পারলৌকিক হ্যাঙ্গারে হ্যাঙ্গ হয়ে আছে ইহকাল / পুনরায় জন্ম নেয়া এখন বিশেষ প্রয়োজন
নেপোলিয়ান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কার্ল মার্কস্ লিখেছিলেন যে, ইতিহাসের এক পরিহাস হচ্ছে অনেক সময় ইঁদুর সিংহ হিসেবে দেখা দেয়। বাঙালির ইতিহাসে ইঁদুর সিংহ হয়েই শুধু দেখা দেয়নি ইতিহাস লিখিতও হয়েছে শোষকগোষ্ঠীর পরাজিত সেবকদের হাতে। তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাসেরই বোধ হয় পরিনতি হয় এটাই যে তা লিখিত হবে প্রথম বিশ্বের প্রভুদের ইশারায় তৃতীয় বিশ্বের গোলামদের হাতে। তবে সঠিক ইতিহাস বা তথ্য কখনো হারিয়ে যায় না; কারণ তথ্য হচ্ছে শক্তি, নিত্যতা বিধি মোতাবেক তা শুধু রূপান্তরিত হয় মাত্র। মানুষের মুখে মুখে, গল্প-কবিতা-উপন্যাসে, চিত্রকলা-- শিল্পকলায় তা স্থান পায় মহান অনুসঙ্গ রূপে।
বাংলার ইতিহাস খুব বেশি মর্যাদা সম্পন্ন নয়। বংশপরম্পরায় পাল-মোগল-বৃটিশ-পাকিস্তানের গোলামী করতে করতে এ জাতির মজ্জায় গোলামী নামক জৈবিক উপাদান সৃষ্টি হয়েছে হয়তো। সেই গোলামীর ধারাবাহিকতায় বাঙলার সাম্প্রতিক অর্জনের ইতিহাসের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিকৃতি। একাত্তরের ঘৃন্যতম বিরোধী পক্ষই হয়ে উঠেছে এদেশের ভাগ্য নিয়ন্তা, যারা একাত্তরে নিয়েছিলো পাকিস্তানের গোলামের ভূমিকা। এছাড়াও রয়েছে এক সুবিধাবাদী পক্ষ, যারা সবসময় সুজোগ খুঁজেছে কীভাবে কোন পক্ষে অবস্থান নিলে পাওয়া যাবে ক্ষমতা; নিজেদের ঐতিহাসিক অপকর্মকে মহান কর্মের লেবাসে ঢেকে মহামানব খেতাব ধারণ করতে গিয়ে তারা সময়ের অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে করে তোলে বিদ্রোহী-রাষ্ট্রদ্রোহী; যুগে যুগে যীশুদের মত ক্রুশবিদ্ধ হবার পরিণতি বরণ করতে হয় সেই মহান মানুষদের আর সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় অনেক সোনালী অর্জনের নাম-ফলকের নাম।
কিন্তু সত্য সে এমন এক বিমূর্ত অলঙ্কার যাকে সময়ে কাজে লাগানো না গেলেও সময় ফুড়োলে তাকে ইতিহাসের পাশাপাশি প্রতি-ইতিহাসে, দেয়ালে বা শোকেসে সাজিয়ে রাখা হয়; কখনো কখনো আবার পুঁজো দেয়া হয়। কমরেড আবু তাহের বিকৃত ইতিহাসের পাশে দাঁড়িয়ে পরা এক প্রতি-ইতিহাস, আঁতুর বাঙলাদেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এক মূল্যবান চিত্রকলা, এক শৈল্পিক দৃশ্যপট। আবু তাহের স্বয়ং এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের নাম। দেশকে বৈষম্য-শোষনহীন মুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ উপহার দিতে চেয়েছিলেন এই বিপ্লবী যিনি ভিতরে বাহিরে সদা লালন আর চর্চা করতেন যুদ্ধ, চাষ করতেন মুক্তির স্বপ্ন, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন। তাঁর সেই স্বপ্ন আবিষ্কৃত হয়েছিল তাঁর শৈশবের যে স্কুল শিক্ষকের হাতে তিনি কাঁচকে হীরে ভেবে ভুল করেননি।
