‘ছবি তোলা’ এবং ‘ভ্রমন’ দুটোই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দুটো উদ্দেশ্যই সাধন করতে পরীক্ষার পরপর-ই কোথাও বেরিয়ে পরার কথা ছিল। প্রথমে নির্ধারিত গন্তব্য ছিল ‘টাংগুয়ার হাওর’। কিন্তু অনেক শীত আর কুয়াশা থাকার কারণে নতুন গন্তব্য ঠিক হোল ‘নিঝুম দ্বিপ’। ভ্রমনসঙ্গী আমরা ৫ জন।
অভিজিৎ
নন্দী, ঝিন্টু লাল দাস, আশিকুল হক তামিম, শফিক হালদার এবং আমি জুবায়ের সুহান। এখানে বলে রাখি যে, এই ৫ জনের মধ্যে ৩জন ই শখের আলকচিত্রী এবং নিজস্ব ক্যামেরাধারী। অভিজিত,ঝিন্টু আর আমি।
যে কোন ভ্রমণে আমাদের গ্রুপ লীডার থাকে অভিজিৎ নন্দী। কোথায় যেতে হবে, কিভাবে যেতে হবে, কী কী নিতে হবে সব পরিকল্পনা সে করে।
এবারও তার ব্যতিক্রম নেই।
অভিজিত এর নেতৃত্বে আমরা চলে গেলাম সদর ঘাট। নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে প্রথমে আমাদের যেতে হবে হাতিয়া দ্বীপে। হাতিয়া-তে দুটি লঞ্চ যায়। এম.ভি.টিপু এবং এম.ভি.পানামা।
যেদিন এম.ভি.টিপু যাবে, এম.ভি.পানামা যাবে তার পরের দিন। গন্তব্য শুরু হওয়ার সময় প্রতিদিন-ই এক। বিকেল সাড়ে ৫টা। পৌঁছাবে সকাল ১০ টায়। আমরা এম.ভি.টিপু তে উঠে পড়লাম।
পুরো লঞ্চ-এর ডেক দখল। আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম যে আমরা ডেকে শুয়ে বসেই হৈ হৈ করে যাব। আর সত্যি কথা বলতে ডেকে যাওয়া কেবিন ভাড়া করে যাওয়ার চেয়ে অনেক গুণ সাশ্রয়ী। ডেকে করে গেলে জনপ্রতি ২২০ টাকা। আর ১টা সিংগেল কেবিন ভাড়া ৮০০ টাকা।
ডাবল কেবিন এর ভাড়া ১৫০০ টাকা। তাও আবার সিঙ্গেল কেবিনে ১জনের বেশি থাকলে আর ডাবল কেবিনে দুজনের বেশি থাকলে তাঁকে ডেকের ভাড়া দিতে হবে। কী আর করা! ডেকে জায়গা না পেয়ে ১টা ডাবল কেবিন পেয়ে নিয়ে নিলাম। লঞ্চ ছাড়ল ঠিক পৌনে ৬টায়। লঞ্চ-এর রেলিঙ ধরে বাংলাদেশের ব্যাস্ততম নগরিকে বিদায় জানালাম।
কিছুক্ষনের মধ্যে নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকা দিনের আলো একেবারে নিভে গেল। লঞ্চ চলছে। কিছুক্ষন পর লঞ্চ-এর সাথে আরেকজন যোগ দিল। চাঁদ। পুরো গোল না।
তাও তার আলো দেখে দেখে আমরা যেতে লাগলাম। লঞ্চ-এর হোটেল এ একে একে করে সবাই খেয়ে নিলাম। লঞ্চ-এর হোটেল এ খেতে মোটামুটি ১০০টাকা কমপক্ষে লাগেই। খাওয়া দাওয়ার পর চলল আড্ডা। রাত আরও কিছু গভীর হলে আমরা শুয়ে পড়লাম।
দলপতি আভিজিত একাই ডেকে শুল। আমার ভালই ঘুম হল। ঘুম ভাংলো ৭টার দিকে। দিনের আলো উঠে গেছে। সূর্যের দেখা নেই এখনো।
আলকচিত্রী অভিজিত দেখি ইতোমদ্ধে ক্যামেরা বের করে শাটার টিপছে। ওঁর দেখাদেখি ঝিন্টুও শুরু হয়ে গেল। আমার ওদেরকে অনুসরণ করে ক্যামেরা বের করতে একটুও ইচ্ছা হলো না। অবশেষে আমরা হাতিয়া পৌঁছলাম সাড়ে ৯টায়। প্রায় ১৬ঘণ্টার লঞ্চযাত্রা।
