আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তসলিমা নাসরিনের কয়েকটি অসাধারণ কবিতা

কোনও একদিন বছর গেলে শুনি কোথাও সে বৃক্ষ হতে চেয়ে চেয়ে হয়েছেও, আমি ঘাস, ঘাসই রয়ে গেছি, ফুল ফোটাই, দিনভর আকাশ দেখি, বাঁচি।

কাব্যগ্রন্থঃনির্বাসিত নারীর কবিতা তালাকনামা যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি আর আমার থাকো না তুমি হও যার-তার খেলুড়ে পুরুষ। যে কোনও শরীরে গিয়ে শকুনের মতো খুঁটে খুঁটে রূপ ও মাংস তুমি আহার করো গণিকা ও প্রেমিকার শরীরে কোনও পার্থক্য বোঝো না। কবিতার চে' চাতুর্য বোঝো ভাল, রাত্রি এলে রক্তের ভেতর টকাশ-টকাশ দৌড়ে যায় একশো একটা লাগামহীন ঘোড়া, রোমকূপে পূর্বপুরুষ নেচে উঠে তাধিন-তাধিন। আমি জোস্নার কথা তোমাকে অনেক বলেছি তুমি অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কোনও পার্থক্য বোঝো না।

ভালবাসার চে' প্রাচুর্য বোঝো বেশি যে কারও গোড়ালির নীচ থেকে চেটে খাও এক ফোঁটা মদ, লক্ষ গ্যালন মদে আমুণ্ডু ডুবে তবু তোমার তৃষ্ণা ঘোচে না। তোমাকে স্বপ্নের অথা অনেক বলেছি সমুদ্র ও নর্দমার ভেতরে তুমি কোনও পার্থক্য বোঝো না। যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি হও যার-তার খেলুড়ে পুরুষ। যার-তার পুরুষকে আমি আমার বলি না। কাব্যগ্রন্থঃ কিছুক্ষণ থাকো ব্যস্ততা তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, যা কিছু নিজের ছিল দিয়েছিলাম, যা কিছুই অর্জন-উপার্জন ! এখন দেখ না ভিখিরির মতো কেমন বসে থাকি ! কেউ ফিরে তাকায় না।

তোমার কেন সময় হবে তাকাবার ! কত রকম কাজ তোমার ! আজকাল তো ব্যস্ততাও বেড়েছে খুব। সেদিন দেখলাম সেই ভালবাসাগুলো কাকে যেন দিতে খুব ব্যস্ত তুমি, যেগুলো তোমাকে আমি দিয়েছিলাম। কাব্যগ্রন্থঃবেহূলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা[ প্রত্যাশা কারুকে দিয়েছ অকাতরে সব ঢেলে সেও অন্তত কিছু দেবে ভেবেছিলে। অথচ ফক্কা, শূন্যতা নিয়ে একা পড়ে থাকো আর দ্রুত সে পালায় দূরে ভালবেসে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল। আলোকিত ঘর হারিয়ে ধরেছ অন্ধকারের খুঁটি যারা যায় তারা হেসে চলে যায়, পেছনে দেখে না ফিরে।

তলা ঝেড়ে দিলে, যদিও জোটেনি কানাকড়ি কিছু হাতে তুমি অভুক্ত, অথচ তোমার সম্পদ খায় তারা যাদের বেসেছ নিংড়ে নিজেকে ভাল। ঠকতেই হবে ভালবেসে যদি গোপনে কিছুর করো প্রত্যাশা কোনও, এমনকি ভালবাসাও পাবার আশা। কাব্যগ্রন্থঃজলপদ্য দুঃখবতী মা মা'র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও ঘুমটি ঘরের বারান্দায়, কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ইতলায়। সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়তো বুড়িছোঁয়া খেলা। দুঃখরা মা'কে ছেড়ে কলতলা অব্দি যায়নি কোনওদিন।

যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা; কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে-ভালুকে খাবে, দুষ্ট জিনেরা গাছের মগডালে বসিয়ে রাখবে মা'কে- দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলত... কে জানে কী সব কথা মা'কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত। দুঃখগুলোকে পিঁড়ি দিত বসতে, লেবুর শরবত দিত, বাটায় পান দিত, দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত... ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে অজুর পানি চাইত, জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মধ্যিখানে। দুঃখগুলো মা'র কাছ থেকে একসুতো সরেনি কোনওদিন। ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর তেলাপোকার সঙ্গে তেলোপোকা আর নেপথলিনের সঙ্গে ওদের পুরে রাখি। ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে না, ভাসিয়ে দেব একদিন কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা চলে যাবে কুচবিহারের দিকে... ইচ্ছে ছিল দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে শেষ অব্দি কবর অব্দি গেছে, তুলে নিয়ে কোথাও পুঁতে রাখব অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার মতো ছুড়ব রেললাইনে, বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে।

হল কই? মা ঘুমিয়ে আছেন, মা'র শিথানের কাছে মা'র দুঃখগুলো আছে, নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।