমার সেই টুনি পাখিটা? আমার শৈশবের প্রাণ ভোমরা তো সেই! আমাকে যে তাকে খোঁজে পেতেই হবে। আমি আমার চারপাশে ওর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। হাত বাড়িয়ে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে সে আমাকে কাছে ডাকছে। এই গাঁয়ের এই বাড়ির বাঁশঝাড়, বনবাদাড়, আলো-বাতাস-পুকুর ঘাট, শস্যক্ষেত এসব কিছুর কাছে তাকে আমি আমানত রেখে গিয়েছিলাম।

আর এরা অতি যত্নে আমার সেই স্বপ্নঘেরা বর্ণিল শৈশবকে আগলে রেখেছে, ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। এটা আমার প্রতি এদের ভালবাসা আর মমতামাখা আবেগের সামান্য প্রকাশ মাত্র। জানি না আমার জন্য আর কত ভালবাসা এরা লালন করে আসছে এতদিন ধরে। আমি কি পারব এদেরকে এই আবেগের পুরোটা ফিরিয়ে দিতে? পারতেই হবে আমাকে। আচ্ছা, পুকুর ঘাটটা না পুকুরের পশ্চিম দিকে ছিল? ও--, ওটাও আছে।

উত্তর দিকেরটা তাহলে আর একটা। পরিবার বিভাজনের সাথে সাথে সহায়-সম্পত্তি ভাগ হয় জানি। আজ দেখছি এর থাবা পুকুর ঘাট পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। কিন্তু এ ঘাটটা কারা ব্যবহার করে? এ ঘাটেই নেমে দেখি না! পুকুরের পানি কি আগের মতোই আছে? নাকি সময়ের বুকে বয়সের আঁছড় কাটার মতোই বদলে গেছে এর অনেক কিছু। এক আজলা পানি নিয়ে নাকে মুখে ছিটিয়ে দিলাম।

আহাঃ কি শান্তি। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে যত ক্লেদাক্ত অনুভূতির স্পর্শ লেগেছে মনে সব যেন এক মুহূর্তে ধূয়ে সাফ হয়ে গেছে। আর এক আজলা! আর এক আজলা!! এভাবে পানির ঝাপটা দিতে দিতে প্রায় পুরো শরীরটাই ভিজে সার। বাকীটা শুকনো রেখে আর কি হবে? নেমে পড়লেই হয়। কিন্তু আমি যে সাঁতার জানি না।

আব্বা কোথায়? আব্বা! দু’হাতে বাবার কোমড় আঁকড়ে ধরে সাঁতার শিখব আমি। চকিতে দৃষ্টি চলে যায় দীঘির দক্ষিণ পূর্ব কোণে বাবার কবরটার দিকে। নিজের চিরচেনা মাটির বুকে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন বাবা। পুকুর তলার মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা হলো না আমার। উঠে এসে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম বাবার কবরটার কাছে।

বাবা, তুমি আমায় ক্ষমা করো বাবা। তোমাকে এখানে শুইয়ে রেখে সেই যে গিয়েছি আর আসা হয়নি। তাতে কি? এসেছিস তো! এতেই আমি খুশী হয়েছি। হ্যাঁ বাবা, এসেছি। এই গাছপালা মাটি-হাওয়ার টানে।

যে আমাকে তুমি কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে সেই আমাকে খোঁজে পেতে। আমি এদের কাছে ঋণী বাবা। এরা তোমাকে পরম মমতায় এতটা দিন বুকে ধরে আছে। ঐ তো, ঐ তো আমার মা। বাবার পাশের কবরটাতে নাম খোদাই করা রয়েছে।

জীবনে মরণে সাথী হয়ে থাকার অঙ্গীকার পূরণ করছে যেন আমার মা-বাবা। মা! তোমার কাছে ক্ষমা চাইব সেও তো পারছি না। জীবনে আরও বড় কিছু পাবার আকাংখায় নিজের মায়াবী অঙ্গনের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেলাম অনেক দূরে। আর বুক ভরা অভিমান নিয়ে তুমি চলে গেলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে। মা, পৃথিবীতে তোমার শেষ মুখচ্ছবিটা আমার দেখা হলো না।

কিন্তু মা, আজ আমি যেদিকেই তাকাচ্ছি, যেখানেই কান পাতছি তোমাকে দেখছি, তোমাকেই অনুভব করছি। মা, আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব থেকে আমি আজ অনেক কিছুই কুড়িয়ে নিতে পারছি। কিন্তু তোমার আঁচলের শান্ত হাওয়া আমি কোথায় পাব মা? এজন্যে দুঃখ করিস না। চারদিকে তাকিয়ে দেখ তোকে পেয়ে কেমন প্রাণের স্পন্দনে জেগে উঠেছে এই গ্রাম, শস্যক্ষেত, আলো-হাওয়া, ছায়া-তরুর খেলা। এই সব কিছুর মধ্যেই তো জড়িয়ে আছি আমি।

আজ যত পারিস এসবকে তোর অনুভবের সাথে জড়িয়ে নে। দেখবি আমি আছি তোর নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, সারা অন্তর জুড়ে। এসব কিছুর মধ্যেই আমি তোর জন্যে আমার আর্শীবাদ রেখে এসেছি। দুই ঠোঁটের ফাঁকে এক ফোটা তপ্ত অশ্রু মায়ের স্নেহের আস্বাদন থেকে আমাকে মুহূর্তেই ফিরিয়ে আনে বাস্তবে। হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছে পা বাড়াই ভিতর বাড়ির দিকে।

