আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও তার নড়বড়ে নাটবল্টু

পারলৌকিক হ্যাঙ্গারে হ্যাঙ্গ হয়ে আছে ইহকাল / পুনরায় জন্ম নেয়া এখন বিশেষ প্রয়োজন

বাঙলাদেশে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে জীবনের শুরুতেই চরম শিক্ষা হয়ে যায় শিক্ষার্থীর। শৈশবেই তাকে গ্রহণ করতে হয় বাবা মায়ের চাপিয়ে দেয়া কিছু মেকী-বানানো শিষ্টাচার, ধর্মীয় শিক্ষা এবং বৈষম্যমূলক আদব কায়দা। বিষয়গুলো শৈশব থেকেই একটি শিশুর ছোট্ট মগজের উপর বজ্রপাতের মত আঘাত করে। তাকে করে তোলে প্রতিক্রিয়াশীল। তোতা পাখিকে বুলি শেখানোর মত করে তাকে শেখানো হয় বহু মিথ্যা-মনগড়া-পৌরানিক-অবাস্তব এবং খানিকটা ভৌতিক শিক্ষা।

ঈশ্বরকে চাপিয়ে দেয়া হয় তার ছোট্ট কাঁধে, যাঁকে সে বহন করতেও পারে না ফেলেও দিতে পারে না। সেই ছোট্ট বেলা থেকে তাকে হয়ে উঠতে হয় পূজারি বা ঈশ্বরের সেবক। এতে ঈশ্বর বা সে কোনো মতেই উপকৃত বা আনন্দিত হয় না। উপকৃত হয় আমাদের সমাজের ধর্মব্যবসায়ীরা। রবিনসন ক্রুসো উপন্যাসে ক্রসো যখন জাহাজডুবে একটি দ্বীপে বহুদিন আটকে ছিলো সম্পূর্ণ একা এবং কিছুদিন পর তার সঙ্গী হয়েছিল এক বর্বর মানুষ।

ক্রুসো তার নাম দিয়েছিল ফ্রাইডে। ক্রুসো তাকে শিখিয়েছিল ভাষা, বাইবেল অনুসারে শিখিয়েছিলো পৃথিবী, মানুষ ও এর সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের কর্তব্য সম্পর্কে, সজাগ করেছিলো সৃষ্টিকর্তা ও মানুষের শত্রু সম্পর্কে। ফ্রাইডে তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মনিব, ঈশ্বরতো সবাইকে মাফ করে দেন, তবে কেন শয়তানকে মাফ করছেন না। ’ ক্রুসো কোনো জবাব দিতে না পেরে চুপ হয়ে গিয়েছিল। এরকম হাজারো প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় প্রথাগত ধর্ম ও নিয়মকানুন নিয়ে এবং সেগুলোর যৌক্তিক কোনো উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে থাকতে থাকতে পেরিয়ে গেছে হাজারো বছর।

প্রশ্ন বা বিশ্বাস কোনোটাই বাতিল হয়নি; বরং মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে সেগুলো। যদি কখনও কোনো শিশু প্রশ্ন উত্থাপন করে এসব বিষয় নিয়ে তবে তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। খ ব র দা র ! কোনো প্রশ্ন নয়। যা বলছি সেটাই বিশ্বাস করতে হবে। তার পাঠ্য পুস্তকে পরিবেশন করা হয় অন্ধকার, তাকে শেখানোর জন্য যে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় তিনিও বিশ্বব্যাংকের অঘোষিত কর্মচারী।

বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে অন্ধকার বাঁচিয়ে রাখার শিক্ষা দিয়ে চলেছেন তারা বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিবন্ধিত অসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাদ্রাসা সংলগ্ন এবতেদায়ী মাদ্রাসা, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়, স্যাটেলাইট বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, এনজিও পরিচালিত পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও। ছোট্ট একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টির ধারণা দেয়া যায় কিভাবে মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থীর দু’টি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক তাকে স্ববিরোধী তথ্য সরবরাহ করছে। সামাজিক বিজ্ঞানে তাকে শেখানো হচ্ছে, মানুষ আগে অসভ্য ছিলো, উলঙ্গ হয়ে বনে জঙ্গলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো, ফলমূল সংগ্রহ করতো, তাদের ভাষা ছিলো না, তারা ইশারায় কথপকথন চালাতো এবং বিভিন্ন সময় বৃক্ষ আগুন এসবের পূজা-আরাধনা করতো। আর ধর্ম শিক্ষা (ইসলাম ধর্ম বিশেষত) বইতে বলা হচ্ছে আদম ও হাওয়া পৃথিবীর প্রথম দু’জন মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আবিভূত (স্বর্গচূত) হয়েছেন। আল্লার নির্দেশে তারা সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিষয়গুলো মেলাতে না পারা ছোট্ট শিশুরা প্রশ্ন করে বিপাকে পড়ে যায় এবং একটি আত্মঘাতী পথ খুঁজে পায় আর তা হলো না বুঝে মুখস্ত করা। বিজ্ঞান গণিতের ক্ষেত্রেও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন বিপজ্জনক। বাঙলাদেশের স্কুলগুলোতে বেঁতের প্রকোপ আজো কমেনি। এই অবস্থা থেকে ঝরে পড়তে পড়তে যে কজন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথে অগ্রসর হয় তাদের অভিভাবকেরা তাদের বেঁধে দেন তাদের লক্ষ্য...তোমাকে হতে হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার...ইত্যাদি। যদিও এই ধরে দেওয়া বেঁধে দেওয়ার রীতিটি চলে আসে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই।

