আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জিয়া জানতেন, কতখানি জানতেন



কিছু দিন আগে চেতনা’৭১ নামে একটি ফোরামে একটি ভিডিও ক্লিপ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার ওপর একটি টিভি চ্যানেলের এক প্রতিবেদন। তাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো একটি বিশেষ ফুটেজ। অ্যান্থনী মাসকারেনহাসকে দেওয়া খুনীদের অন্যতম কর্ণেল ফারুক রহমানের সাক্ষাতকারের কিয়দাংশ, যাতে বলা হয়েছে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে তখন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জানতেন। যেখানে সে বছর মার্চেই জিয়ার সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার উল্লেখ রয়েছে।

আলোচ্য পোস্টটি এ ব্যাপারে কিছু সম্পূরক আলোচনা। জিয়া জানতেন, কতখানি জানতেন। এক. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ধানমন্ডী ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঘটে গেছে ভয়ঙ্কর এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সপরিবারে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।

বেচে গেছেন শুধু জার্মানিতে অবস্থানরত দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ঘটনার খানিক পর কর্ণেল রশীদের ফোন পান সেনানিবাসে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল। ঘটনায় হতভম্ব ও উদভ্রান্ত অবস্থায় তিনি ছুটে যান কাছেই উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায়। উত্তেজিত অবস্থায় দরজা ধাক্কাতে থাকেন তিনি, বেরিয়ে আসেন জিয়া। পরনে স্লিপিং ড্রেসের পায়জামা ও স্যান্ডো গেঞ্জি।

এক গালে শেভিং ক্রিম লাগানো। শাফায়াত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, দ্য প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড। শুনে জিয়া অবিচলিত। তার শান্ত প্রতিক্রিয়া- প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইউর ট্রুপস রেডি।

আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন। এই সংবিধান সমুন্নত রাখার নির্দেশনা মানে এই নয় যে খুনেদের গ্রেপ্তার, বরং তাদের সার্বিক সহায়তা- যার প্রমাণ মিলেছে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। খানিক পর চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের পাশাপাশি জিয়া সেনাসদরে হাজির। ঘটনায় হতবিহ্বল সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর জরুরী তলব পেয়ে তারা সেখানে। খালেদের পরনে রাতের পায়জামা, শার্ট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

ব্যক্তিগত গাড়ি নিজেই চালিয়ে এসেছেন। জিয়া এসেছেন ড্রাইভার চালিত অফিসিয়াল গাড়িতে। ক্লিন শেভড এবং মেজর জেনারেলের পূর্ণাঙ্গ ইউনিফর্মে। এতে জিয়ার ডিসিপ্লিনের নির্দেশনা রয়েছে যা নিশ্চিতভাবেই সমালোচনাযোগ্য নয়। কিন্তু পুরো ঘটনায় অন্যদের বিপরীতে তার প্রশান্ত ও নিরুত্তেজ মনোভাব নিশ্চিতভাবেই ইঙ্গিত দেয় হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা তার অগোচরে ছিলো না।

দুই. ঘটনাটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকান্ড নয়, বরং কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তার কারসাজি। মোটামুটি এভাবেই তা প্রচার পেয়েছে দুযুগেরও বেশী। ঘটনায় জড়িতরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাই স্বাধীনতা বিরোধীরা এতে সংযুক্ত নয় মোটেই। প্রচারণায় এটি বেশ জোর দিয়েই ব্যবহৃত। তবে ঘটনা পরবর্তী প্রবাহ যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পুনর্বাসনে বড় ভূমিকা রেখেছে এতো প্রমাণিতই।

এসপিওনাজ জগতে ‘মোল’ এবং ‘স্লিপার’ বলে দুটো জারগন আছে। ‘মোল’ বলতে বোঝায় প্রতিপক্ষের মধ্যে নিজের অনুগত কারো অবস্থান যাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। ‘স্লিপার’ হচ্ছে অনুগত কেউ যাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো হয়। এই ক্ষেত্রে কাউকে মোল বা স্লিপার না বানিয়ে বরং তাদের কর্মকাণ্ডের দিকেই খেয়াল ফেরানো যাক। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের দুই নেতা কর্ণেল ফারুক ও রশীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান স্বাধীনতার অল্প আগে।

১৯৭১ সালে ফারুক রহমান আবুধাবীতে পাকিস্তানী এক আর্মড রেজিমেন্টের স্কোয়াড্রন কমান্ডার ছিলেন, ১২ ডিসেম্বর তিনি পক্ষ বদলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। রশীদ যোগ দিয়েছেন তার এক মাস আগে। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন তিনি। যুদ্ধ যোগ দিয়েছেন পালিয়ে নয়, ছুটি নিয়ে! দুজনের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। চট্টগ্রামের এক শিল্পপতির দু মেয়েকে বিয়ে করেছেন তারা।

সম্পর্কে ভায়রা ভাই। দুজনের পরিচয় রিসালপুর মিলিটারি একাডেমিতে। সেখানে তাদের ইনস্ট্রাকটর ছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়া নিজে ছিলেন আইএসআইতে। এছাড়া পশ্চিম জার্মানিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার পর এমজি তোয়াবের সঙ্গে তার সখ্যতা।

