জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি
বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার পদ্ধতির পরিকল্পনা
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবনা
ভূমিকা :আমরা সবাই একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, অর্থনৈতিক স্বনির্ভর, সুখী-সমৃদ্ধ এবং আত্মমর্যাদার দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি- কিন্তু আজও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে অবক্ষয় বিরাজ করছে সামাজিক ক্ষেত্রে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জঙ্গিবাদসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা কোনোভাবে নির্মূল করা যাচ্ছে না। বেকারত্ব বাড়ছে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমেই কমছে। যুবসমাজ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিভিন্নভাবে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বারবার বাধাগ্রস্ত হয় গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা। দেশপ্রেমিক প্রত্যেক নাগরিকই চায় পরিস্থিতির উন্নতি। সকলেরই প্রত্যাশা- সুখী-সমৃদ্ধ, শান্তি-নিরাপত্তা, আত্মনির্ভরশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন একটি দেশ গড়া।
কিন্তু কীভাবে? আমাদের সমস্যা যে পাহাড়-প্রমাণ। আশঙ্কাজনকভাবে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, বিচার ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রেই আমরা বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছি।
স্বাধীনতার পর আমরা যারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, তারা সকলেই দেশ ও জাতির কল্যাণের চেষ্টা করেছি। কম-বেশি সংস্কারের উদ্যোগ সবাই গ্রহণ করেছি। শাসনতান্ত্রিক সংস্কার- বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জেলা গভর্নর নিয়োগের বিষয়টিও ছিলো বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ।
এই পর্যায়ে আমি বাংলাদেশে শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। কারণ দেশে এখন সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে এককেন্দ্রিক সরকারের পে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
আমি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে অনেকগুলো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছি এবং বাস্তবায়ন করেছি- থানাকে উপজেলা, মহকুমাকে জেলা এবং দু’টি বিভাগ করেছি। অপ্রয়োজনীয় দপ্তরসমূহ বিলুপ্ত করেছি।
আবার গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য এলজিআরডি প্রতিষ্ঠা করেছি। নারী ও শিশু কল্যাণের জন্য মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে বোঝা যায় যে, দেশের সমস্যা কত প্রকট এবং তা সমাধান করা কত কঠিন কাজ। সবচেয়ে বড় সমস্যা- কোনো একটি জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্যেও আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি না। আমি যে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করেছি- এ ব্যাপারে জনমত প্রস্তাবের পক্ষে আছে বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটদাতা প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। কিন্তু তাহলে কী হবে- সকল দলকে তো একমত হতে হবে।
প্রস্তাবটি আমি উত্থাপন করেছি বলে এটা বাস্তবায়িত হলে যে সব কৃতিত্ব আমার হয়ে যাবে তা নয়। যেমন যমুনা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম। তারপর সব সরকারের হাত ছুঁয়ে এটা বাস্তবরূপ নিয়েছে।
যারা সমাপ্ত করেছেন- নামফলক তাদেরই আছে। নিয়ম তো এটাই। কোনো প্রস্তাব বা উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত যাদের হাতে বাস্তবায়িত হবে- কৃতিত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে। পেছনের কথা হয়ে থাকবে ইতিহাস। আজ আমরা সীমাহীন সমস্যা সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামনে অপেক্ষা করছে মহাবিপর্যয়। সবাই নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে দেখুন বাংলাদেশের দিকে-
দেশের পরিবেশ পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত চিত্র :
মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ।
এর মধ্যে বনাঞ্চলের আয়তন ২২ হাজার ৫৮৪ বর্গ কিলোমিটার। পরিবেশ রায় এই বনভূমি যথেষ্ট নয়। অন্তত আরও দ্বিগুণ বনাঞ্চল দেশের জন্য প্রয়োজন।
তার মধ্যেও প্রতিবছর ইটভাটার জন্য বিপুল বনজসম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ফসল ফলানোর মাটি পোড়ানো হচ্ছে।
দেশে নদীপথ রয়েছে ৮ হাজার ৯০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে। তবে এই নদীপথের বিশাল অংশ জুড়ে আছে ধু-ধু বালুচর। এক প্রকার মরুভূমির মতো।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৪২ লাখ।