সূর্যসেনের সঙ্গী হিসেবে তিনি চিনে নিয়েছিলেন আরেক সূর্য সৈন্য, তাহেরকে। তাহেরের স্বপ্নকে তিনি দিয়েছিলেন আলো-হাওয়া-প্রেম। সেই স্বপ্নের হেম আবু তাহেরকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল এক মহানুভবতার আলো; ঐ আলোকিত বুক নিয়ে যেখানেই গিয়েছেন আলোকিত করে রেখেছিলেন আশপাশ। পৃথিবীর যে কোনো সেনাবাহিনীতে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতির দুর্লভ প্রশিক্ষণ তিনি নিয়েছিলেন শুধুমাত্র দেশকে একটি দীর্ঘমেয়াদী শসস্ত্র-জঙ্গি বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের দিকে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে। কম্যুনিজম্ তাঁর কৈশরের ফ্যান্টাসি ছিল না, পূর্ণ বয়সে তাঁর হাতে পৌঁছেছিলো কম্যুনিজমের বাইবেল; মেনুফেস্টো তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিলো তাঁর পথের ঠিকানা।
মন আর পথ মিলে গিয়েছিল বলেই বিদ্রোহী তাহেরের বিপ্লবী আত্মা পায় সফেদ শরীর। স্বপ্নের নকশীকাঁথা বুনতে গিয়ে বুনে ফেলেছিলেন এক ভয়াবহ স্বপ্নের জাল, আর সেই জালে জড়িয়ে খাদ্য হয়েছিলেন এক ভয়াবহ অক্টোপাসের। খাল কেটে সিরাজুদ্দৌলা এনেছিলেন মীরজাফর নামক কুমির, তাহের এনেছিলেন জিয়া নামক অক্টোপাস। একটিবার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও জিয়াকে চিনে নেয়া যেত, সতর্ক থাকা যেত তাঁর অবস্থান সম্পর্কে। কখনই তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই বোঝা যায়নি।
পঁচিশে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর আক্রমন করলে চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্টের ইপিআর সেক্টর অ্যাডজুটেন্ট বাঙালি ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এবং জিয়াকেও অনুরোধ করেন; ইবিআর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাঙালি হয়েও মেজর জিয়াউর রহমান রাজি হননি। বরং পশ্চিম পাকিস্তানি লে. কর্ণেল জানজুয়ার নির্দেশে এমভি সোয়াত থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র খালাশ করতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ছিলেন। বেশিদূর যেতে হয়নি, আগ্রাবাদের কাছে গিয়েই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলেন। এভাবে সারা জীবন আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত বদলে তিনি অনেকের জীবন বিপন্ন করেছিলেন।
তাহেরের লক্ষ্য ছিল স্থির।
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এগারো নম্বর সেক্টরে নিজের ভ্রাত্বি-ভগ্নি ব্রিগেড নিয়ে যখন তিনি পারিবারিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত তখন দেশের অনেকপ্রান্তে পাকিস্তানের পক্ষে আযান দিয়েছিল বহু বাঙালি। যুদ্ধের সময় শুধু অস্ত্র চালনা নয়, আক্রমনের পরিভাষা নয়, যুদ্ধের গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা সহযোগে তিনি ছাত্র-কৃষক-শ্রমিককে শেখাতেন যুদ্ধের টিউটোরিয়াল। তিনি বোঝাতেন দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ ব্যাতীত সাম্যবাদী সমাজ গঠন সম্ভব নয়। তাই আজও সাম্যবাদী সমাজ গঠন সম্ভব হয়নি; মাত্র নয় মাসে শেষ করা যুদ্ধে আমরা যে দেশ পেয়েছি তা যেন এক ভোকাট্টা ঘুড়ি, কুড়িয়ে পাওয়া আধুলি, যা নিয়ে আমাদের তথাকথিত রাষ্ট্রব্যবস্থাপকগণ শুন্যে ছুঁড়ে লুফে নেয়ার খেলায় মেতেছে। বৈষম্য, দুর্নীতি, পশ্চাৎপদতা, হানাহানি, শোষণ, বঞ্চনা, লুট্তরাজ, ধর্ষন নানা রাষ্ট্রীয় কর্মে তারা তৎপর রয়েছেন দেশকে নিয়ে।
