সত্যানুসন্ধিৎসু
স্বাধীনতা আগে বাংলাদেশে অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তানে রাজনৈতিক যোগসূত্র অনুসারে প্রধান দু’টি ছাত্র সংগঠন ছিল যার একটি ‘ছাত্রলীগ’ ও অন্যটি ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ আর তৃতীয়টি এনএসএফ(মুসলিম লীগের ন্যাশনাল স্টুডেন্টস’ ফ্রন্ট)। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে প্রথমেই ছাত্রলীগ ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়। নবগঠিত ছাত্রলীগ হচ্ছে জাসদ সমর্থিত। এই জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ আবারও বিভক্ত হয় বাসদ সমর্থিত বলে। ছাত্র ইউনিয়নও কয়েকভাগে বিভক্ত হয় যেমন: ‘পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন’, ‘বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’ ইত্যাদি।
জিয়ার আমলে এসে ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’, 'ছাত্র মৈত্রী' জন্ম নেয়। নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ১৯৭৬ সালে ‘ইসলামী ছাত্র শিবির’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। অনুরূপভাবে এরশাদের আমলে জন্ম নেয় ‘জাতীয় ছাত্র সমাজ’। চীনপন্থী ন্যাপ-এর একটি অংশের (পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স পার্টি) অঙ্গসংগঠন হিসেবে 'ছাত্র মৈত্রী' শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ছাত্র সংগঠনগুলো গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা ছিল স্বাধীনতার আগে।
‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী ছাত্রআন্দোলন, ‘৬৯-এর ছাত্রগণঅভ্যুত্থান. ‘৭০-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল মূল শক্তি। অতঃপর ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে শসস্ত্র যুদ্ধে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররাই ছিল প্রথম সারিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শতকরা ৮০% ভাগের বেশিই ছিল সে সময়ের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। কিন্তু স্বাধীনতার পর ছাত্রদের সব দায়দায়িত্ব যেন শেষ হয়ে যায়, আর সেইসাথে অতীত অর্জন আস্তে আস্তে দুষ্কর্মের কালিমায় কলঙ্কিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুবাদে স্বাধীনতার পর অধিকাংশ ছাত্রেরই নানা কারণে লেখাপড়ার প্রতি আগের সেই ঝোক স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং তৎকালীন সময়ে দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে এদের লেখাপড়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭২-৭৩ সালের বিভিন্ন একাডেমিক পরীক্ষার হলগুলোতে ছাত্ররা প্রকাশ্যেই এমনকি টেবিলে পিস্তল, রিভলবার বা স্টেনগান রেখেও পরীক্ষা দিতো বই খুলে। শিক্ষাঙ্গনে নিয়ম-শৃঙ্খলা বা প্রশাসনিক কতৃপক্ষ বলে কিছু ছিল না যারা ছাত্রদের ওই রকম পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শিক্ষঙ্গনের বাইরের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। প্রতি ১০০ জন যুবকের মধ্যে অন্তত ৫ জনের কাছে ছিল আধুনিক অস্ত্র। পরবর্তীতে এসব উৎছন্নে যাওয়া যুবকরা যারা কেউ লেখাপড়া না করেই পরীক্ষায় পাশ করেছিল সেইসব গন্ডমুর্খদেরকেই ইদানীংকালের সরকারগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায় যাদের রাজনীতি সম্পর্কে মূলতঃ কিছুদিনের গুন্ডামী-বদমাইশি ছাড়া বিশেষ কোনও শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, মেধা, বিচক্ষণতা বলে কিছুই নেই।
রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অদক্ষতাজনিত সীমাহীন বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দেয় সাধারণ জনগণকে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার একবারের চিরুনিঅভিযানের ফলাফলে আমরা দেখেছি - বিগত দু'টি সরকারের প্রায় সকল ক্ষমতাবানরাই ছিলেন বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, দেশ ও জনগণের প্রতি কোনওরূপ ভালবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বলে তাদের মধ্যে কিছুই ছিল না। তাদেরই অপকর্মের মাশুল এখন দিচ্ছে জনগণ।