হাতিয়াতে নেমে আমরা প্রথমে নাশতা করে নিলাম। তারপর আমাদের দ্বিতীয় দফা ভ্রমণ শুরু হল। এই দ্বিতীয় দফা এর ভেতরে যে ছোট ছোট আরও কয়েক দফা ভ্রমণ আছে তা আমি পরে বুঝলাম। যাইহোক, প্রথমে আমরা রিক্সা করে ‘ওছখালী’ গেলাম। ৫জন দুই রিক্সায়।
ভাড়া নিল জনপ্রতি ৩০টাকা। আধা ঘণ্টা পর ‘ওছখালী’ পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে লোকাল জিপ গাড়ি করে ‘জাহাজমারা’ নামক জায়গায় গেলাম। সেটা মোটামুটি ঘন্টাখানেকের ভ্রমণ। রাস্তায় ভালো ঝাঁকুনি।
আমি অবশ্য ঝাকুনিটা বেশ উপভোগ-ই করলাম। সবাই যে উপভোগ করবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। জিপগাড়িতে ভাড়া নিল জনপ্রতি ৪০ টাকা। পৌঁছলাম ‘জাহাজমারা’। সেখান থেকে নিলাম বেবী ট্যাক্সি।
এগুলো হলো সেই হলুদ আর কালো রঙের বেবী ট্যাক্সি যা ঢাকা থেকে বিলুপ্ত। ২০০ টাকা নিল। ৫জনেরই জায়গা হয়ে গেল। আমি র শফিক বসলাম ড্রাইভার এর দুই পাশে। কিন্তু এবার তো আর ঝাঁকুনি মোটেই উপভোগ্য মনে হলো না।
শখ করে ড্রাইভার এর পাশে ওঠাটা ভীষণ বোকামি হয়েছে। এখন পড়ি তো তখন পড়ি অবস্থা। কোনোভাবে পশ্চাতদেশ ড্রাইভার এর সিটে লাগিয়ে রাখলাম আর কি! তামিম বদমাশটা ঠিকই আরাম করে দুইজনের মাঝখানে বসে কেলাচ্ছে। ১ ঘণ্টা পর পৌঁছলাম নিঝুম ঘাট। এখন ট্রলারে করে ঐ পাড়ে গেলেই নিঝুম দ্বীপ।
এপার থেকেই দ্বীপ এর অংশ দেখা যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ চরে এক রাখাল বালক একাই অনেকগুলো মহিষ চড়াচ্ছে। তুলে ফেললাম ছবিটা।
নিঝুম দ্বীপ এ পা দিয়ে ভাবলাম, যাক বাবা! প্রথম যাত্রা ভ্রমণ শেষ হল। এখন খালি ফেরা।
কিন্তু হইয়াও হইল না শেষ। নিঝুম দ্বীপ এ যেখানে থাকা-খাওয়া-ঘোরা ফেরার জায়গা তা ঘাট থেকে আরও ১০-১২ কিলোমিটার ভিতরে। জায়গাটার নাম ‘নামার বাজার’। ‘নামার বাজার’ যাওয়ার উপায় হল দুইটি। এক. রিক্সা।
দুই. মোটরসাইকেল। রিক্সায় করে যেতে লাগবে ১-১.৫ ঘণ্টা। টাকা লাগবে রিক্সাপ্রতি ১৫০। আর মোটরসাইকেল জনপ্রতি ১০০টাকা। সময় লাগবে ১/২ ঘণ্টা।
ইতোমধ্যে তখন ১টা বাজে। আমরা ৫জন ৩টা মোটরসাইকেলে চড়ে বসলাম। যেতে যেতে দেখলাম দ্বীপটার ভেতরটা সাধারণ গ্রামের মতই। পুকুরে মাছ ধরছে ছেলে পেলেরা। চাষের কাজ ও চলছে।
মোটরসাইকেল ড্রাইভার এর কাছ থেকে জানলাম যে মাছ ধরাই এই এলাকার মানুষের প্রধান পেশা। কিন্তু জলদস্যুদের কারণে এখন তারা আর আগের মত নদীতে মাছ ধরতে যায় না। পৌঁছলাম ‘নামার বাজার’। থাকার জায়গা ঠিক করার পালা। পর্যটন হোটেল অবকাশ অথবা লোকাল মসজিদ বোর্ডিং।
হোটেল অবকাশ এর চেয়ে মসজিদ বোর্ডিং সাশ্রয়ী হয়াতে মসজিদ বোর্ডিং-এই উঠলাম। প্রতি রুম ৬০০টাকা। ডাবল বেড। ৫জনের আরামসে হয়ে যাবে।
