আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিউইয়র্কে এবিসি সম্মেলন : দেশ ও প্রবাসের সেতুবন্ধনের আলোকবর্তিকা



নিউইয়র্কে এবিসি সম্মেলন : দেশ ও প্রবাসের সেতুবন্ধনের আলোকবর্তিকা ফকির ইলিয়াস ========================================= নিউইয়র্কে ১৭ ও ১৮ জুলাই-২০১০ শনি ও রোববার এবিসি (আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ম্যারি লুইস একাডেমির সুবিশাল চত্বরে এ সম্মেলন ছিল অভিবাসী বাঙালির প্রাণের মেলা। ২০০৯-এ শুরু হওয়া এ সম্মেলনের এটি ছিল দ্বিতীয় বছর। বিদেশে বাঙালিদের মহামিলন মানেই স্বদেশ ভাবনা। এর সঙ্গে ক্রমেই যুক্ত হচ্ছে, পরবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের সঙ্কট, সম্ভাবনাসহ নানা দিক।

এবারের সম্মেলনটি ছিল অত্যন্ত জমজমাট। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য তো বটেই, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকেও শিকড় সন্ধানী বাঙালি অভিবাসীরা ছুটে এসেছিলেন এই সম্মেলনে। পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বিশিষ্ট অতিথিদের পদচারণায় মুখরিত ছিল হাজার হাজার মানুষের এ উৎসব। এবারের সম্মেলনের সেমিনারগুলো ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এই সেমিনারগুলোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা তারা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠাবেন।

একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে অভিবাসী বিশেষজ্ঞদের এসব গঠনমূলক সুপারিশ তুলে ধরা হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে। 'স্বদেশ বিনির্মাণে প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও মেধা ব্যবহারে সরকার কতটা আন্তরিক' শিরোনামে সেমিনারটিতে মূল প্রবন্ধ পড়েন সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. ফাইজুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ঢাকা'র উপদেষ্টা ড. মনজুর আহমেদ, ড. মোস্তাফা চৌধুরী, ড. হাসান মাহমুদ, ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। এ সেমিনারে সব বাধা সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও মেধাবৃত্তি চর্চার দরজা অবারিত করার আহ্বান জানানো হয়। 'সুস্থ রাজনীতির বিকাশ এবং মানবাধিকার রক্ষায় সরকার ও বিরোধীদলের ভূমিকা' শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ড. আলী রীয়াজ।

আলোচনায় অংশ নেন ড. মাহফুজুর রহমান, ড. মাহবুবুর রহমান, ড. সিদ্দিকুর রহমানসহ মূলধারার বেশ কিছু রাজনীতিক ও মানবাধিকার নেতারা। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে সহনশীল এবং বিরোধীদলকে গঠনমূলক কর্মকান্ডে প্রত্যয়ী হওয়ার আহ্বান আসে বক্তাদের পক্ষ থেকে। 'প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে নতুন প্রজন্মের সংঘাত ও সমাধানের উপায়' সেমিনারটি ছিল নতুন প্রজন্মের বাঙালি আমেরিকানদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসম্যান পদপ্রার্থী রেশমা সুজানী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ রাজনীতিক তার বক্তব্যে অভিবাসী জীবনের সৌন্দর্য এবং প্রতিকূলতা তুলে ধরেন নতুন প্রজন্মের সামনে।

তা কাটিয়ে ওঠার বিভিন্ন দিক নির্দেশনাও ছিল তার আলোচনায়। ড. ইলোরা রফিক, ড. রিফাত সালাম, ডা. ইভান খানসহ এ প্রজন্মের বেশ ক'জন পেশাজীবী এতে অংশ নেন। 'গণতন্ত্রের বিকাশ ও উন্নয়নে মিডিয়ার ভূমিকা' সেমিনারটি ছিল দর্শক শ্রোতার কানায় কানায় পূর্ণ। প্রধান আলোচক ছিলেন, বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান সাবির মোস্তফা। মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন 'যায়যায়দিন'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শফিক রেহমান।