‘অস্ত্র হাতে থাকলে মানুষের চোখ থাকে পাখির দিকে। ’ সেরকম যুদ্ধ পরবর্তীকালে আমাদের দেশের সেনা আর সাধারণ মানুষের হাতে ছিল অস্ত্র। যে অস্ত্র দিয়ে তারা শেখ মুজিবের ডাকে পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করেছে, সেই অস্ত্র দিয়েই তারা হত্যা করেছে তাদের পিতাকে। রবীন্দ্রনাথ এখানেও বার্তা রেখে গেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি। ’ সেই অভাগা পিতাতো মরে বেঁচেছেন, কিন্তু জীবিত তাঁর বাকী সন্তানেরা বেঁচে থাকার যন্ত্রনায় বিহ্বল হয়ে পড়েছে তার কতক অমানুষ সন্তানের নির্যাতনে।
তারা সত্যিই মানুষ হতে পারেনি। বৃটিশ সেনাবাহিনীর সিলেবাস পাশ করে বাঙলাদেশ সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনী হয়েছে বটে, সাধারণ মানুষের সেবক হতে পারেনি। যে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রের কাঁধে কাঁধ ছুঁয়ে তারা যুদ্ধ করেছিলো তাদের কাঁধের হাত সরে গিয়ে বিভিন্ন সময় তা হয়ে উঠেছে ভয়াল থাবা। যেমন মেজর রশীদ, মেজর ফারুক, মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ, জেনারেল জিয়া, লে.জে.হো.মো এরশাদ এমনকি জেনারেল মঈন ইউ আহমেদও। বিডিআর বিদ্রোহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সৃষ্ট এক এগারো-পরবর্তী তত্বাবধায়ক সেনা-সরকারের তান্ডবে ফুটে ওঠে পুরনো সে চিত্র, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেও করা হয়েছিলো কারারুদ্ধ।
এমন একটি বাহিনীকে তাহের চেয়েছিলেন সাধারণ জনগণের পক্ষের শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে। বৃটিশদের মতো সেনাবাহিনী দিয়ে দমন পীড়নের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের একটি জনহিতকর বাহিনী গঠনের। তাহেরের সেই স্বপ্নটি অনেকের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। তাঁর নিজের বিগ্রেডকে তিনি শুধু পিটি প্যারেড না করিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন চাষাবাদের আর শিক্ষাদানের কাজে। যারা এ বাহিনীকে আগের রূপেই দেখতে চেয়েছে, পুঁজিবাদীদের সেবক হিসেবেই কাজ করতে চেয়েছে, ওরা সহ্য করতে পারেনি; বরখাস্ত করা হয়েছিলো তাঁকে।
শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিতে হয়েছে গণবাহিনী গড়ার সিদ্ধান্ত। যে বাহিনীকে মডেল করে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে জনগণের প্রকৃত সেবক হবার জন্যই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় বাহিনী। তৎকালীন গণবাহিনীর জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ।
ড্রেজিং কোম্পানির চাকরি নিয়েও তিনি থেমে যাননি। প্রয়োজন ছিল জীবিকার, কিন্তু একজন সাধারণ কেরানির মত দায়িত্ব পালন করেননি তিনি।
নদী নিয়ে রীতিমত গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন-- বাঙলাদেশের বন্যার জন্য দায়ী ব্রিটিশদের অপরিকল্পিত রাস্তা-রেলপথ নির্মাণ। মোগল আমলে যে রাস্তা ছিলো নদীর প্যারালালে; সেই রাস্তা আর হাজার মাইল রেলপথ ব্রিটিশরা করেছে হরিজন্টাল যেখানে নদী ভার্টিক্যাল; ফলাফল বন্যা, বার্ষিক জলের উচ্ছ্বাস।
যুদ্ধের ময়দানে তাঁর তেত্রিশতম জন্মবার্ষিকী পালিত হয় দেশের জন্য অঙ্গ বিয়োগের মধ্য দিয়ে। একজন সৈনিকের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে তাঁর পা। সেই পা হারিয়ে তিনি থেমে থাকেননি।