যে ছাত্রটি বরাবর ক্লাসে সামনের সারিতে বসে নবম শ্রেনীতে উঠে সে নেয় বিজ্ঞান, যে মধ্য সারিতে বসে সে নেয় ব্যবসায় শিক্ষা আর শেষের দিকে যারা বসে তারা নেয় কলা। কারণ শিক্ষকরা প্রতিটি ছাত্রের প্রতি সমান নজর দিয়ে তাদের শেখাতে পারেন না, তারা প্রতিদিন একটু একটু করে মেধাহীন (শিক্ষক বিবেচিত) হয়ে পড়ে এবং বিজ্ঞান পড়তে না পারার কারণে তাকে ব্যবসা বা কলা পড়তে হয় এবং বাণিজ্যিক মানসিকতার কলার পিচ্ছিল খোসায় পা রেখে তাকে ছিটকে পড়তে হয় শিক্ষাজীবন থেকে কখনওবা সচ্ছল কর্মজীবন থেকে। এছাড়া তাদের থাকে না মুক্ত শিক্ষা চর্চার সুযোগ; সিলেবাস সাজেশন এবং বেঁধে দেওয়া শিক্ষায় তারা পাশ করে মেধাবী বনে যায়, এ প্লাসের বাম্পার ফলন হয়। যে কোনো শিক্ষিত যুক্তিমান মানুষ বোঝেন, এ প্লাস বৃদ্ধি মানেই মেধার চরম উৎকর্ষ সাধন নয়। এই কোটি কোটি এ প্লাস থেকে একজন স্টিফেন হকিন্সের আবির্ভাব সম্ভব নয়।

উচ্চ শিক্ষার সময়ও তারা বেছে নিতে পারে না তাদের প্রিয় ও আগ্রহের বিষয়। সাহিত্য নিয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছাত্রটিকে পড়তে হয় ব্যবসাবিজ্ঞান নিয়ে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের নিপীড়িত হতে হয় জীবনের পদে পদে এমনকি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও। খুব কম ছাত্রই কাঙ্খিত বিষয়টি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়, বাকী সবাই যে যেই বিষয় নিয়ে পড়ে, বাধ্য হয়ে। এ বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী এ প্লাস পেয়েছে সে পরিমাণ আসন নেই সারা বাঙলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও। ডাক্তারী পড়তে ইচ্ছুক নয় যে ছাত্র ডাক্তারী তাকে পড়তেই হয় যেকোনো মূল্যে।

প্রয়োজনে লক্ষ টাকায় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তার সেই ছোট্ট বেলায় শেখানো ধর্ম-নৈতিক শিক্ষা কাজে আসে না। যারা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত তারা হয়তো ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র, বাণিজ্য ও অর্থ উপার্জন তাদের কাছে ছোটবেলায় শেখা নৈতিক শিক্ষার প্রয়োগের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বাঙলাদেশের প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন একইভাবে ফাঁস হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে।

বহু বিসিএস ক্যাডার, নন ক্যাডার এই কর্মকান্ডগুলো সহ আরো বহু নীতি বহির্ভূত কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। এতে কি কোনোভাবেই মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে? একে কি শিক্ষা বলা যায়। সর্বচ্চ শিক্ষিত মানুষটি কি তার দায়িত্বের প্রতি সচেতন? বাঙলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে দেখা যায় একটি নোংড়া প্রবনতা তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যামে দেশের বাইরে ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া এমনকি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনও তোলা থেকে বিরত না থাকা। কৃষকের শ্রমিকের পয়সায় লেখাপড়া করে তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা তারা মনে রাখে না। এই মুহুর্তে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তন সাধন, একে উন্মুক্ত করে দেয়া এবং সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো।

যাতে সেটি হয় যুগপযোগী, মুক্ত এবং সত্যিকারের উন্নয়নের সহায়ক। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বলেছেন, শিক্ষার মধ্য দিয়ে একজন ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে’ সক্ষম হয় যাতে সে ‘বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের সাড়া’ পেতে পারে। প্রকৃত শিক্ষা তাই হওয়া প্রয়োজন যে কোনো প্রকারের আধিপত্যহীন, কূপমন্ডুকতাবর্জিত ও বৈষম্যহীন। রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন, ‘যতটুকু আবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। ... আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না।

স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.