আমি ফিরে এসেছি আমার শৈশবের ক্রোড়ে। কত কান্না-হাসির স্মৃতি, মান-অভিমানের দৃশ্যপট লুকিয়ে আছে শৈশবের অবগুন্ঠনে তা হিসেব করে বলার সাধ্য কি কারও আছে? লুকোচুরি খেলার সেই ছোট্র ঝোপ-জংগল, বন-বাদাড়, বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় বসে পুতুল বিয়ের রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আচারের বোয়াম চুরির অভিযান এসবের দৃশ্যপট মনকে যতটা না ভারাক্রান্ত করে তুলছে তার চেয়ে বেশী সুখের নির্মল আবহে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই তো বারান্দা। উঃ একটা চাঁদনী রাত যদি আমি এই মুহূর্তে পেতাম! বারান্দায় পাটি পেতে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরীদের গল্প শুনার জন্যে মনটা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছে আমার। আমি এখন কি করব? দরজায় আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকব নাকি একটু ক্ষণের জন্যে বারান্দায় বসব? কিন্তু সেই বেঞ্চিটা তো নেই! প্রতিবেশীরা কোন দরকারে আমাদের বাড়িতে আসলে এই বেঞ্চিতে বসত, নানা রকম গল্প-গজব করত, তারপর চলে যেত।

আজ কেউ নেই, কোথাও নেই। বসার বেঞ্চিটাও নেই। সবকিছু পতিত রাজবাড়ীর মতো নীরব নিথর। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক চড়ুই কিচির-মিচির আওয়াজ তুলে উড়ে গেল। বুঝলাম আমার চঞ্চল শৈশবের জলসাঘরটা চড়ুই পাখিদের আনন্দ বাসর হয়ে উঠেছে ।

কিন্তু আমার স্মৃতির রংমহলে আমি এই ঘরটাকে যে আগের মতোই দেখতে চাই। কখন ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি নিজেই টের পাইনি। হঠাৎ করে নিজেদের সাজানো পৃথিবীতে একজন মানুষের উপস্থিতি ব্যাঘাত ঘটায় এখানকার বসতিদের নিয়মাচারে। পায়ের কাছ দিয়ে দৌড়ে পালায় দুটো চিকা। স্বপ্নের রংমহলা থেকে আমি ফিরে আসি।

ভালো করে তাকাই ঘরটার চারপাশে। দেয়ালগুলো স্যাঁতস্যাতে আস্তরণের আড়ালে নিজেদের আসল চেহারা হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই, একটা কটু গন্ধ নাকে এসে লাগে। কিন্তু নাঃ আমি আমাকে বিফল হতে দিব না। এই জরাজীর্ণ আলয় থেকে আমার স্মৃতিমুখর শৈশবকে বের করে আনতেই হবে। ঐ তো কাঠের কারুকাজ করা দাদীর আমলের আলমারীটা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

আমার শৈশবকে বর্ণিল ভালবাসায় আগলে রাখতে রাখতে সে আজ বড় বেশী ক্লান্ত। ভেঙে পড়েছে তার দেহ সৌষ্টব। ধূলোর আস্তরণ সরিয়ে আলতো করে হাত রাখলাম আলমারীটার গায়ে। সাথে সাথে আমার অনুভূতির অলিন্দ নেড়ে উঠল। ও আমাকে চিনতে পেরেছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছে। আরও কিছু পাওয়ার লোভে চারপাশে তাকালাম। নাঃ শৈশবকে ছুঁয়ে দেখার মতো আর কিছু নেই ঘরে। তাই অনেকক্ষণ ধরে ছুঁয়ে থাকলাম আলমারীটা। এক ঝাঁক চড়ুই এর কিচির মিচির শব্দে আমার মগ্নতা কেটে যায়।

তাই তো! সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ওরা ফিরে এসেছে ওদের ঠিকানায়। দিনমানের সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ওরা এখন প্রশান্তির কোলে আশ্রয় নিবে। আমার উপস্থিতি ওরা মেনে নিবে কেন? কিন্তু আমার দেহ-মনের ক্লান্তি আমি জুড়াব কি দিয়ে? সন্ধ্যার কাছে মিনতি করে বলি, দে না । আমার ছেলেবেলার অন্তত একটি সন্ধ্যাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে না! গোধূলীর আলোয় গরুর পাল নিয়ে রাখাল ছেলের ঘরে ফেরার দৃশ্য, কলসী কাখে পুকুর ঘাট থেকে বউ-ঝিদের পানি আনার ব্যস্ততা, বাঁশ-ঝাড়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণায় প্যাঁচাদের নিরলস চেষ্টা এসবের আবেদন আজ বড় বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়ছে আমার।

কিন্তু কোথায় পাব এদের? শহুরে সভ্যতার যে যান্ত্রিক নিগঢ়ে আটকা পড়ে আছে জীবন তা থেকে বের হয়ে আসা কি আদৌ সম্ভব? দিনান্তের পাট চুকিয়ে সূর্য যতই রাতের অভিসারে নিজকে সমর্পণ করতে এগিয়ে যাচ্ছে ততই মনটা ছুটে যাচ্ছে আলো ঝলমল যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে। শৈশবের কাছে আমার অপরাধের রোজনামচাটা আরও দীর্ঘায়িত হবে জেনেও ত্রস্তে পা বাড়ালাম আমি। যতই এগুচ্ছি ফিরে যাবার পাণে ততই বেশী করে কানে বাজছে সুর-তাল-লয়ে বাঁধা শৈশবের স্মৃতি গাঁথা। মনের আঙ্গিনায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে ওর আজকের পা ফেলা। এ নিয়েই হবে আমার অনাগত সময়ের বেঁচে থাকা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।