৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধের সময় যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের কেউ কি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন? খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৫ মে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় হাসপাতালটির প্রশাসনিক বিভাগে আমাকে বলা হলো, খোঁজ পাওয়া যাবে ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে। সেই ওয়ার্ডে গেলে সেখানে কর্তব্যরত ভগ্নিদের একজন বললেন, এক ‘হেফাজতি’ রোগী আছেন ওয়ার্ডের বাইরে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) দরজার কাছে, নাম নূরে আলম।
কিন্তু সেখানে গিয়ে করিডরের প্রত্যেক রোগীর নাম জিজ্ঞাসা করেও হদিস মিলল না সেই নূরে আলমের। আবার গেলাম ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে।
এবার ভগ্নিরা বিরক্ত হলেন; শেষে আমার অনুরোধে ওয়ার্ডের এক পুরুষ কর্মী চললেন আমার সঙ্গে, আবার সেই ওসিসির দরজার সামনে, যেখানে দুটি করিডর পরস্পরকে ছেদ করেছে, যেখানে আশ্রয় পেয়েছেন ১৫-১৬ জন রোগী। ওয়ার্ডকর্মী উঁচু গলায় বললেন, ‘এইখানে নূরে আলম কে?’ এবার এক রোগীর বিছানার পাশে নড়েচড়ে উঠলেন এক যুবক ও এক প্রৌঢ়া।
‘এইটা। ’ যুবকটি দেখালেন বিছানায় এক তরুণকে। শুয়ে আছে ডানে পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে।
খালি গা, পরনে বেগুনি-সাদা চেক লুঙ্গি, মাথায় ঘন কালো ছোট ছোট চুল, থুতনিতে সামান্য দাড়ি, নাকের নিচে কচি গোঁফ। বাঁ চোখটি বীভৎসভাবে বিক্ষত। কিছুক্ষণ আগে নূরে আলমের খোঁজে এখানে এসে যখন নাম ধরে ডাকাডাকি করেছিলাম, তখন কেউ সাড়া দেয়নি। এই যুবক তখন এই তরুণ রোগীটির নাম বলেছিলেন অন্যকিছু, নূরে আলম নয়। কেন এমন লুকিয়ে থাকার চেষ্টা? আমার এ জিজ্ঞাসায় যুবকটির মুখে অসহায় অভিব্যক্তি ফুটে উঠল, ‘আমরা গরিব মানুষ।
কোনো ঝামেলা হইব না তো?’
যুবক জানালেন তাঁর নাম মনির হোসেন, বয়স ৩০-৩২, গাজীপুরে এক সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন, সেখানেই থাকেন সপরিবারে। আহত তরুণ তাঁর ছোট ভাই নূরে আলম, বয়স ১৭-১৮। নারায়ণগঞ্জের পাগলার তালতলায় এক মাদ্রাসায় পড়ে, থাকে ওই মাদ্রাসার ছাত্রাবাসেই। তার শিয়রের কাছে বসে আছেন শীর্ণ এক প্রৌঢ়া, নাম নূর বানু। তাঁদের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমফলা ইউনিয়নের তাফালবাড়িয়া গ্রামে।
নূর বানুর স্বামী দিনমজুর, তাঁদের চার ছেলের মধ্যে মনির হোসেন সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ছোট নূরে আলম। আরও দুই ছেলে নূরুজ্জামান ও নূর হোসেন—প্রথমজন ট্রাক ড্রাইভার, দ্বিতীয়জন ট্রাকের হেলপার।
হাসপাতালে নূরে আলম সব সময় ঘুমায়, অথবা অর্ধ-অচেতন থাকে। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। সে কবে কোথায় কিসের আঘাতে আহত হয়েছে, কবে কখন কার সহযোগিতায় হাসপাতালে পৌঁছেছে—এসব তথ্য জানার চেষ্টা করি তার ভাই মনির হোসেনের কাছে।
মনির বলেন, তিনি নূরে আলমের খোঁজ পেয়েছেন ৭ মে দুপুরে, তাঁর ছোট ভাই নূরুজ্জামানের কাছে। মোবাইল ফোনে নূরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন, ৬ মে সকালে মোবাইল ফোনে নূরে আলমের মাদ্রাসার কোনো ছাত্র তাঁকে জানায়, তার ভাই ঢাকা মেডিকেলে আছে। নূরুজ্জামান আমাকে বলেন, তিনি ৬ মে বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান নূরে আলম বারান্দায় পড়ে আছে, তার চিকিৎসা হচ্ছে না। নূরে আলমের চোখের ক্ষত দেখে তিনি তাকে নিয়ে যান ফার্মগেটের কাছে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে।
সেখানকার চিকিৎসকেরা নূরে আলমের চোখের অবস্থা দেখে বলেন, তাঁরা কিছু করতে পারবেন না। নূরুজ্জামান তখন তাকে নিয়ে যান শেরেবাংলা নগরের চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের হাসপাতালে, তারপর সেখান থেকে মগবাজারে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে। শেষে ৭ মে দুপুরে বড় ভাই মনির হোসেন নূরে আলমকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই থেকে সেখানেই সে চিকিৎসাধীন আছে অধ্যাপক এহসান মাহমুদের তত্ত্বাবধানে। আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁকে পাই না।
তাঁর এক সহকারী আমাকে বললেন, নূরে আলমের বাঁ চোখের মণি ও মাথায় অনেক স্প্লিন্টার ঢুকেছে। দীর্ঘ সময় ধরে তার চিকিৎসা চালাতে হবে।
নূরে আলম পাগলার তালতলার যে মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থী, সেখান থেকে কেউ তার খোঁজ নিতে এসেছিল কি না, জানতে চেয়েছিলাম তার বড় দুই ভাই মনির হোসেন ও নূরুজ্জামানের কাছে। মনির একবাক্যে বললেন, ‘না। ’ নূরুজ্জামান মোবাইলে বললেন, নূরে আলম ৫ মের দুই দিন আগে মাদ্রাসার ছাত্রাবাস থেকে এসেছিল তাঁর বাড়িতে।
