আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাঠশালার প্রথম পাঠ

বরাবরের মতই প্রতারক এবং পলাতকগণ দূরে থাকুন

হলিউডের ম্যুভিগুলোতে যখন দেখায় ক্লাসের গোবদা গোবদা পোলাপানের হাতে নতুন আসা ছাত্রছাত্রীরা নাকাল হচ্ছে, আপনাদের তখন কি মনে হয় জানি না!! আমার কিন্তু কিন্ডার গার্টেনের প্রথম দিকের দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়। তবে স্কুলে যে শুধু নাকাল হয়েছি তা নয় মজাও পেয়েছি অনেক। আজো আমার মনে পড়ে মেজ ভাইয়ার সাথে যেদিন প্রথম স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম, জানুয়ারি’৯২ এর কোন এক সকাল। সেদিন স্কুলে বোধহয় কি একটা অনুষ্ঠান চলছিল ম্যামরা সবাই স্কুল গেটের কাছে রোদে চেয়ার নিয়ে বসে ছিলেন। ভাইয়া যেইনা একজন ম্যামকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “ম্যাম, আমার ছোট ভাইটাকে স্কুলে ভর্তি করাতে চাই সাথে সাথে চারদিক থেকে তীরের মত প্রশ্ন আসতে থাকল, ওর বয়স কত?? লিখতে পারে ?? পড়তে পারে ?? দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এনেছ?? তিনশ টাকা এনেছ?? আমি এহেন প্রশ্ন বাণে বিদ্ধ হয়ে দম নিতে ভুলে গেলাম আর মেজ ভাইয়া, বেচারার কতই বা বয়স সেভেন এইটে পড়ে বোধহয় !! খাবি খেতে কোনমতে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন, আসলে জানতে চেয়েছিলাম ওকে স্কুলে ভর্তি করতে হলে কি কি লাগবে।

বাসায় এসে মেজ ভাইয়া বাবার কাছে একদফা ইন্টারভিউ দিল, তারপর ধার্য করা হল আমাকে এই স্কুলেই ভর্তি করা হবে। প্রথম স্কুলে যাব যথারীতি কপালে জুটল মেজ ভাইয়ার একটা পুরনো স্কুল ব্যাগ, কিন্তু সেটা নিয়ে অভাব অভিযোগ করার কথা মনেই আসে নি। আমি তখন নতুন স্কুলে যাবার স্বপ্নে বিভোর। আমার খুব ইচ্ছা আমার একগাদা বন্ধু হবে। তারা আমার বাসায় ডাকতে আসবে।

যেমন আসে মেজ ভাইয়ার বন্ধুরা। খাতা নিলাম, পেনসিল নিলাম, পেনসিল দিয়ে লিখতে হবে জেনেও কলম নিলাম এই ভেবে যে কাজে লেগেও যেতে পারে। পরদিন সকালে বাবার সাথে গেলাম স্কুলে, এবার সরাসরি হেডস্যারের রুমে। নতুন জায়গা কিরকম যেন আড়ষ্ট লাগছিল। আমাকে বসতে বলে কী কী যেন জিজ্ঞাসা করলেন, সবগুলো পেরেছিলাম।

তারপর খাতা পেন্সিল দিয়ে কি জানি লিখতে বলে স্যার আর আব্বা রাজনীতি নিয়ে বিশাল গপ্পো শুরু করলেন, আমিও লেখা বাদ দিয়ে হা করে তাদের কথা শোনা শুরু করলাম। এক পর্যায়ে তাদের যখন হুঁশ হলো আমি লিখছিনা তখন আমাকে তাড়া লাগালেন। এই অভ্যাস এখনও রয়েছে আমি প্রায়ই নিজের কাজ করতে ভুলে যাই আর তাড়া না দিলে আমার কাছ থেকে কোন কাজ আদায় করা খুব দূরহ। যা হোক এরপর হেডস্যার আমার খাতা দেখে বললেন, হুম একটু স্লো, তবে ভর্তি করানো যাবে। “স্যার, আমি আজো স্লো-ই আছি ফাস্ট হতে পারিনি”।

যাহোক এইবার বাবা তাঁর তুরুপের তাস বের করলেন, হাসতে হাসতে স্যারকে বললেন, দেখুনতো ওকে কেজি টু তে ভর্তি করানো যায় কিনা?? স্যার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে, খাতার দিকে তাকিয়ে বললেন আচ্ছা সমস্যা নেই। এরপর একজন ম্যাম তার খাতায় আমার নাম লিখে আমার রোল দিলেন ৫২, এরপর এক খালার (আয়া) সাথে চললাম আমার ক্লাসে। ক্লাসরুমে ঢুকে দেখি সব গোবদা গোবদা পোলাপান। যথারীতি আমার বসার কোন জায়গা হলো না। পেছনের দিকে যেতে যেতে আমার চরম অসহায় মূহুর্তে এক দেবী তার ব্যাগটি নিয়ে ভেতরের দিকে চেপে গেলেন আর আমার বসার একটি জায়গা হলো।