অংশ নেন, সাবেক প্রেস মিনিস্টার ফজল এম. কামাল, ভয়েস অব আমেরিকার সরকার কবির উদ্দিন, রোকেয়া হায়দার, ড. এবিএম শফিকুর রহমান, এনা সম্পাদক লাবলু আনসার প্রমুখ। প্রথমদিন বিকেলে সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিরলপ্রজ কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে কবিতা-আড্ডা। মুক্তমঞ্চে এই জনাকীর্ণ আড্ডায় কবিতা পড়েন- লুৎফুন নাহার লতা, তমিজ উদদীন লোদী, শামস আল মমীন, সালেম সুলেরী, জেসমিন মোশতাক প্রমুখ। এ আড্ডাটি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আড্ডা শেষে কবি শহীদ কাদরীর হাতে 'এবিসি সম্মেলন সম্মাননা পদক' তুলে দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত আরেকজন কৃতী বাংলাদেশের সন্তান ড. ওসমান সিদ্দিক।

কবি শহীদ কাদরী গভীর আপ্লুত হয়ে বলেন, কবিতা লিখে এমন বিরল সম্মান পাব, তা কোনোদিন ভাবিনি। তিনি প্রজন্মকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি চর্চায় গভীর অনুরাগী হওয়ার আহ্বান জানান। ১৭ জুলাই সন্ধ্যার পর জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। পদক প্রাপ্তরা হচ্ছেন- আবদুল মালেক বীরবিক্রম, ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সিতারা রহমান বীরপ্রতীক, আবু তাহের বীরপ্রতীক, লেফটেন্যান্ট (অব.) মমতাজ হাসান বীরপ্রতীক এবং ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমেদ বীরপ্রতীক। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জে. (অব.) সি আর দত্ত বীরউত্তম।

এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা রথীন্দ্রনাথ রায়, উমা খান, কাদেরী কিবরিয়া, মনজুর আহমেদ ও শহীদ হাসানকেও বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। ১৮ জুলাই রোববার পাঁচটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সেমিনারটি ছিল-'অভিবাসী কমিউনিটির কল্যাণে সামাজিক সাংস্কৃতিক আঞ্চলিক সংগঠনের ভূমিকা'। প্রধান আলোচক ছিলেন ইউএস সেন্সর ব্যুরোর ড. খন্দকার মনসুর, মডারেটর ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. জাফরুল হাসান, এতে অংশ নেন ড. কুসুমিতা প্যাটারসন, প্রাবন্ধিক লিয়াকত হুসেন আবু প্রমুখ। আঞ্চলিক সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরো গতিশীল করে কমিউনিটির উন্নয়ন সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা।

'বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা' শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়েন এমআইথ্রি'র ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. জন এস বারটনি। মডারেটর ছিলেন আবু হানিফ। অংশ নেন ড. শাহজাহান মাহমুদ, ড. মহসিন পাটওয়ারী, অধ্যাপক স্বপন গায়েন, ড. নাজিম উদ্দিন, ড. মোহাম্মদ ফারুক প্রমুখ। 'প্রবাসে দাম্পত্য কলহ এবং তা প্রতিকারের উপায়' শিরোনামের সেমিনারটি ছিল বেশ উপভোগ্য। মূল প্রবন্ধ পড়েন হিউম্যান রাইটস নেত্রী নাহার আলম।

সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন অ্যাটর্নি অশোক কুমার কর্মকার। এতে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপিকা আসমা আব্বাসী, ড. মনসুর খান, প্রফেসর গোলাম মাতবর, অ্যাটর্নি সমতলী হক প্রমুখ। নিজস্ব কৃষ্টি এবং সভ্যতা সমুন্নত রেখে পারিবারিক সামাজিক জীবন পরিচালনার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন আলোচকরা। 'পরিবেশ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত' শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধ পড়েন ড. নজরুল ইসলাম। মডারেটরের দায়িত্বে ছিলেন, বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. সুফিয়ান খন্দকার।