কারো মুখাপেক্ষী হননি। অনেক পা-ওয়ালা জেনারেল-ফিল্ড মার্শালের চেয়ে দাপটের সাথে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের দিকে। যুদ্ধের পর যে যেখানে পেরেছে লুটপাট করেছে, সেনাবাহিনীও এগিয়ে ছিলো; তাহের প্রশ্রয় দেননি তাদের। তিনি ক্যান্টনমেন্টে লুটের জিনিশপত্র একত্র করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষয়রোধের চেষ্টা করেছিলেন। শেখ মুজিবকে হত্যার পর খন্দকার মোস্তাক প্রলোভন দেখিয়েছিলেন তাহেরকে নিয়ে নতুন সরকার গঠনের, তাহের সে প্রলোভন উপেক্ষা করেছিলেন।
অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থান যখন দেশকে এক অনিশ্চিত অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন নিজের হাতে গড়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে নিয়ে খালেদ মোশারফের হাতে বন্দী জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে নতুন বাঙলাদেশের দিকে এগিয়ে যাবার প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে মুখ থুবড়ে পড়েন তাহের। সদা মৌন জিয়ার ভোল পাল্টে যায় মুক্ত হবার সাথে সাথে। ইতিহাসে লিখিত হয় আরেক মীরজাফরের নাম। নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা জিয়া ক্ষমতার লোভে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ইতিহাস করে তোলেন তাহেরকে। সেই ফাঁসিও তিনি সরাসরি দেননি, বানোয়াট মামলা করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে অকারণে তিনি তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দেননি-- যদিও তিনি ছিলেন নেপথ্যে; মুখোমুখি হবার সাহস তাঁর কখনোই ছিলো না।
তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলাটি করা হয় সেটির নাম ''রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল গং''; অভিযোগ বৈধ সরকারকে উৎখাতের অপচেষ্টা! কে এই সরকার কে এই রাষ্ট্র?! প্রথম বৈধ সরকার শেখ মুজিব, তাঁকে উচ্ছেদ করে খন্ডকার মোশতাক, মোশতাককে উচ্ছেদ করে খালেদ মোশারফ-- যে কোনো সরকারই গঠন করেননি, নিজেও সরকার প্রধান ছিলেন না। ১৯৭৫ এর ৩-৭ নভেম্বর দেশে মূলত ছিল না কোনো সরকারই। কিন্তু কাকে উচ্ছেদের অভিযোগ আনা হলো-- জেনারেল জিয়া, নাকি খন্ডকার মোশতাক, নাকি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম, যাঁকে নিয়োগ দেয়া খালেদ মোশারফকে গ্রেফতারের পর তাহের পুনঃমনোনিত করেছিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে? জিয়া কিন্তু ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব দিবস হিসেবে পালনও করলেন।
জাসদের নেতাকর্মী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল সেগুলো খুবই যুক্তিহীন ও পরিষ্কারভাবে উদ্দেশ্যপ্রণদিত। আর বিভিন্ন ব্যক্তিকে দেয়া শাস্তিগুলোও ছিলো আরো স্বেচ্ছাচারিতামূলক ও স্বৈরাচারিক।