২০০১ সালে চতুর্থ আদমশুমারি অনুসারে লোকসংখ্যা ছিলো ১২ কোটি ৯২ লাখ ৪৭ হাজার ২৩৩ জন।
২০০৯ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ক দফতরের জনসংখ্যা বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার। এই জনসংখ্যা ওশেনিয়া মহাদেশের ৫ গুণেরও বেশি।
ওশেনিয়া মহাদেশের জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩৫ লাখ। এ মহাদেশের আয়তন ৮৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬২০ বর্গ কিলোমিটার। সেখানে দেশ রয়েছে ১৪টি।
আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৩৩টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ৯৩তম। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং এশিয়ার মধ্যে পঞ্চম।
জনবসতির হিসাব : ইউরোপ মহাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৩২ জন। এশিয়া মহাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৮২ জন।
সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৯৭৭ জন। আর রাজধানী ঢাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার : ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষার রিপোর্ট অনুসারে ১.২৬% কিন্তু ইউএনইপিএ-এর রিপোর্ট অনুসারে ১.৪০%।
এই হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২২ লাখ ৪০ হাজার।
৪ বছর সময়ের মধ্যে আমাদের জনসংখ্যায় যুক্ত হয় প্রায় এক কোটি মানুষ।
সার্ক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ ও নেপালের আয়তন প্রায় সমান। বাংলাদেশের চেয়ে নেপালের আয়তন মাত্র ৩৮৯ বর্গ কিলোমিটার ছোট। কিন্তু সেখানে জনসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৩৯ লাখ।
বর্তমানে আমাদের রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা নিপোর্টের রিপোর্ট অনুসারে ১ কোটি ৩০ লাখ।
ঢাকা শহরের যে আয়তন- এই আয়তনের মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য আদর্শ শহরের মতো করে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ লোক বাস করতে পারে।
অর্থাৎ রাস্তা, পার্ক, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, শিক্ষা-চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা রয়েছে তার সুবিধা সর্বোচ্চ ৩০ লাখ লোক স্বচ্ছন্দে ভোগ করতে পারে।
অতিরিক্ত এক কোটি মানুষের বোঝা ঢাকা শহরকে বহন করতে হচ্ছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪০ শতাংশ হলেও ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ।
অর্থাৎ ১২ বছর পর ঢাকার জনসংখ্যা হবে প্রায় আড়াই কোটি।
ঢাকা শহরে বর্তমানে যত বাস, গাড়ি, অটোরিকশা এবং রিকশা-ভ্যান রয়েছে, তার ৫০ ভাগও যদি এক সময় রাস্তায় নামানো হয়, তাহলে একটিবারের জন্যেও চাকা ঘুরানো সম্ভব হবে না।
তারপরও প্রতিদিন গড়ে ১৮০টি গাড়ি নতুনভাবে রাস্তায় নামছে।
এই পরিস্থিতিতে যানজট নিরসন করা কল্পনাতীত ব্যাপার।
বাংলাদেশের ভালো সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক।
ভালো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, হাসপাতাল, নার্সিংহোম সবকিছু ঢাকাতেই।
সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮২টি। তার মধ্যে ৬০টি রয়েছে ঢাকায়।
৩৮টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩২টি রয়েছে ঢাকায়।
শিক্ষার জন্য বা চাকরি নিয়ে যারা একবার ঢাকায় আসেন তারা আর নিজ জেলায় ফিরে যেতে চান না।
নিপোর্টের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে প্রতিদিন ২ হাজার ১৩৬ জন মানুষ রাজধানীতে এসে থেকে যাচ্ছে।
ভালো ডাক্তার, ভালো আইনজীবী, ভালো শিক সবার বাসস্থান ঢাকায়। তারা পেশা বা ব্যবসার স্বার্থে ঢাকাতেই থাকতে চান। যারা বড় চাকরি করেন তারা যে কোনোভাবে ঢাকায় বাড়ি করে স্থায়ীভাবে থেকে যান। একইভাবে অর্থবিত্তশালীরাও ঢাকাতেই বাড়ি বা ফ্যাট কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান।
দেশে বর্তমানে ৮৭ হাজার ৯০৪টি গ্রাম, ৪ হাজার ৪৯৮টি ইউনিয়ন, ৪৮৩টি উপজেলা, ৬৪টি জেলা এবং ৭টি বিভাগ রয়েছে। পৌরসভা রয়েছে ৩০৭টি এবং সিটি কর্পোরেশন আছে ৬টি।
১৬ কোটি মানুষ যদি সারাদেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে ছড়িয়ে থাকে- তাহলে বাংলাদেশও একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনার দেশ হতে পারে। অতিরিক্ত জনগোষ্ঠী জনসম্পদে রূপ পেতে পারে।
মামলাজটের আবর্তে পড়ে আছে গোটা বিচার ব্যবস্থা।
উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ধরে মামলা ঝুলে থাকে।
কেন বিচারের দীর্ঘসূত্রতা? দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি জেলা জজ আদালত রয়েছে। এখানে প্রতিদিন যতগুলো মামলার রায় হয়- তার মধ্যে একটি জেলা থেকে যদি প্রতিদিন ১০টি মামলাও উচ্চ আদালতে যায়- তাহলে গড়ে প্রতিদিন সারাদেশ থেকে ৬৪০টি মামলা হাইকোর্টে আসে। কিন্তু হাইকোর্টে কি একদিনে ১০০ মামলাও নিষ্পত্তি হয়?
