চুপ!
(নিঝুম নিশ্চুপ দ্বীপে...১ Click This Link এর পর...)
পর্যটনের রিসোর্টে রুম পেতে অসুবিধে হয় নি অফসিজন ছিল বলে। ডাবল বেডের রুম সব- আমার রুমে তাই ভাবলাম এক খাটে মাথা আরেক খাটে ঠ্যাং দিয়ে ঘুমটা ভালোই হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে কাছেই বাজারে এক বুড়া চাচার দোকানে নাশতা-পানি খেয়ে সোজা মেঘনা নদীর তীরে (বাচ্চা-কাচ্চা কতগুলো পোলাপান ছিল আমাদের পথ-প্রদর্শক)। নদীর তীরটা সমুদ্র সৈকতের মতোই। জু- দের জেদ চাপল- ইলিশ মাছ খাবে।
নদীর তীর দিয়ে এক জেলে মাছ নিয়ে যাচ্ছিল, দর কষাকষি শুরু করল, পাঁচশ টাকায় এক জোড়া ইলিশ কিনে মহা খুশী পঞ্চ ধইনচা (আমি ইলিশ খাই না, মাই গন্ধটাও সহ্য করবার পারি না বইলা খুশী হইতে পারি নাইক্কা)। ইলিশ মাছের বন্দোবস্ত করতে ফিরে আসলাম বাজারে, কিন্তু এত্ত উস্তাদ সব বাচ্চা গাইডগুলাও রাস্তা হারায়ে আমাদের একটু পেরেশানি দিল। চাঁদ তখনো পূর্ণ বিকিরণ আরম্ভ করে নি বলে হাতিয়া বাজার থেকে কেনা আমার টর্চটা বেশ উপকার দিল।
বাজারে এসে দাম যাচাই করতে গিয়ে ওরা পাঁচজন সত্যি সত্যি ধইনচা প্রমাণিত হলো- এক জোড়া ইলিশ বাজারে আড়াইশ! অথচ কী নিঁখুত অভিনয়ের মাধ্যমে জেলেটা পাঁচশ টাকায় তা বিক্রি করল। অ ভাই এর পূর্ব পুরুষ যদিও নোয়াখালীর লোক, তবুও তার কাছেও মনে হলো নোয়াখালীর মানুষ বিশেষ সুবিধার না (নোয়াখালীর মানুষজন মাইন্ড কইরেন না, এইডা কিন্তুক আমার কথা না)।
যা হোক রাতে ওরা পেট পুরে ইলিশ মাছ (বুড়া চাচার দোকানে রান্না হলো) দিয়ে ভাত খেল (একটা মাছের পেটে আবার ডিমও ছিল!) আর আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।
২ অক্টোবর সকালে আমরা বুড়া চাচার ঠিক করা বাচ্চা গাইডসহ হরিণের খোঁজে বের হলাম। নদীর তীর ধরে হেঁটে নৌকায় ছোট্ট একটা খাল পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। বাচ্চা গাইড যতই বলে আরেকটু গেলেই হরিণ কিন্তু শ্বাসমূলের খোঁচা থেকে পা বাঁচিয়ে অনেক দূর হেঁটে গেলেও হরিণের দেখা তো আর মেলে না। এক সময়ে আমরা আরেকটা খালের সামনে এসে পড়লাম, কোমড় সমান পানি পার হয়ে ওই পার যেতে হবে।
এবার জু-১ আর জু-২ বেঁকে বসল। ঢাকা থেকে ওরা নাকি একটু হাঁফ ছাড়তে বের হয়েছিল- ভেবেছিল নিঝুম দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের মতোই একটা শান্ত আরাম করার জায়গা হবে।
আমি, ব, জু-৩ আর অ ভাই খালের ওপার। অ ভাই ওদের দুইজনের পৌরুষে ঘা দেওয়ার চেষ্টা করলেন এই বলে যে- দেখ ম যাচ্ছে! আর তোরা যাবি না! ওরা উলটো বলল, ম কে কি আপনি মেয়ে ভেবেছেন না কি? কাছাকাছি আরো কয়েকজন ট্যুরিস্টের আওয়াজ পেয়ে ওদেরকে রাজী করিয়ে আমরা এগুলাম। হেঁটে বেশ কিছুদূর গিয়ে বন্য কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পেলুম- হরিণ একটা হরণ করে ওরা খাওয়ার অপেক্ষায়, আমাদেরকে দেখে কাছে ভিড়ছে না।
কিন্তু ওগুলোর চোখগুলো জ্বলছিল- গা ছম ছম করা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম তিন জু নেই আমাদের সাথে। ফেরার পথে দুশ্চিন্তায় পড়লাম কারণ একমাত্র গাইড আমাদের তিনজনের সাথে। বনের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলে যদি আর তাছাড়া জোয়ারের পানি আসলে তো ওই খাল পার হওয়া যাবে না।
(জু-১ এর কাছ থেকে নিয়ে এডিট করা এই ছবিটি)
প্রথমে ভাবলাম ওরা বোধ হয় আর সামনে না এগিয়ে ফিরে এসেছে, কিন্তু ফিরে এসে ওদের দেখতে না পেয়ে একটু চালাক চতুর পিচ্চি একটাকে নিয়ে আমরা এবার নৌকা নিয়ে বের হলাম ওদের খুঁজতে। ঠিক জঙ্গলে ঢোকার মুখটাতে ওদের পেয়ে গেলাম।
তিন জন প্রচন্ড রাগান্বিত, চরম বাক-বিতন্ডা চলছে পাঁচজনে কিন্তু আমি তখন অবাক হয়ে জোয়ারের সময়ে খালটার রূপ দেখছিলাম, দিনের ভিতরেই দুটো সময়ে একই জায়গার দুই ভিন্ন রূপ। কী অদ্ভুত আর রহস্যময় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি!