সেখানেই ছিল দুই রাত। ৫ মে সে কীভাবে কাদের সঙ্গে ঢাকা এসেছিল, তা তিনি জানতে পারেননি। নূরুজ্জামানের ভাষায়, ওই মাদ্রাসারই কোনো ‘বাচ্চা ছেলে’ তাঁকে ৬ মে সকালে মোবাইলে জানিয়েছিল, তাঁর ভাই ‘অসুস্থ’, সে ঢাকা মেডিকেলে আছে।
অনেক মাদ্রাসা থেকে অল্প বয়সী অনেক শিক্ষার্থী ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসেছিল ‘হুজুরদের নির্দেশে’। সেদিন দুপুরেই সরকার হেফাজতে ইসলামকে সন্ধ্যার মধ্যে কর্মসূচি শেষ করে ঢাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিল।
কিন্তু হেফাজতের নেতারা সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করে সেই রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। ‘জিহাদ’, ‘শাহাদাত’ ইত্যাদি আবেগসঞ্চারী শব্দ ব্যবহার করে তাঁরা মাদ্রাসার কিশোর-তরুণদের আইন ভঙ্গ করায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারপর গভীর রাতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যখন শাপলা চত্বর পরিষ্কার করার অভিযানে নেমেছিল, তখন ওই নেতাদের কেউই আর সেখানে ছিলেন না। হেফাজতের কোনো নেতা পর্যায়ের ব্যক্তি নিহত হয়েছেন—এমন খবর পাওয়া যায়নি।
অনেক পরে দেখা মিলল ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমানের সঙ্গে।
তিনি সদাশয় ভদ্রলোক, হেফাজতের অবরোধকে কেন্দ্র করে আহত কতজন মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, আমি সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি নথিপত্র খুলে ধরলেন। ৫ মে ও তার পরের দুই দিন মোট এসেছিলেন ২০৩ জন আহত ব্যক্তি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান অধিকাংশ; ভর্তি হন ৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ছয়জন। এখন চিকিৎসাধীন আছেন চারজন।
নূরে আলম তাঁদের একজন। অন্য তিনজন তাহলে কোথায়? জিল্লুর রহমান আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁদের কাছে। কিন্তু এই তিনজনের কেউই শাপলা চত্বরে ছিলেন না, তাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৬ মে সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হেফাজতসহ অন্যদের সংঘর্ষের সময়। তাঁদের একজন প্রাইভেট কারচালক, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ভোর সাড়ে পাঁচটায়, নিজে বাসার বারান্দায় যখন দাঁত ব্রাশ করছিলেন। আরেকজন একটি দুধ কোম্পানির গাড়িচালক, গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন গুলিবিদ্ধ হন।
আরেকজন পোশাককর্মী, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কারখানা বন্ধ দেখে ঘরে ফেরার সময়।
হেফাজতে ইসলাম ও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, শাপলা চত্বরে সেই রাতের অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শত শত হেফাজত কর্মীকে হত্যা করেছে। সরকার এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে গুজব-গুঞ্জন, কানাঘুষার অন্ত নেই। বিশেষত ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শত শত, এমনকি হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার প্রচারণা ফেনায়িত হচ্ছে।
গুজবে যাদের লাভ ও তৃপ্তি এবং সত্য চাপা দিতে যারা একই কারণে তৎপর—উভয় পক্ষের কথা বাদ দিলাম। সেই রাতে আসলে কতজন মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারে—এমন বিশুদ্ধ কৌতূহল যাদের মনে কাজ করছে, নিজেকে তাদের একজন মনে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা, রোগী, রোগীদের আত্মীয়স্বজনকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁদের কী মনে হয়? কত মানুষ শাপলা চত্বরে মারা গিয়ে থাকতে পারে? এক কর্মকর্তা বললেন, তাঁর অভিজ্ঞতায় বলে, কোনো সংঘর্ষে ১০০ লোক মারা গেলে আহত হয় কমপক্ষে ৫০০। তাঁর ভাষ্য, সেদিন শাপলা চত্বরে যদি শত শত লোক মারা যেত, তাহলে সেদিন এই হাসপাতালে আহত রোগী আসত কয়েক হাজার। একটি ওয়ার্ডের এক কর্মী বললেন, রানা প্লাজায় আহত সাতজন রোগী এইখানে ভর্তি হয়েছে, তাদের খোঁজে আসছে কমপক্ষে ১০০ লোক। শাপলা চত্বরে যদি শত শত লোক মারা যেত, তাহলে তাঁদের খোঁজে আসত হাজার হাজার আত্মীয়স্বজন।
কিন্তু এসব অনুমানে সত্যিকারের চিত্রটি ঠিক ঠিক পাওয়া কঠিন।
সেই রাতে নূরে আলম শাপলা চত্বরে ছিল কি না, আমরা এখনো জানি না। যাঁরা তার চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা করছেন, তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে, যেন আবার কথা বলতে পারে, যেন আমরা তার মুখে শুনতে পারি তার জখম হওয়ার গল্প।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।