১৫ আগস্টের পর তখনও পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সদস্য তোরাব ঢাকা উড়ে এসে বিমান বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেন। এর আগে শফিউল্লাহকে হটিয়ে জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছেন। এই তোয়াবের সঙ্গে ফারুক-রশীদের সংশ্লিষ্ঠতার উল্লেখ মেলে জিয়ার বিরুদ্ধেই একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায়। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৬ বগুড়া সেনানিবাসে ট্যাংক রেজিমেন্টের যে অভ্যুত্থানটি হয়েছিলো তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফারুক। আগের বছর ৩ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরা বিনাবিচারে দেশত্যাগের অনুমতি পান (তার আগে জেলখানায় খুন করে যান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী চার জাতীয় নেতাকে)।

তারাই মধ্য এপ্রিলে ফিরে আসেন তোয়াবের সহযোগিতায়। অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষমতায় ভাগ পাওয়া, যা একাই ভোগ করছিলেন জিয়া। অভ্যুত্থান যথারীতি ব্যর্থ হয়, তবে ফারুক এবারও বিনাবিচারে পার পেয়ে যান। জিয়া বরং তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দেন। যদিও তোয়াবকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় উস্কানির দায়ে।

একইভাবে হত্যাকারীদের প্রায় সবাই জিয়ার হাতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পেয়ে পুনর্বাসিত হন, যাদের মধ্যে রয়েছেন মেজর শরিফুল ইসলাম ডালিমও। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার সময় তিনি ছিলেন কেনিয়ার রাষ্ট্রদূত। এখন পলাতক। এই ডালিম মুজিব হত্যার খবর ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশ বেতারে। বলেছিলেন বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র।

মুক্তিযুদ্ধের পিঠে ছুরি মারার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদকে সামনে রেখে দেশকে আবার পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনাটা সফল হয়নি যদিও। কিন্তু অভুত্থানকারীদের মনোভাবই বলে দেয় তারা কোন কিসিমের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আর স্বাধীনতার অন্যতম সেক্টর কমান্ডার (একমাত্র যিনি কোনো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেননি) জিয়ার মনোভাব তো স্পষ্টই গোলাম আযমসহ চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনে। ফারুক-রশীদরা যা করেছেন তার পূর্ণ বেনিফিশিয়ারী ছিলেন জিয়া, আর তার পরবর্তী কর্মকাণ্ড কোনোক্রমেই স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত করে না। তিন. মুজিব হত্যাকান্ড সম্পর্কে জিয়া আসলে কতখানি জানতেন তার একটি বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায় লরেন্স লিফশুলজের ‘এনাটমি অব আ ক্যু’ নামের প্রতিবেদনটিতে।

সেখানেও উল্লেখ আছে ১৯৭৬ সালের আগস্টে সানডে টাইমসের সাংবাদিক মাসকারেনহাসের নেওয়া সাক্ষাতকারটির। আর এতে ফারুক ও রশীদ স্পষ্টই বলেছেন অভুত্থানের মাসছয়েক আগে থেকেই মোশতাক এবং জিয়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হচ্ছিল। শেখ মুজিবের সম্ভাব্য হত্যাকান্ড সম্পর্কে তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। লিফশুলজ জানাচ্ছেন ফারুকের বর্ণিত ২০ মার্চের অনেক আগেই জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিলো ঘাতকদের। সে সময়টায় জিয়া নিজেও ক্ষুব্ধদের তালিকায়।

তার বদলে শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে তাকে বদলীর সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। ঘটনার কয়েকদিন আগে খুনীদের অন্যতম মেজর মহিউদ্দিন জিয়ার একটি চিঠি নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে, যাতে তার বদলি আরো কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ ছিলো। শেখ মুজিব রেখেছিলেন সে অনুরোধ যার ফলে সেনাবাহিনীতে কমান্ডিং একটা অবস্থানে থাকতে পেরেছিলেন জিয়া যা অনেক উপকারে এসেছিলো ঘাতকদের। জিয়া তাদের বলেছিলেন- ‘একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে এতে আমার যোগ দেওয়ার সম্ভব নয়, তবে তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চাও, করো। আমি বাধা দেবো না।

’ এই যে সবুজ সংকেত, এটাই ছিল ফারুক-রশীদদের জন্য আশীর্বাদ। লিফশুলজ তার সেই সোর্সের বরাতে এও জানিয়েছেন যে মোশতাক নয়, ফারুক রশীদদের ই্চ্ছে ছিলো অভ্যুত্থানের একটা পূর্ণাঙ্গ সামরিক রূপ দিতে। অর্থাৎ মুজিব হত্যার পর একটি মিলিটারি কাউন্সিল গঠন করে দেশ শাসন। আর এর নেতৃত্বে জিয়াই ছিলো তাদের একমাত্র এবং গ্রহনযোগ্য পছন্দ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.