গত পোস্টে পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন কে নিয়ে পুরো গল্পটা শেষ করতে পারিনি । আজ আপনাদের জন্য তাই শেষ পর্ব টি নিয়ে এলাম ।
আসলে পরিচালক খোকনের কাজ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলে একটি বা দুটি পর্বে শেষ করা সম্ভব নয় । আমি সংক্ষেপে খোকনের ৯০ পরবর্তী কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি নিয়ে কথা বলবো ।
পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন আমাদের সময়কার দর্শকের কাছে আজীবন চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন ।
আমাদের কাছে উনার আরেকটি পরিচয় হলো যে রুবেলের ছবির পরিচালক । কারন চিত্রনায়ক রুবেলের প্রথম দিকের ছবিগুলো থাকতোই উনার তৈরির । আর রুবেলের ছবি আসা মানেই দেখা লাগবেই এমন একটা অবস্থা । অবশ্য এর কিছুদিন পর খোকন ছাড়াও রুবেল পরিচালক আবুল খায়ের বুলবুল ও এ জে রানার সাথেও জুটিবদ্ধ ভাবে অনেকদিন কাজ করেছেন । যাই হোক খোকনের কথায় ফিরে আসি ।
৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরিচালক খোকন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও তার পরবর্তী সময়ের একটি দুর্দান্ত গল্প নিয়ে ‘কমান্ডার’ নামক ছবি তৈরি করেন । যেখানে নাম ভুমিকায় ছিলেন সোহেল রানা আর ২য় নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন । এই ছবিতে ফরিদি থাকলেও রুবেল ছিলেন না । সেই প্রথম রুবেল আর খোকনের মধ্য বিরতি দেখতে পেলো দর্শকরা । তবুও রুবেল বিহীন ‘কমান্ডার’ ছবিকে লুফে নেয় হুমায়ুন ফরিদি ও ছবির গল্পের জন্য ।
যে ছবিতে ফরিদিকে সিঁধেল চোর হিসেবে দেখা যায় যাকে ধরতে হলে আগে বালু / মাটি ছুঁড়ে মারতে হয় যেভাবে একটি জ্যান্ত শিং মাছ কে ধরতে হয় সেভাবে । দুর্দান্ত ফরিদির কারনে দর্শক রুবেল এর অভাব ভুলে গিয়েই হলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো । ফলাফল রুবেল বিহীন খোকনের সুপারহিট একটি ছবি । এরপরেই খোকন শুধু ফরিদিকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে বিপরীতে শাবানা, চম্পা ও সুবর্ণা মোস্তফা’র মতো তিনজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে নিয়ে তৈরি করলেন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম নায়কবিহীন সম্পূর্ণ সোশ্যাল কমেডি ছবি ‘পালাবি কোথায় ’ । যার প্রযোজক ছিলেন ফরিদি নিজেই।
ছবিটি ঈদের ছবিগুলোর সাথে মুক্তি পেলো কিন্তু ফলাফল খুবই খারাপ । অর্থাৎ ছবিটির গল্পে নতুনত্ব ও নির্মাণে মুন্সিয়ানা থাকলেও দর্শক ছবিটি গ্রহন করেনি । ব্যবসায়িক ভাবে ব্যর্থ হয় ফরিদির প্রযোজিত প্রথম ছবিটি যার ফলে ২য় আর কোন ছবি প্রযোজনা করেনি । এরপর পরেই আবার খোকন রুবেল ও ফরিদি ফিরে আসেন দুর্দান্ত ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ছবিটি দিয়ে । যা ছিল সেই বছরের সেরা ১০টি ব্যবসাসফল ছবির একটি ।
‘বিশ্বপ্রেমিক’ ছবিটির গল্প অন্য সবগুলো ছবির চেয়ে আলাদা , হুমায়ুন ফরিদিকে কৌতুক ও খল দুই ভাবে উপস্থাপন এবং
আলম খানের সুরের একাধিক দুর্দান্ত গান ছিল ছবিটির প্রান । এরপর রুবেল কে নিয়ে ঘাতক ও ভণ্ড সুপারহিট লম্পট ও নরপিশাচ নামক দুটি ছবিতে খোকন রুবেল ও ফরিদিকে দর্শক পায় ।
একটানা চারটি সুপারহিট ও হিট ছবির পর খোকন আবারও রুবেল কে ছাড়া আরেক মার্শাল আর্ট হিরো আলেকজান্ডার বো কে নিয়ে ‘ম্যাডামফুলি’ নামক একটি নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরি করেন যা ছিল চিত্রনায়িকা শিমলার প্রথম ছবি । ‘ম্যাডামফুলি’ ছবিটির গল্প ও শিমলার দুর্দান্ত অভিনয়ের কারনে ছবিটি দর্শক প্রিয়তা পায় । প্রথম ছবিতেই শিমলা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন ।