এতে বক্তব্য রাখেন ল্যান্স সিমেন্স, প্রফেসর মিয়া আদিল খান, ড. খালেকুজ্জামান, অ্যাটর্নি তওফিক চৌধুরী, ড. সারওয়ার চৌধুরী প্রমুখ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিরোধে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর ব্যাপক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আলোচকরা। সম্মেলনের শেষ সেমিনারটি ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি শিল্পবিষয়ক। এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিকের উপস্থিতিতে সেমিনারে ছিল উপচে পড়া ভিড়।

'বহির্বিশ্বের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পচর্চার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে কি?' বিষয়ে এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়েন, ফেরদৌস সাজেদীন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অভিবাসে বাংলা চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশই বাংলাভাষার বাংলা সংস্কৃতির মূল ভরসা। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এ সংস্কৃতি বিশ্ব থেকে মুছে যাবে না। সম্মেলনের শেষ দিনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়।

এরা হলেন, ফুটবলার প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডু, ক্রিকেটার ইউসুফ বাবু, ফুটবলার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার, ভলিবল খেলোয়াড় দেওয়ান মোস্তাক রাজা, জাতীয় অ্যাথলেট আরিফুল হক, সাঁতারু সরওয়ার ইমাম লিটু, অলিম্পিয়ান শাহজাহান মোবিন, অলিম্পিয়ান শাহান উদ্দিন, সাঁতারু কারার মিজান, মহিউদ্দিন দেওয়ান প্রমুখ। দেশ ও প্রবাসে বিশেষ অবদানের জন্য কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনকেও পদক প্রদান করা হয় এ সম্মেলনে। দুই দিনের সম্মেলনে বাংলাদেশের কৃতী চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর তার আঁকা চিত্রের একক প্রদর্শনী করেন। এবারের সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক ও লেখক সাঈদ-উর-রব। তার নেতৃত্বে একটি সুদক্ষ পরিচালনা টিম সম্মেলনটি অত্যন্ত সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছে।

দুই দিনের সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বে বিশিষ্ট অতিথিদের মাঝে আরো ছিলেন দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, শিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী, মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার সাবেক এমপি মাহবুবুর রব সাদী, মার্কিন কংগ্রেসম্যান অ্যান্থনি উইনার, কংগ্রেসওম্যান ইভেট ডি. ক্লার্ক, নিউইয়র্ক সিটির কন্ট্রোলার জন ল্যু, নিউইয়র্ক টাইমসের মেট্রো এডিটর কার্ক সেম্পল প্রমুখ। সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক পর্বে দুই দিনে অংশ নেন, সুবির নন্দী, কনক চাঁপা, নাফিজা, নওশীন, বালাম, ফকির শাহাবুদ্দিন, মাহমুদুজ্জামান বাবু, অভিনেতা হাসান মাসুদ, কলকাতার শিল্পী গায়ত্রী শর্মা প্রমুখ। এবারের এবিসি সম্মেলনের মূলমন্ত্র ছিল 'সবার উপরে দেশের ঠাঁই, হিংসা নয় মৈত্রী চাই'। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গঠিত হয়েছিল 'ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা (ফোবানা)'। এ ফোবানা সম্মেলন এখন বহুধাবিভক্ত।

অনিয়ম আর ব্যর্থতার কারণে ফোবানা সম্মেলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন প্রবাসী সমাজ। সে সময়ে এবিসি সম্মেলন দেশ ও প্রবাসের সেতুবন্ধনের আলোকবর্তিকা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে সার্বজনীনভাবে, সব অভিবাসী উত্তর আমেরিকাবাসীর কাছে। নিউইয়র্ক , ২১ জুলাই ২০১০ ---------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ২৩ জুলাই ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত ছবিতে - বক্তব্য রাখছেন এবিসি সম্মেলনের কনভেনর সাঈদ উর রব


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.