এরপর নামার বাজারের হোটেল এ খেয়ে চরের দিকে গেলাম।
এতবড় যাত্রা শেষে এই প্রথম আমরা ঠিকভাবে নিঝুম দ্বীপ কে অবলোকন করার সুযোগ পেলাম। বিস্তীর্ণ বিশাল চর, নদীর পাড়ে মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার সারি বেঁধে দাঁড়ানো। ন্যাড়া চরে মাঝে মাঝে দু একটা গাছ। দূরে প্রায় দিগন্ত রেখায় দেখা যায় ঝাউবন। সূর্যের রশ্মি পানিতে পড়ছে।
নৌকা বয়ে যাছে সেই রশ্মি পড়া পানি দিয়ে।
অভিজিত এবার পাখির ছবি তোলার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসছে। সে তার উদ্দেশ্যমত এগোল। আমি কখনো পাখি, কখনো নৌকার ছবি তুলছি। ঝিন্টুর টেলিলেন্স না থাকায় বেচারা মন খারাপ করে ল্যান্ডস্কেপই তুলছে।
এদিকে শফিক বেরসিকের মত নদীর পাড়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল। বেচারা তামিম একা হয়ে গেল। আমি ছবি তুলতে তুলতে ওঁর দিকেই এগোলাম। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা নদীর পাড়েই কাটালাম। সূর্য ডোবার পর নামার বাজার এ ফিরে গেলাম।
সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি ছেলেকে দিয়ে খেজুরের রস আনালাম। আহাহাহা!! কী স্বাদ! কী গন্ধ!! বলতে একটু লজ্জাই পাচ্ছি যে আমি নিজেই ৫ গ্লাস খেজুরের রস খেলাম। রাতে খেয়ে ঠিক করলাম যে নিঝুম দ্বীপ এসে হরিণ না দেখে যাওয়ার তো কোন মানে নাই। হোটেলের বয়কেই গাইড করে নিলাম। ঠিক হল সকাল ৬ টায় আমরা নাশতা নিয়েই বনের ভিতরে ঢুকবো।
উদ্দেশ্য হরিণ দেখা।
যথারীতি যাত্রা শুরু। বনে ঢুকলাম। বনটা ভালোই ছমছমে। কিন্তু খুব একটা ঘন না।
অনেক শাখামূল মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে আছে। আছাড় খেয়ে পড়লে রক্তারক্তি কান্দ ঘটে যাবে। সাবধানে আমরা এগোতে থাকলাম। আধা ঘণ্টা গেল। হরিণ নাই।
হঠাৎ ছেলেটি বলল,” ঐ যে!! ফড়িঙ !! ফড়িঙ!! ফড়িঙ!!!”। আমরা তো অবাক! আসলাম দেখতে হরিণ। পোলায় কয় ফড়িঙ। ঘটনা কী! পরে বুঝালাম যে ‘হরিন’-ই আঞ্চলিক টানে হয়ে গেছে ‘ফরিং’। কিন্তু যে হরিণ দেখাল এর থেকে ফড়িঙ দেখলেও লাভ ছিল।
দূরে ডট এর মত কি একটা দাঁড়ায়ে আছে। নড়লে বুঝা জ্য কিছু একটা নড়ছে। তার উপর গাছের রঙ আর হরিণের গায়ের রঙ একই। গাইড ছেলেটি এভাবেই আমাদের “ফড়িঙ” দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলল। আমরা খুবই বিরক্ত হলাম।
কিছুক্ষন বনে হেঁটে আমরা নামার বাজার ফেরত চলে আসলাম। মাঝে বনেই নাশতা করে নিয়েছিলাম।
এদিকে অভিজিত তো ক্ষেপে উঠল যে হরিণ না দেখে ছাড়বে না। সে খোঁজ নিয়ে এসেছে যে ‘ফড়িঙ’ এর মত হরিণ না। হরিণ এর মতোই হরিণ দেখা যাবে।