এই ছবিতে আরও ছিলেন ববিতা,ফরিদি ও শামসুজ্জামান । যেখানে ‘ভণ্ড’ ছবির পর এই ছবিতেও ফরিদি – শামসুজ্জামান এর বেশকিছু কৌতুক রসায়ন ছিল যা দর্শকদের চরম আনন্দ দেয় । এরপর আবার রুবেল ,শিমলা ,ফরিদি ও শামসুজ্জামান কে নিয়ে আরও একটি রোমান্টিক কমেডি ছবি ‘পাগলা ঘণ্টা ’ নির্মাণ করেন যা দর্শকপ্রিয়তা পায় । এরপর আবারও রুবেল বিহীন খোকন নির্মাণ করেন সেই সময়ের দুর্দান্ত ফরমে থাকা চিত্রনায়ক মান্নাকে নিয়ে ‘ভেজা বিড়াল ‘ ছবিটি । ছবিটির গল্প , নির্মাণ , মান্নার অভিনয় সব কিছু ঠিক থাকার পরেও দর্শক প্রিয়তা পায়নি যার ফলে মান্নাকে নিয়ে আর কোন ছবি তৈরি করেনি খোকন ।
এরপর আবার রুবেল কে নিয়ে তৈরি করেন এই দশকে ‘যোদ্ধা’ ছবিটি । এরপর ‘মুখোশধারী’ ছবিতে রুবেল ও শাকিব খান এবং সর্বশেষ ‘চাই ক্ষমতা’ ছবিতে রুবেলকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করেন । সেটাই সম্ভবত খোকনের সাথে রুবেলের শেষ কাজ ছিল । এরপর খোকন ইম্প্রেস টেলিফিল্ম এর মাধ্যমে ‘লাল সবুজ’ একটি ছবি নির্মাণ করেন যার নায়ক ছিল মাহফুজ । এই ছবিটিও তেমন ভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি যেমনটি খোকনের আগের ছবিতে পাওয়া যেতো ।
এরপর থেকে খোকন একটা লম্বা বিরতি দিয়ে শাকিব খান কে নিয়ে তৈরি করেন ‘টাকা’ এবং এরও অনেকদিন পর নির্মাণ করেন ‘ভণ্ড’ ছবির সিকুয়্যাল ‘চেহারা ভণ্ড ২’ যা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে । এরপর আর খোকনের নতুন কোন ছবি দেখা যায়নি ।
পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন এর পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যর পাল্লা অনেক অনেক বেশি ভারী । সাফল্যর কাছে ৩/৪ টি ছবির ব্যর্থতা কিছুই নয় । খোকন যে মেধাবী ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই ।
যে খোকন আমাদের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের শেষ দেড় দশক সহ তিন দশকে অনেক অবদান রেখেছেন তাঁর বিনিময়ে খোকন কে সেভাবে মূল্যায়ন করতে আমরা পারিনি যা আমাদের ব্যর্থতা । খোকন কে নতুন প্রজন্মের সিনেমার দর্শকরা চিনুক আর নাই চিনুক খোকনের নাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরাদের তলিকায় চিরদিন রাখতেই হবে। বাংলা সিনেমাপ্রেমিদের কাছে খোকনের নাম চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
উপমহাদেশে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র জগত বলিউড যখনও মার্শাল আর্ট নির্ভর ছবি তৈরি করতে পারেনি সেখানে খোকন একের পর এক মার্শাল আর্ট ভিত্তিক অ্যাকশন ছবি দিয়ে সাফল্য পেয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশে মার্শালআর্ট জনপ্রিয় করার পেছনে পরিচালক খোকনের অনেক অবদান যা অনস্বীকার্য । খোকনের মতো একজন পরিচালক বলিউড পেলে অনেক দূর এগিয়ে যেতো এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতো এটা বলা যায় ।
অথচ এই খোকনের এখনও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আরও অনেক কিছু দেয়ার ক্ষমতা আছে কিন্তু আমরা তা নিতে পারছিনা যা আমাদের চিরকালের একটি বদস্বভাবের উদাহরন ছাড়া কিছুই নয় । আমরা গুণীদের সম্মান ও মূল্যায়ন করতে জানিনা তাই তো আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ৯০ দশকের চলচ্চিত্রের চেয়েও অনেক পিছিয়ে আছে যা দেখলে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনা । আমরা কি পারিনা আবারও একজন শহিদুল ইসলাম খোকনের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্র শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে ?
খোকনের পরিচালিত ছবিগুলো - ১) পদ্মগোখরা
২) নাম অজানা
৩) লড়াকু
৪) উদ্ধার
৫) বীরপুরুষ
৬) বজ্রমুসঠি
৭) বিপ্লব
৮) অকর্মা
৯) বিষদাঁত
১০) উত্থান পতন
১১) সন্ত্রাস
১২) টপ রংবাজ
১৩) অপহরণ
১৪) শত্রু ভয়ংকর
১৫) সতর্ক শয়তান
১৬) দিনমজুর
১৭) গৃহযুদ্ধ
১৮) দুঃসাহস
১৯) কমান্ডার
২০) পালাবি কোথায়
২১) ঘাতক
২২) লম্পট
২৩) ভণ্ড
২৪) নরপিশাচ
২৫) ম্যাডাম ফুলি
২৬) শত্রু চারিদিকে
২৭)রাক্ষস
২৮) যোদ্ধা
২৯) ভেজা বিড়াল
৩০) মুখোশধারী
৩১) চেহারা ভণ্ড ২
৩২) লাল সবুজ
৩৩) বাঙলা
৩৪) টাকা
৩৫) বিশ্বপ্রেমিক
আগামীকাল পড়ুন - বাংলার অ্যাকশন হিরো রুবেলের গল্প
একটি একটি রেডিও বিজি ২৪ এর নিবেদন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।