এভাবে মামলার জট ঢাকা শহরের যানজটের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিচারবঞ্চিত হচ্ছে।
কোনো অপরাধী যদি তার মামলা উচ্চ আদালতে নিতে পারে- তাহলেই দীর্ঘসূত্রতায় সে একপ্রকার রা পেয়ে যায়।
দেশে এখন এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে। ফলে প্রশাসনিক সকল কর্মকাণ্ডই রাজধানী ঢাকা থেকে পরিচালিত হয়। যে কোনো একটি সাধারণ কাজের জন্যেও ঢাকা আসতে হয়। একটা সার্টিফিকেট সত্যায়িত করার জন্যেও সচিবালয়ে যেতে হয়।
১৬ কোটি মানুষের সব সমস্যা প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হয়। ফাইলের মধ্যে তাকে ডুবে থাকতে হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেও প্রধানমন্ত্রীকেই সেখানে যেতে হয়।
একজন সংসদ সদস্যকেও গড়ে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ লোকের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়।
সংসদ সদস্যকে সংসদে আইন প্রণয়নের কাজের চেয়ে টিআর, কাবিখা, চাল-গম, টিন-কম্বল বিতরণের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় বেশি।
একজন সংসদ সদস্যের পক্ষেও সাড়ে ৫ লাখ লোকের প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রমেই নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে। আগামী ২০ বছর পরের বাংলাদেশ কী হতে পারে তা ভাবতেও আমাদের আঁতকে উঠতে হয়।
এখন আমাদের উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। কী হতে পারে সেই পথ?
বাংলাদেশকে ঢাকা শহরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখতে হবে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গমাইল আয়তনের মধ্যে। তার জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার।
এই সংস্কারের মাধ্যমে প্রবর্তন করতে হবে প্রাদেশিক সরকার পদ্ধতি। সেই প্রস্তাবটি উপস্থাপন করছি :
পূর্বেকার প্রেক্ষাপট আশির দশকে আমি যখন ক্ষমতায় ছিলাম তখন প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের এক যুগান্তকরী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। সেটা ছিলো উপজেলা পদ্ধতির প্রবর্তন।
একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে উপজেলা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে গ্রামীণ জনজীবনে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা হয়েছিলো। উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে জনপ্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়। এর ফলে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রাদেশিক সরকারের প্রস্তাবনা উপজেলা প্রবর্তনের মাধ্যমে একেবারে নিচু পর্যায়ে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের মতো যুগান্তকরী পদক্ষেপ এবং এ পদ্ধতির সুবিধাদির বাস্তবতার আলোকে আমি ব্যাপকভিত্তিক প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বিবেচনা করি। এটা হচ্ছে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
দেশের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করাসহ সুচারু প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দেশকে ৮টি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। দেশের বর্তমান ৭টি বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তর এবং বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলা নিয়ে আরো একটি প্রদেশ গঠন করা যায়। ঢাকা হবে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, প্রতিবেশী ভারতের রাজধানী দিল্লিকে এককভাবে একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়েছে এবং সেখানে পূর্ণাঙ্গ প্রাদেশিক সরকার বলবৎ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী সে তুলনায় আয়তনে ছোট এবং লোকসংখ্যাও দিল্লির চেয়ে কিছু কম।
সে বিবেচনায় ঢাকাকে শুধু কেন্দ্রীয় রাজধানী হিসেবেই বহাল রাখা যায়। আবার এটাকে রাজধানী অঞ্চল হিসেবে প্রদেশের মর্যাদাও দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঢাকার প্রাদেশিক রাজধানী বিভাগের একটি কেন্দ্রস্থল নির্ধারণ করে সেখানে স্থানান্তরিত করা যায়। ভৌগলিক অবস্থান এবং গুরুত্ব অনুসারে ময়মনসিংহ ঢাকা বিভাগীয় অঞ্চলের প্রদেশের রাজধানী হতে পারে। অর্থাৎ দেশকে ৮টি প্রদেশে বিভক্ত করা হলে অঞ্চল হিসেবে পাওয়া যায়- ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর বিভাগ এবং বৃহত্তর নোয়াখালী-কুমিল্লা।
তবে জনসংখ্যা এবং আয়তনের বিবেচনায় বর্তমান বিভাগের আয়তনে কিছু পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে।