কিন্তু তখনও বুঝিনি আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। বসে ছেলেদের দিকে যেই নজর বুলানো শুরুর করেছি অমনি দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে চোখে মুখে মিচকা শয়তান টাইপ হাসি। আমি ভাবছি হঠাৎ করে আমার কি এমন হল যে সবাই আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে, তারপর তাকালাম সামনের দিকে এই সারিতে শুধু মেয়েরা এবং এরাও সবাই তাকিয়ে আছে, এবং তাকিয়ে আছে আমার পাশের মেয়েটির দিকে। তখন আমি তাকালাম তার দিকে, কি কিউট একটা মেয়ে! খানিকটা লজ্জিত। ঘটনা তখন কিছুটা আঁচ করতে পারলাম।

একটা ছেলেকে বসতে দেবার জন্য তাকে বিব্রত হতে হচ্ছে। ব্যপক আকারের জেন্ডার বৈষম্য। যাই হোক ফরেস্ট গাম্প আর জেনীর মত তার সাথে আমার কিছুই হয়নি, মাস খানেক পরে সে অন্য কোন স্কুলে চলে যায়। কিন্তু তার প্রতি কোন কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি কখনো, আমার স্কুল জীবনের প্রথম সহানুভূতিশীল অ্যাঞ্জেল। নাকালের সূত্রপাত ঘণ্টা পড়লে ম্যাম ক্লাসে আসলেন, সবার দেখাদেখি দম দেয়া পুতুলের মত দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে আবার বসে পড়লাম।

ক্ষানিকপর পর তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে এসেছে না কোঁকড়া চুলের সে কোথায়?? আমি উঠে দাঁড়ালাম (এই যে আমার নামে “কোঁকড়া চুল” ট্যাগ পড়ল, এই ট্যাগ নামাতে আমার বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। মানুষ সাধারণত পরিচয় দেয় লম্বা/খাটো/ফর্সা/কালো ছেলেটা, কিন্তু আমার বেলা বলা হত কোঁকড়া চুলের ছেলেটা)। ম্যাডাম ঝাড়ি দিয়ে বললেন প্রথমদিন অত পেছনে বসেছ কেন?? আমি মিনমিন করে বললাম, জায়গা পাইনি। ভাগ্যিস তা ম্যাডামের কান অব্দি পৌঁছায়নি নইলে হয়তো আরেক দফা ঝাড়ি খেতে হত। আমাকে ডেকে দুটো ছেলের মাঝখানে জায়গা করে বসতে দিলেন।

ম্যাডাম বোধহয় ওদের তখনো ভালো করে চিনতে পারেন নি, নইলে একটা নতুন ছেলেকে ঐ দুই খবিশের পাশে বসতে দিতেন না। পুরোটা বছর ক্লাসের সব্বাইকে জালিয়ে মেরেছে এই দুই বান্দা। এই দুই খবিশের নাম আমার আজো মনে আছে। একটার নাম ছিল মনিরুল, আরেকটার নাম ছিল মাসুম। কিন্তু সে মোটেও মাসুম বাচ্চা ছিলো না, সেই ছিলো ক্লাসের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান গোবদা গোবদা।

প্রথম ক্লাস কোনমতে পার করলাম, তারপর শুরু হল অ্যাকশন। গোবদা মাসুম কোন কথা না বলে সোজা আমার ব্যাগের পকেটের চেইন খুলে আমার নতুন রাইটার কলমটা নিয়ে নিল, আমাকে কিছু বলারও প্রয়োজন মনে করল না। আমি অনেকক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করার পর তাকে বললাম, ইয়ে আমার কলমটা?? সে আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, লাস্ট পিরিয়ডে নিস। লাস্ট পিরিয়ডে ঘটল আরেক ঘটনা, হাত থেকে পেনসিলটা নিচে পড়ে গেলো, আমি তুলতে যাওয়ার আগেই মনিরুল সেটা তুলে ফেলল। আমি বললাম এটা আমার।

সে আমাকে বিশাল ঝাড়ি দিয়ে বলল, আমার পেনসিল নিচে পড়েছে সেটা ভালো করে খুঁজে দেখতে। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার পেনসিল কিন্তু অসহায় বোধ করতে লাগলাম। তারপর খোদার কাছে প্রার্থনা করতে থাকলাম, হে আল্লাহ !! তুমি তাড়াতাড়ি এই ক্লাস শেষ করে দাও। একটা সময় ক্লাস শেষ হল, আমি বাইরে এসে দেখলাম মা দাড়িয়ে আছেন, আমাকে নিতে এসেছেন।

আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাসায় এসে সব খুলে বললাম, তাও একজন হলে হত। আপু, ভাইয়ারা, বাবা, মা মিলে পাঁচ দফা বয়ান করতে হল। সব শুনে বাবা মেজ ভাইয়াকে বললেন আমার সাথে পরেরদিন স্কুলে যেতে। পরদিন ভাইয়ার স্কুলে যাবার পথে সাইকেলে চেপে আমার স্কুলে আসলেন, আমাকে ক্লাসে বসিয়ে বললেন কোন ছেলে গুলো?? আমি দেখিয়ে দিলাম।

ভাইয়া ওদের খুব সুন্দর করে বললেন “এই বাবু, তুমি আমার ভাইয়ের কলম/পেনসিল নিয়েছ ??” মনিরুল সাথে সাথে আমার পেনসিল দিয়ে ভাইয়াকে বলল, “আমার পেনসিলও এরকম তো তাই ভুল করে নিয়ে গিয়েছিলাম”। আর খবিশ মাসুম বলল “আমার কলম আজ আনেনি আগামীদিন অবশ্যই এনে দেবে”। এরপর ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এল। আরেকটা ছেলেকে বলল টয়লেট কোনদিকে?? ছেলেটা কি বুঝল কে জানে!! একদিক দেখিয়ে দিল। আমি আর ভাইয়া সেদিকে গিয়ে দেখি ঐটা স্কুলের পেছনের গেট।

এবার ভাইয়া নিজেই খুঁজতে খুঁজতে আমাকে দেখিয়ে দিল টয়লেট কোথায় আর আমার ক্লাসরুম থেকে কোন পথে যেতে হবে। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম অনেকগুলো ছেলে খেলছে। এর মধ্যে দুইটা ছেলেকে ডেকে, ওদের নাম আর ক্লাস জিজ্ঞেস করল ভাইয়া। তারপর আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওরাই ছিল আমার স্কুল জীবনের প্রথম দুই বন্ধু, ফজলে রাব্বি আর বিশ্বজিৎ সরকার।

একজন হিন্দু, একজন মুসলমান। আমার কাছে আমার দুই বন্ধু। এরপর অনেকদিন আমরা একসাথে স্কুলে পড়েছি। পরের দিন আসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি পেছন থেকে আমার মুঠোর মধ্যে সরু কি যেন ঢুকছে। ভয় পেয়ে হাত ওপরে তুলে দেখি একটা কলম, পেছনে ঘুরে দেখলাম মাসুম।

পরে বললাম কলমের হেড কই?? বলল হারিয়ে গেছে। ভাবখানা এমন কলম দিয়েছি তাই না কত আবার হেড চাস। আমি আর কথা না বাড়িয়ে হেড ছাড়া কলম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলাম। এভাবেই দিন চলতে থাকল, আমার বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকল। তবে ঐ খবিশগুলোর সাথে একবছরের বেশি থাকতে হয় নি, ওরা আমাকে আর ঘাটায়নি তেমন।

কেজি টু শেষ করে আমরা যখন ক্লাস ওয়ানে উঠব তখন শুনলাম মাসুমকে ওর বাবা একেবারে ক্লাস টুতে ভর্তি করিয়ে দিল আর মনিরুল থেকে গেল কেজি টুতে আরেক বছর। ক্লাস ওয়ানের শুরুর দিকে মিলন আর মাসুদ রানার সাথে খুব খাতির হল। আর ক্লাস টুতে উঠে রাসেলের সাথে খুব খাতির হল, তবে প্রথম দিকে আমি তাকে অবজ্ঞা করতেম কারণ আমি শুনেছিলাম ও নাকি একবছর ফেইল করে এখন ক্লাস টুতে রয়েছে। এখন এসব ভাবলেই হাসি পায়। ক্লাস থ্রিতে আমি চলে আসলাম জিলা স্কুলে, ক্লাস টুতে বিশ্বজিৎ চলে যায় ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে আর ফজলে রাব্বিকে ওর বাসা থেকে ক্লাস ওয়ানেই আরেক বছর রেখে দেয়।

******************** উৎসর্গঃ গতকাল ভোরে যখন বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরছিলাম, তখন ব্যাগের ভারে নুয়ে পড়া কয়েকটা পিচ্চি কে দেখে খুব মায়া হল। লেখাটা তাদের উৎসর্গ করলাম যারা ব্যাগের ভারে নুয়ে পড়ছে

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.