আমরা গাইড বিদায় করে দিলাম। অভিজিত তাঁর এক পরিচিত বড় ভাইকে ফোন করে জানলো যে হরিণ দেখতে হলে আমাদের চৌধুরীর চরে যেতে হবে। নৌকা ঠিক করতে গেলে নৌকা ঘণ্টায় ৫০০ টাকা দাম হাকাল। আমরা আবারও খুব বিরক্ত হলাম। কারণ আমাদের জানামতে সারাদিনে ২০০-৩০০ টাকার বেশী হওয়ার কথা না।
এত টাকা দিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই মন খারাপ করে হাঁটছি। অভিজিত এদিকে অন্য স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করে জানলো যে দুটি ছোট খাল পাড় হতে পারলেই চৌধুরীর চরে যাওয়া যাবে। ওখানে একটি মাছাঘর আছে। ওখানে ঘণ্টা দুয়েক লুকিয়ে বসে থাকলে বিকালে হরিণের দেখা পাওয়া যেতে পারে।
তো আমরা সেভাবেই এগোলাম। প্রথম খালের কাছে গিয়ে আমরা আশেপাশের চলতে থাকা নৌকার মাঝিদের অনুরোধ করলাম আমাদের পাড় করে দিতে। ওঁরা আমাদের পাড় করে দিল। এভাবে দ্বিতীয়টাও পাড় হলাম। পৌঁছলাম চৌধুরীর চরে।
সে এক বিশাল চর। চরে অনেক মহিষ ঘাস খাচ্ছে। চরের ভেতরের দিকে বন।
বনের শুরুতেই মাছাঘর টা পাওয়া গেল। অভিজিত মহাউৎসাহে মাচাঘর পাতা দিয়ে ঢেকে দিল।
মাচাঘরের কাছেই একটা পুকুর আছে। ধারণা করা হচ্ছে যে বিকালে হরিণরা এখানেই পানি খেতে আসবে। আমরা সবাই মাচাঘরের মধ্যে ঢুকে বসে রইলাম। তখন দুপুর হবে। দুপুরের খাওয়া হিসেবে সবাই বিস্কুট খেলাম।
মাছাঘরে বসে সবাই গল্প করছি। আর ভাবছি আসলেই কি হরিণ আসবে!! অভিজিত বারবার একই কথা বলছে, “কী একসাইটিং না!!“কী একসাইটিং না!!” আমার ইচ্ছা হচ্ছিল বলি যে “মোটেও একসাইটিং না। কোথাকার কোন হরিণ এর জন্য বসে আছি। তাও আসবে কিনা ঠিক নাই। “ কিন্তু ওঁর মতো নিবেদিতপ্রান আলকচিত্রীকে নিরুতসাহিত করতে একটুও মন চাইলো না।
হাসি দিয়ে বুঝালাম “খুবই একসাইটিং!!” হাসলে সাধারণত আমার দাঁত বের হয় না। “একসাইটমেন্ট” বুঝাতে দাঁত বের করেও দেখালাম।
দুইটা থেকে বসে আছি। এখন ৪টা বাজে। হরিণ তো দুরের কথা ফড়িঙ ও নাই।
হঠাৎ দেখি তামিম লাফিয়ে উঠল, “ঐ যে! ঐ যে!!” অভিজিত বল্ল,”চুপ! চুপ! আস্তে”। আমরা সবাই ফিসফিস মোডে চলে গেলাম। বন থেকে আস্তে আস্তে ১০-১২টা হরিণের একটা দল বেরচ্ছে। দুইটা পুরুষ হরিণ। বাকিগুলা বাচ্চা আর মাদী হরিণ।
পুরুষ হরিণ দুটোর ইয়া বড় শিং। কারুকার্যময়। বাদামী শরীরে সাদা গোল গোল ছোপ। মাচাটা একটু নড়বড়ে ছিল। একটু নড়তেই শব্দ করে উঠল।
এতে হরিণ এর আধা দল বনে লুকিয়ে পড়ল। বাকিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাদের মাচার দিকে তাকায়ে থাকল। আস্তে আস্তে ওঁরা পুকুর থেকে পানি টানি খেয়ে বিদায় নিল। আমরাও ৩ ঘণ্টা পর মাচা থেকে নামলাম।
কিছুক্ষন পর সূর্যাস্ত হবে।
সূর্যাস্ত দেখতে দেখতেই আমরা নামার বাজার রওনা দিলাম। কাল সকালে ঢাকা রওনা দিব। পেছনে পরে থাকবে এই বিশাল চর। নিঝুম দ্বীপ এর চর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।