প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পে প্রাথমিক যৌক্তিকতা কী আছে তা দেখার জন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার পদ্ধতিও অবলোকন করা যেতে পারে। বাংলাদেশসহ ৭টি দেশ নিয়ে যে সার্ক গঠিত হয়েছে তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত আছে। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও একই শাসন ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে- যেখানে আমাদের দেশের একটি বিভাগের জনসংখ্যার চেয়েও কম জনসংখ্যার দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি প্রবর্তন করতে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়।
নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধির আলোকে এখন আমাদের নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা চিন্তা করতে হবে।
সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, দ্রুত উন্নয়ন এবং নতুন শতকে অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রস্তাবিত প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আর কোনো বিকল্প নেই। এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে গোটা দেশে উন্নয়নের ভারসাম্যও নিশ্চিত হবে। এতে বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে এবং দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমবে।
প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো হবে নিম্নরূপ:
ফেডারেল সরকার
প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে আমি একটি প্রাথমিক ধারণা উপস্থাপন করছি। এটি একটি কাঠামোমাত্র। এখানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন এবং উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। এর জন্য সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
আমাদের দেশে সংবিধান সংশোধন নতুন কোনো ঘটনা নয়। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত মোট ১৪ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে আবারও সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন দেখা দিলে আশা করি দলমত নির্বিশেষে সর্বসম্মতভাবে আমরা তা করতে পারবো। আমরা যদি সকল দল এ ব্যাপারে একমত হতে পারি- তাহলে আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে এবং যেসব দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, তাদের কাঠামো অনুসরণ করে একটি সর্বসম্মত প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো গঠন করতে পারবো। প্রস্তাবিত দুই স্তরবিশিষ্ট সরকার কাঠামোতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডারেল সরকার।
প্রেসিডেন্ট থাকবেন রাষ্ট্রের প্রধান এবং বর্তমান সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হবেন সরকারপ্রধান। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের থাকবে ৩০০ আসনবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী হবেন মন্ত্রী পরিষদের প্রধান। জাতীয় নির্বাচনে যে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে সে দলই সরকার গঠন করবে। পদত্যাগ অথবা আস্থা ভোটে পরাজিত না হলে সরকারের মেয়াদকাল হবে ৫ বছর।
সে ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় সংসদ যথারীতি দেশের জন্য আইন প্রণয়ন এবং বার্ষিক বাজেট পাস করবে। সংবিধান অনুসারেই সংসদ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়তন ছোট হবে এবং জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ যেমন প্রতিরক্ষা, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শিক্ষা এবং জ্বালানির মতো জাতীয় বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকবে। স্থানীয় প্রশাসন এবং উন্নয়নসহ অন্যান্য বিষয়গুলো বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে এবং প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কেন্দ্রীয় সরকার নৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রাদেশিক সরকারকে সহযোগিতা করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত উন্নয়ন তহবিল থাকবে। স্থানীয় এবং বৈদেশিক উৎস থেকে এ তহবিল গঠিত হবে। প্রাদেশিক সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষনের জন্য ফেডারেল সরকার প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে গভর্নর নিয়োগ করবে। অবশ্য স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারের যথাসম্ভব স্বায়ত্তশাসন থাকবে, যাতে প্রাদেশিক প্রশাসন স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার করতে পারে।
দেশের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী বড় ধরনের কোনো নিরাপত্তার হুমকি, আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বড় ধরনের অমান্যের মতো ব্যতিক্রম কোনো ঘটনার ক্ষেত্র ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের কার্যকলাপের ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। ফেডারেল রাজধানী থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ঢাকা হবে বাংলাদেশের ফেডারেল রাজধানী। কেন্দ্রীয় রাজধানীকে কেন্দ্রীয় রাজধানী অঞ্চল ঘোষণা করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার একজন গভর্নরের তত্ত্বাবধানে এখানে সরাসরি প্রশাসন পরিচালনা করবে।