তিন জু এর কাছে যা শুনলাম তাও রোমহর্ষক। ওরা যখন অকুস্থলে পৌঁছে, কুকুরগুলো হরিণটার কঙ্কাল বাদে কিছু অবশিষ্ট রাখে নি, কিছুক্ষণের মধ্যে জানোয়ারগুলো পুরা সাফ করে ফেলল খেয়ে। তিনজন জোয়ান মর্দ কুত্তাগুলার লোলুপ দৃষ্টিতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার উপর খালের পানি বেড়ে গিয়ে ওরা আশ্রয় নিল গাছের ডালে।
খালের পানি কমলে আমাদের গাইডের সাহায্যে ওরা জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসল।
কিন্তু এত্ত কষ্ট করে হরিণের কঙ্কাল দেখার পর জু-১ ওরফে মামা-র গেল মাথা খারাপ হয়ে। তাই আমরা (জু-২ বাদে যে সকালের এডভেঞ্চারের পর অসুস্থ হয়ে গেল)বিকালের দিকে আবার বের হলাম। এবার বনের অন্য প্রান্ত। নৌকা থেকে আমরা যেখানে নামলাম সে এক বিশাল প্রান্তর- ছোট ছোট ঘাস, এক্কেবারে 'যে দেশে গরু খায় সবুজ ঘাস' এর এড করছে অগুনতি গরু (জু-২ এর হরিণ)।
মাঠের কোন শেষ নেই। এর ই মাঝে এক দিক দিয়ে আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম। চুপিচুপি এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে যাতে হরিণের পাল আমাদের আওয়াজে ভয় পেয়ে পালিয়ে না যায়। এক সময় দূরে কোথাও হরিণের ছায়া দেখে আমরা ঐ শ্বাসমূলের মধ্য দিয়ে, লাফিয়ে খাল আর গর্ত পেরিয়ে দৌড়। অবশেষে আমরা জ্যান্ত হরিণ দেখলাম- কিন্তু উত্তেজনায় ছবি তোলার কথা ভুলে গেলাম।
অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে বলে তাড়াহুড়া করে জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসলাম। জঙ্গল থেকে বের হওয়ার মুখে দেখি জু-১ সামনে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে যা দেখলাম তাতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। জঙ্গলের মাথার উপর বিশাল একটা চাঁদ- পূর্ণিমার চাঁদ। আদিগন্ত বিস্তৃত এক মাঠের মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে আছি- আমাদের এক পাশে মেঘনা নদী, এক পাশে অন্ধকার জঙ্গল আর মাথার উপরে বিশাল এক চাঁদ, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না- এ তো স্বপ্ন না হয়ে যায় না।
তখন ভাটা, জোয়ার শুরু না হলে আমাদের ছোট্ট নৌকার মাঝিরা (বাচ্চা মাঝি) নৌকা চালাবে না। আর তাই চাঁদের আলোয় আমরা নৌকায় বসে মুড়ি মাখা খেলাম। আমার এখনো ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে! নৌকায় বসে আমরা অনেক গঠনমূলক আলোচনাও করলাম। জু-১ এর কথা হলো- মেয়েগুলা একটু বেশীই ঢংগী হয়, ওগুলাকে নিয়ে ঘোরা যায় না (আমি একটা জলজ়্ব্যান্ত মেয়ে একটু আগে ওই ঢ্যাঙ্গা ঢ্যাঙ্গা ছেলেগুলার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়ে হরিণ দেখে আসলাম- এর পরেও এই কমেন্ট!) আমি আর কী বলব- তোরা ছেলেরা মেয়েদের ঢং টাই তো দেখতে পছন্দ করিস, যারা এই ঢং টা করে না তাদের তো তোরা মেয়ে বলে মনে করিস না, মনে হয় পছন্দ না করে উলটো প্রতিদ্বন্দী ভাবিস। জু-৩ আমার কথায় সম্মতি প্রদান করার পর ওদের মধ্যে চরম উত্তেজনায় আলোচনা শুরু হয়ে গেল নানা বিষয় নিয়ে।