দ্বিতীয় অভিযোগটি আরো মজার; সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। যে দিনে সৈনিকদের নিয়ে বন্দী জিয়াকে মুক্ত করলেন তাহের, জিয়া যে দিনটিকে সংহতি দিবস ঘোষনা করলেন সেই একই দিন কীভাবে সংহতি ও বিশৃঙ্খলা দিবস হয়-- যে দিবসের পুরোপুরি সুবিধাভোগী জিয়া! হায় শৃঙ্খলার মহানায়কেরা; শেখ মুজিবকে হত্যাকারী ফারুক, রশীদকে দেয়া হলো উচ্চপদে বৈদেশিক কূটনৈতিকের চাকরি। সংজ্ঞাহীন শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা আর এর শাস্তি ও পুরষ্কার। যে মেজর জলিলের নামে মামলার নাম তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য দেয়া হয় যাবজ্জীবন আর মুক্তিযুদ্ধে অবদানের পর জাতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করার জন্য, শত্রুর সাথে একাত্বতা ঘোষনা না করার জন্য তাহেরকে দেয়া হয় ফাঁসি। কেন? পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগঠনের মধ্য দিয়ে একক ক্ষমতা অর্জন।
জিয়াউর রহমানের জীবনী লিখতে গিয়ে ডেনিস রাইট মন্তব্য করেন, ‘যখন ফলাফল অস্পষ্ট তখন খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব রকম পথ খোলা রাখা জিয়ার স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য। ’ (ভায়া: শাহাদুজ্জামান, উপভায়া: রাসেল মাহমুদ)।
ফাঁসির মঞ্চে কবিতা পড়ে যাঁর জীবনাবসান ঘটে, সময় সেই মানুষটিকে দেয়নি সময়-- নিজেকে প্রকাশের। হয়তো এই দেশ অপেক্ষা করছে আরেক তাহেরের জন্য যে কি না দীর্ঘ একটি জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমাজতন্ত্রের পথে; পুঁজিপতিরা ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় তুলবে না সাধারণ মানুষের বুকে, ঋনের বোঝায় আক্রান্ত করে তুলবে না এদেশের মানুষের ভবিষ্যত, উৎপাদন হবে শ্রমিকের তত্বাবধানে-- শ্রমের মর্জাদায় শ্রমিকই হবেন সবচে’ সম্মানিত, তথাকথিত পুঁজিপতিদের ব্যবস্থাপকরা হবে শ্রমিকের অর্থের ব্যবস্থাপক। জাতীয় পুঁজি গঠিত হবে, কারখানার বাঁশিতে আবার ঘুম ভাঙবে খালিশপুরের শ্রমিকদের, আদমজীর পথঘাট মুখরিত হবে আবার পাটকলশ্রমিকদের পদচারনায়, আগ্রাসী পণ্যগুলো কেউ আর ছোঁবে না-- বন্ধ হয়ে যাবে দেশের বিদেশী পণ্য সাজানো সব মল-মার্কেট।
বিএসএফ আর একটা বুলেটও ছুঁড়বে না এ দেশের মানুষের বুকে। তাহেরের স্বপ্ন এখন জ্বলজ্বল করছে বহু তরুণের চোখে। বহু যুবক ক্লান্ত হয়ে ভাবছে কবে শেষ হবে ক্যারাণি হবার দিন। যৌথখামারের স্বপ্ন নিয়ে কত রাসেল মাহমুদ অপেক্ষা করছে বন্ধুর ডাকের, কমরেড আবু তাহের তা জানবে না কোনোদিন। তোমাকে অভিবাদন কমরেড তাহের, মেরুদন্ডহীন ভাঁড়ের দেশে তুমি এক সটান শিরদাঁড়ার নাম।
তোমাকে প্রণাম। জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
টীকা: বেশিরভাগ তথ্যের সংস্থান হয়েছে শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল থেকে; যারা ৩৫১ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে এই অখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে জানার সময় বের করতে পারবেন না তাদের কষ্ট হয়তো লাঘব হবে। কিছু তথ্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে এবং ব্লগে আলোচনার মাধ্যমে; তাছাড়া রাজনীতি করেন এমন অনেক বয়ঃজ্যেষ্ঠ বন্ধুও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। লেখাটি লিখে আনন্দ পেয়েছি, তথ্য মনে রাখার জন্য লেখা-আলোচনার বিকল্প নেই।
তবু অনুরোধ থাকবে, তথ্য সংযোজন করে সঠিক তথ্যপ্রিয় আমাকে সমৃদ্ধ করার। বিশেষ ধন্যবাদ ফয়সল অভিকে যিনি আমাকে লেখাটি লিখতে প্রণদনা যুগিয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।