এ ক্ষেত্রে ভারতের রাজধানী দিল্লির উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। কয়েক বছর আগে রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত করার আগে দিল্লি ছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ইউনিয়ন অঞ্চল। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগকৃত একজন গভর্নর কর্তৃক দিল্লির প্রশাসন পরিচালিত হতো। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাকে অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানে রাজধানী অঞ্চলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাজধানীতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব সচিবালয় অবস্থিত থাকবে।
অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রণালয় ব্যতীত কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয়ের আয়তন ছোট হবে। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্যই ফেডারেল রাজধানীতে অবস্থিত থাকবে।
প্রাদেশিক সরকার:
প্রাদেশিক সরকার হবে কেন্দ্রীয় সরকারের ফেডারেটিং ইউনিট। প্রত্যেক প্রদেশের নিজস্ব প্রাদেশিক পরিষদ থাকবে। প্রত্যেক থানা ও উপজেলাকে প্রাদেশিক পরিষদের এক একটি আসন বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।
থানা এবং উপজেলা মিলে প্রদেশের মোট আসন সংখ্যা ৬০০ হতে পারে। সব থানাই উপজেলা নয়। যেমন রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে ৪১টি থানা রয়েছে। ৪১টি থানায় জাতীয় সংসদের সংসদীয় আসনের সংখ্যা ১০টি। সুতরাং রাজধানী ঢাকায় ১০টি সংসদীয় আসন থাকলে প্রাদেশিক আসন হবে ৪১টি।
এ ক্ষেত্রে প্রদেশের আয়তন অনুসারে প্রাদেশিক পরিষদের আসনসংখ্যা নির্ধারিত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকা প্রদেশে যদি ৯০টি থানা ও উপজেলা থাকে তাহলে প্রাদেশিক পরিষদের আসন সংখ্যা হবে ৯০টি। আবার সিলেট প্রদেশে যদি ৩৬টি উপজেলা ও থানা থাকে তাহলে এই প্রদেশের প্রাদেশিক পরিষদের আসন থাকবে ৩৬টি। যেমন ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্য হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং সেখানে আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অপরদিকে সিকিমের আয়তন সবচেয়ে ছোট এবং সেখানে প্রাদেশিক পরিষদে আসন সংখ্যাও সবচেয়ে কম।
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের বিজয়ী পার্টি বা কোয়ালিশন প্রাদেশিক সরকার গঠন করবে। প্রাদেশিক সরকারের প্রধান থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের মুখ্যমন্ত্রী প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সাহায্য নিয়ে প্রদেশের প্রশাসন এবং অন্যান্য বিষয়াদি পরিচালনা করবেন। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তা উভয় করে সম্মতিতে অথবা সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সমাধান করে নিতে হবে।
প্রদেশের উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারকে যতদূর সম্ভব মতা এবং দায়িত্ব অর্পণ করবে। প্রদেশে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা এবং পরিকল্পনার ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারকে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা প্রদান করা হবে। অবশ্য এ পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় পরিকল্পনার সাথে সমন্বিত হতে হবে এবং তা অবশ্যই জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার পরিপন্থী হতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সরকার দেশের যে কোনো অংশে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার অধিকার রাখবে। জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট প্রদেশের প্রাদেশিক সরকারের অধীনে থাকবে।
সরকারের বিদ্যমান সকল বিভাগ, উন্নয়ন সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থাসমূহ বিভক্ত করা হবে এবং প্রাদেশিক সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হবে। প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা রার জন্য প্রাদেশিক পুলিশ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। অবশ্য ক্যাডার কর্মকর্তা, বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের দায়িত্ব ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে। প্রাদেশিক সরকারের প্রয়োজন অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার এদের নিয়োগ দান করবেন। প্রত্যেক প্রদেশে হাইকোর্ট থাকবে।
হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকবে। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে যদি আলাদা করা হয় তাহলে বিচার ব্যবস্থার নিম্নক হাইকোর্টের অধীনে থাকবে অথবা যদি বর্তমান অবস্থা বলবৎ থাকে তাহলে তার প্রশাসন প্রাদেশিক সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বাস্তবায়ন জোরদার করার জন্য প্রাদেশিক সরকারের অধীনে প্রত্যেক জেলাকে উপজেলার সাথে উন্নয়ন ইউনিটে রূপান্তরিত করা হবে। জেলা এবং উপজেলাকে সকল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হবে- যাতে করে স্থানীয় জনগণকে ব্যাপক হারে কর্মস্থানের আওতায় আনা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে প্রাদেশিক সরকারকে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং দাতাদের কাছ থেকে উন্নয়ন সহযোগিতা নেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হবে।
বর্তমান বিভাগীয় সদর দপ্তরকে প্রাদেশিক রাজধানী ঘোষণা করা হবে। এছাড়া বিভাগ বাদে যেখানে প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে- সেখানে সুবিধামতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রাদেশিক রাজধানী করা হবে। ঢাকা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী থাকবে বলে এই প্রদেশের রাজধানী প্রদেশের অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর ময়মনসিংহে করা যায়। প্রাদেশিক রাজধানীতে প্রাদেশিক সচিবালয় স্থাপন করা হবে এবং সচিবালয়ের আয়তন সম্ভাব্য ছোট করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের মতো প্রাদেশিক সরকারের মেয়াদকাল হবে ৫ বছর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রাদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। যদি ফেডারেল সরকার পদত্যাগ করে অথবা সংসদে ফেডারেল সরকার আস্থা ভোটে হেরে যায় অথবা কোনো কারণে যদি কেন্দ্রীয় সরকার ৫ বছরের মেয়াদকাল অতিক্রম করতে না পারে তাহলে প্রাদেশিক সরকার বহাল থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনো কারণে মেয়াদকাল পূর্ণ করতে না পারলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করা হলে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে এবং নির্বাচন কমিশনই সকল নির্বাচন পরিচালনা করবে। মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের মেয়াদকাল পরবর্তী ৫ বছর হতে পারবে না।
অর্থাৎ ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হতে যে সময় বাকি থাকবে- মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠিত সরকার সেই বাকি সময় মতায় থাকবে। ৫ বছরের মেয়াদ শেষে একই সাথে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময় সর্বময় ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতেই থাকবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময় প্রাদেশিক সরকারের নির্বাহী কর্মকাণ্ড একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত রাখা যেতে পারে। যদি কোনো প্রাদেশিক সরকার পূর্ণ মেয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ সময়ের পর পদত্যাগ করে অথবা কোনো কারণে যদি প্রাদেশিক সরকার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে সক্ষম না হয় তাহলে উক্ত প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত করে সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সময় পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে।
আর যদি কোনো প্রাদেশিক সরকার পূর্ণ মেয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ সময়ের আগে পদত্যাগ করে কিংবা কোনো কারণে প্রাদেশিক সরকারের পতন ঘটে, তাহলে প্রাদেশিক গভর্নরের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ওই প্রদেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার মেয়াদের অবশিষ্ট সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে।
ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সম্পর্ক :
সকল প্রাদেশিক সরকার সময়ে সময়ে প্রবতির্ত নীতি ও আইন অনুযায়ী অথবা সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে ফেডারেল সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। প্রশাসন চালানো এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্যই প্রাদেশিক সরকারের কর্মকাণ্ড তদারক করবে।
সংবিধান কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কাজের পালা-পরিধি নির্ধারণ করে দেবে (সে ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যেসব দেশে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা বলবৎ আছে- সেসব দেশের সংবিধান অনুসরণ করা যেতে পারে)। জাতীয় ও প্রাদেশিক বাজেট, শুল্ক আদায়, প্রাদেশিক সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন তহবিল প্রদান, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থাদি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিমণ্ডলে উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়াদি সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকবে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে সংবিধান মোতাবেক সমাধান করতে হবে। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থার সুবিধাদি বাংলাদেশ মূলত প্রায় সমজাতীয় জাতিসত্তার জনঅধ্যুষিত দেশ।