আর আমি অধম বসে বসে এই অপ্রাকৃতিক, অবাস্তব আর অকল্পনীয় সৌন্দর্য এর প্রতিটা কণা উপভোগ করতে চাচ্ছিলাম।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় খেয়াল করলাম দুপুর থেকেই চাচার দোকানের বয়রা আমাকে হেব্বী খাতির করছে। কারণটা আবিষ্কার করলাম- ওরা পুরা এক দিন পর বুঝতে পারল আমি মেয়ে- তাই এত্ত খাতির! ব অবশ্য বলছিল ও গ্রামের লোকজনের অবাক দৃষ্টি আর কথপোকথন আগেই খেয়াল করেছে। যা হোক, রাতে চাঁদের আলোয় রিসোর্টের সামনের উঠানে পাটি পেতে বসে আবারো তাসের আড্ডা শুরু হলো। আমাকে ওরা কোল্ডব্রীজ (!) খেলাটা শেখাল- আবার সাবধানও করে দিল যাতে ঢাকায় গিয়ে খুব ফুটানি না মারি যে আমি তাস পেটানো শিখে গেছি।
বৃষ্টি আসার আগ পর্যন্ত আমরা বাইরেই বসে ছিলাম। আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- এই গ্রূপের কারোর ই আসলে কোন নেশা নেই- ওরা কেউ ধূমপান করে না।
৩ অক্টোবর সকালে ট্রলারে করে রওয়ানা করলাম নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে, নোয়াখালী থেকে বাসে ঢাকায় ফেরার আশায়। ছয় ঘন্টার সেই ট্রলার জার্নিতে বাংলার যে রূপ আমি দেখলাম তা বলার ভাষা নেই। এত সুন্দর! এত অদ্ভুত সুন্দর চারপাশ! মাঝে মাঝে মনে হলো আমি শিল্পীর আকাঁ ছবি দেখছি, এত তার রঙ!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
১।
যদি কেউ যেতে চান অবশ্যই যাওয়ার আগে খোজ নিয়ে যাবেন সপ্তাহের ঠিক কোন দিনে হাতিয়া থেকে ট্রলার যায় নিঝুম দ্বীপে।
২। গ্রামের মানুষের সহজ- সরল মুখ দেখে ভুলবেন না। (এখানে প্রতি পদে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা- নোয়াখালীর লোক বলে কথা!) অবশ্য এটা কিন্তু আমার কথা না- নরসিংদী যেমন আমার দেশ, নোয়াখালীও তেমনি আমার দেশের বাইরে নয় আর আমি ইলিশ মাছ খাই না।
৩।
অবশ্যই সমুদ্র সৈকত ঘুরে আসবেন।
৪। আর পারলে শীতকালে যাবেন, তখন হরিণগুলো জঙ্গলের বাইরের দিকে থাকে- আমাদের মতো কষ্ট পোহাতে হবে না (অবশ্য এডভেঞ্চারের মজাও মিস করবেন!)
৫। দুই দিন তিন রাতে আমাদের প্রতিজনে খরচ হয়েছিল মাত্র ২৪৫০ টাকা। আমাদের ক্যাশিয়ার বনাম ম্যানেজার আমাদেরকে ৫০ টাকা বুঝিয়ে দিতে কার্পণ্য করে নি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
এই ট্যুরটা আমার জন্য একটা অন্যরকম ট্যুর ছিল- বাকী পাঁচজন এর কেউই আমার ডিপার্টমেন্টের না হওয়ায় এই ট্যুরে কোন প্রফেশনাল টানাপোড়ন ছিল না- সম্পূর্ন সময়টাই আমি ছিলাম সত্যি সত্যি আমার পরিচিত দুনিয়া থেকে বাইরে। আর সেই পাঁচ ধইনচাকে ধন্যবাদ যে ওরা আমাকে মেয়ে না ওদেরই মতো আরেকজন ধইনচা ভেবেছিল সম্পূর্ণ সময়টা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।