মাহমুদুজ্জামান
তখন ডিসেম্বর মাস’ ২০০৭। হঠাৎ করেই আমরা ক’জন সিদ্ধান্ত নিলাম এবারডিনে বৈশাখী মেলা করব। মুলতঃ আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এবারডিনে বসবাসরত সকল বাংলাদেশীদেরকে এক করা। লন্ডনের বাইরে ইউকে-তে আর কোথাও বাঙালিদের বড়সড় কোন আয়োজন তেমন দেখা যায় না। স্কটল্যান্ডের এই ছোট সাগর পাড়ের শহরে আমরাই করব বাঙালিদের এক বিশাল মিলন মেলা, সেই ছিল আমাদের ব্রত।
আমাদের এই স্বপ্ন আশ্চর্যজনকভাবে যেন ছড়িয়ে গেল সবার মাঝে। ধীরে ধীরে পুরো এবারডিন শহরেই যেন একটা মেলার আমেজ শুরু হয়ে গেল। সিটি কাউন্সিল, পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশের সাথে দেন-দরবার তো আছেই, সেইসাথে হেলথ ও সেফটি, ইভেন্ট ম্যনেজমেন্ট, ওয়েবসাইট, মেলার যাবতীয় এই সবকিছু নিয়ে হঠাৎ করেই আমরা সবাই একটা ঘোরের মধ্যে বাস করতে লাগলাম। আমাদের সবার জীবনযাত্রাই যেন গেল বদলে।
প্রতিদিনই মিটিং-এ নতুন নতুন মুখ দেখছি।
প্রতিদিনই আমাদের পরিবার বড় হচ্ছে। আমাদের দুজনের ছোট্ট স্টুডিও ফ্ল্যাটটি হঠাৎ করেই যেন বিদেশের মাটিতে ছোট্ট একটা বাংলাদেশে পরিনত হল। এখনও মাঝে মাঝে ভাবলে অবাক লাগে ওই ছোট্ট বাসাতে এতো মানুষ কেমন করে ধরতো? আমাদের সেই ক্লান্তিহীন উন্মাদনার মধ্যেই একদিন পরিচয় হল নুর ভাইয়ের সাথে। অত্যন্ত বিনয়ি স্বল্পভাষী মানুষটিকে প্রথম দেখাতেই খুব ভাল লাগলো। নুর ভাই কাজ করেন স্লামবারজার-এ ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্ট হিসেবে।
এরপর মাঝে মাঝেই দেখা হতো। এভাবেই নুর ভাই আস্তে আস্তে হয়ে গেলেন আমাদের সেই বিশাল পরিবারের একজন সদস্য। লিমি ভাবি আর মিষ্টি দুটি মেয়ে লিয়ানা এবং অরিয়াকে নিয়ে নুর ভাইয়ের ছিমছাম সংসার। লিয়ানার বয়স তখন ৭ আর অরি তখন কয়েক মাসের মাত্র। আমার সবচেয়ে আকৃষ্ট করত লিয়ানার কথা বলার ভঙ্গিমা।
নেই বিন্দুমাত্র কোন জড়তা। এতটুকু বাচ্চা নি:শ্বাস না ফেলে, এতো কথা, এতো দ্রুত, স্পষ্টভাবে, স্মার্টলি, কিভাবে বলছে সেটাই আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আর লিমি ভাবি অত্যন্ত কর্মঠ একজন মহিলা। এবারডিনে বসেই তখন তিনি বাংলাদেশে একটি ইংরেজী মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন (The Executive Times ), নিজের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী গঠনের কাজ এগিয়ে চলছিল। তাছাড়া কাজ করতেন পাবলিক রিলেশন ম্যানেজার হিসেবে একটা রেস্টুরেন্টে।
বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের নিয়ে এবারডিনে সেমিনারের পরিকল্পনা করছিলেন। পরে শুনেছি ক্রিস্টাল রে’স নামে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী গঠন করেছেন ভাবি। সফলভাবে ব্যাবসায়ীদের নিয়ে একটা সেমিনারও করেছেন এবারডিনে।
গত বুধবার (৭ই জুলাই) সকালে নুর ভাই আর লিমি ভাবি তাদের সদ্য কেনা বাড়িটির চাবির গোছা হাতে পেয়েছেন। স্বপ্নের সিড়িগুলোর আরো একটা ধাপ পেরিয়ে সুখে আচ্ছন্ন এই দম্পত্তি।
নতুন বাড়ীর জন্য নতুন কিছু আসবাবপত্র কিনতে বিকেলে ডান্ডির কাছে ikea-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। ড্রাইভ করছিলেন নুর ভাই। পাশের সিটে লিমি ভাবি। পেছনের সিটে বাচ্চাদুটো। বিধাতার হিসাবটা হয়ত ছিল ভিন্ন।
এবারডিন আর ডান্ডির মাঝপথে দুর্ঘটনায় লিমি ভাবি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাচ্চা দুটো আশঙ্কাজনক অবস্থায়। মাথায় আঘাত পেয়েছে। নুর ভাই মোটামুটি সুস্থ। আচমকা এই খবরটায় সবাই স্তম্ভিত।
ঘটনাটি সান্তনা দেবার উর্ধ্বে। বাচ্চাদুটো হাসপাতালে। প্রতিনিয়ত খবর পাচ্ছি। এই দূরে থেকে দোয়া করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।
এবারডিন ছেড়ে টরন্টোতে এসেছি প্রায় দুবছর হল।
কিন্তু যোগাযোগ আছে সার্বক্ষনিক। বাংলাদেশের বাইরে প্রথম যে পারিবারিক, বা বন্ধুদের ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছি, সেটা এবারডিনে। পড়াশুনা, চাকুরীর বাইরেও যে ভালোবাসার মানুষগুলোর একটা বন্ধন আমরা তৈরি করেছিলাম, বিদেশের মাটিতে অন্তত বাঙালিদের মধ্যে তা বিরল বৈকি। তাইতো আমরা সবাই নুর ভাইয়ের এই দুঃসংবাদে স্বজন হারানোর ব্যাথা অনুভব করি।
ভয়াবহ এই দুঃসময়ে যারা নুর ভাইয়ের পাশে আছেন, রাত জেগে ডান্ডি হাসপাতালে সঙ্গ দিচ্ছেন সেই সব বন্ধুদের প্রতি আমার সহস্র ভালোবাসা।
ফেসবুকে, ইমেইলে যে যেমন করেই পারছে একজন আরেকজনের সঙ্গে অনুভুতিগুলো শেয়ার করছে। এই দুরদেশে এমন বন্ধু, সুভাকাঙ্ক্ষী মেলে?
যে যেখানেই থাকি সাবধানে থাকি, আর এভাবেই হাত বাড়িয়ে দিই পাশের বিপদ্গ্রস্থ বন্ধুটিকে। সেই তো আমার পরিবার!
http://www.notundesh.com/shukhdukkho.html
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।