মোট জনসংখ্যার ৯৯ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। ২০১০ সালের আমদশুমারি অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৯.৭% মুসলমান, ৯.২% হিন্দু, ০.৭% বৌদ্ধ, ০.৩ খ্রিস্টান এবং ০.১% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের দেশ। এখানে সংবিধান-প্রদত্ত বিধানের ফলস্বরূপ একই ভাষা ও ধর্মের বেশিরভাগ নাগরিক যে সুফল ভোগ করছে, বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের সংখ্যালঘু নাগরিকরাও সমানভাবে সে সুফল ভোগ করছে। প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে কোনোভাবেই আঞ্চলিকতা সৃষ্টি হওয়া কিংবা বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কোনো ধরনের আশঙ্কা থাকবে না।
বরং প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থায় সারাদেশে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। এতে করে জাতীয়, প্রাদেশিক ও তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করতে পারবেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। স্থানীয় উন্নয়ন তদারকি করা কিংবা উন্নয়নের ত্রে বাছাই করার জন্য জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সমন্বয়ে উন্নয়ন উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ পদ্ধতি সরকারের সর্বস্তরের কার্যকলাপে দায়-দায়িত্ব ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারবে।
যে দল অথবা দলসমূহের কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় থাকবে তারা পরবর্তী নির্বাচনে আবার বিজয়ী হবার জন্য তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কিংবা জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জনে যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাবে। এর ফলে স্থানীয় উন্নয়ন আরো জোরদার হবে, দুর্নীতি দূর হবে এবং উন্নয়ন তহবিলের অপচয় কমে আসবে। অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে জনগণ খুব কাছ থেকে সরকারের কর্মকাণ্ড অবলোকন করতে পারবে। এতে করে প্রাদেশিক সরকারের দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা আরো জোরদার হবে।
প্রাদেশিক রাজধানী হবে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র। এর ফলে জনগণ কেন্দ্রীয় রাজধানীর বদলে প্রাদেশিক রাজধানীর দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং কেন্দ্রীয় রাজধানীতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ কমে আসবে। প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে কেন্দ্রীয় রাজধানী বাদে দেশে আরো ৮টি গুরুত্বপূর্ণ বড় শহর গড়ে উঠবে। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশে নতুন শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এমন কোনো কঠিন কাজ নয়।
এখানে দল-মত নির্বিশেষে সকলের একান্ত আন্তরিকতা ও ঐকমত্য সৃষ্টি হলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন হয় সংবিধানের পরিবর্তন। এই সংবিধান পরিবর্তনের জন্যই সবার আগে প্রয়োজন সকল দলের ঐকমত্যে পৌঁছা। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের আর কোনো বিকল্প নেই। এ দেশে আমিই প্রথম প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছি বলে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে সকল কৃতিত্বই যে আমার অনুকূলে চলে আসবে- তা নয়।
দেশ ও জাতি উপকৃত হবে সেটাই হবে বড় কথা। কোনো সংস্কার খুব সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। আমি যখন মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করেছি কিংবা থানাকে উপজেলা করেছি, সেই সংস্কারও প্রথমে অনেকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি। অর্থনৈতিক অবস্থা-পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ এখন তো সেই প্রশাসনিক সংস্কারকে যুগান্তকারী বলে বর্ণনা করছেন।
আমি মনে করি, প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে রাষ্ট্র পরিচালনা-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি-উন্নয়ন এবং শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সুফল বয়ে আনবে। আমার প্রস্তাবনার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি বা ঘাটতি থাকতে পারে। আলোচনার মধ্য থেকেই আমরা তা সংশোধন করে নিতে পারবো বলে একান্তভাবে বিশ্বাস করি।
আমি প্রস্তাবিত প্রদেশসমূহের নামেরও প্রস্তাব রাখছি। এ নাম পরিবর্তনও করা যেতে পারে।
১। প্রদেশের সংখ্যা : ৮ (আট)২। প্রস্তাবিত প্রদেশের নাম : ক) উত্তরবঙ্গ। খ) বরেন্দ্র গ) জাহাঙ্গীরনগর। ঘ) জালালাবাদ ঙ) চট্টলা।
চ) ময়নামতি। ছ) জাহানাবাদ এবং জ) চন্দ্রদ্বীপ।
৩। প্রদেশের আয়তন এবং অঞ্চল:
উত্তরবঙ্গ প্রদেশ (৮টি জেলা) লালমনিরহাট, গ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।