দিনাজপুর গণপুর্ত বিভাগে ১৫ কোটি টাকার কাজে ঠিকাদাররা টেন্ডার জমা দিতে গেলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা এভাবেই অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করে। ঘটনায় একজন নিহত ও ২০ জন আহত হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মী ফারুক হোসেনকে হত্যা করে ইসলামী ছাত্রশিবির এভাবেই লাশ সেফটি-ট্যাংকে লুকিয়ে রাখে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বশস্ত্র ছাত্রলীগ]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দুই গ্রুপের স্বশস্ত্র তান্ডব।
ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রলীগের ক্যাডারবাহিনী
বরিশাল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ছাত্রলীগের দু'পক্ষের কোপাকুপি
পরে ধীরে ধীরে সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে বটে; তবে ছাত্ররাজনীতি হয়ে পড়ে লক্ষভ্রষ্ট, দায়দায়িত্ব ও আদর্শহীন ও রাজনৈতিক দলগুলোর নিছক লেজুড়বৃত্তিমূলক। লাখ বা কোটি টাকায় নেতুত্ব বেচা-কেনা, আধিপত্য বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিবাণিজ্য, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, বিভিন্ন মার্কেটে চাঁদাবাজি, টেন্ডার ছিনতাই, অর্থের বিনিময়ে অন্যের জমি-জমা, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট ইত্যাদি দখলে অংশ নেয়া, অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র কেনাবেচা, হস্তগতকরণ ও অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণগ্রহণ, মিছিল-মিটিংয়ে গুলিবর্ষণ, মানুষ হত্যা, ছিনতাই-ডাকাতিতে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র ভাড়া দেয়া বা ভাড়া নেয়া, ধ্বংসসাধন, বোমাবাজি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, আন্তঃকোন্দল ও সংঘর্ষ, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও তাদের সম্পত্তি দখল, সুন্দরী কোনও মেয়ে হাইজ্যাক করা বা জোরপূর্বক তুলে এনে বিয়ে করা, ছাত্রীদের দিয়ে দেহব্যবসা করানো - এসবই হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলোর নিত্যনৈমিত্তক কাজের অংশ। বর্তমানে প্রায় সবগুলো ছাত্রসংগঠনের সামগ্রিক অবস্থা একই রকম।
একজন যোগ্য ‘গডফাদার’ পেলে এসব সংগঠন বা সংগঠনের নেতারা সবকিছুই করতে পারে। আর সাধারণ কর্মীদের চাহিদা নেতাদের তুলনায় খুবই কম, ক্ষেত্রবিশেষে চাঁদার টাকায় হলে বা হোস্টেলে ফ্রি থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করা গেলেই তারা খুশি। সাম্প্রতিককালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারি ও ১৭ জনের দল থেকে বহিস্কারের ঘটনা পর্যালোচনা করলেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়। এদের বেপরোয়া কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যেন সরকারেও নেই। তা না হলে ছাত্রলীগের অবিভাবকের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরে না দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।
দেশের রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে জাতিকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ওয়াল-ইলেভেনের মত ভয়াবহ পরিস্থিতিও পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন দেশ গড়ার সময়। এখন ছাত্ররাজনীতির কোনও গুরুত্ব নেই, নেতাদের কাছে তাই তাদের কদরও তেমন একটা নেই। কাজেই ছাত্ররাজনীতির আড়ালে একটা ‘ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী’ থাকার দরকার তাই আছে, সরকারী জোটের প্রত্যেক দলেরই আছে, বিরোধীদলেরও আছে।
বিগত সরকার যেমন মেয়াদ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে গদি ছেড়ে দিয়েছে, তাদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও সেভাবেই পরবর্তী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের হাতে ক্ষমতা (চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কাজকর্ম) ছেড়ে দিয়ে অবসরে কিংবা বিশ্রামে গেছে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের কেচ্ছাকাহিনীও কোনও অংশেই কম ছিল না।
যাহোক, সময়ের প্রয়োজনে দেশের সরকার, সমাজপতি, অবিভাবক তথা সুশীল সমাজের সকলকেই ছাত্ররাজনীতির সুফল ও কুফল সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। দেশ ও সমাজের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতি আইন করে বন্ধ করে দেয়া দরকার নাকি তাদের কার্যক্রম সীমিত করা ভালো - সে সিদ্ধান্ত বয়োজ্যৈষ্ঠদেরই নিতে হবে। ছাত্ররাজনীতির ওপর সরকারও ইদানীং বেশ বিরক্ত।
যাহোক, এভাবে চলতে থাকলে একদিন জাতি হয়ে পড়বে মেরুদণ্ডহীন, মেধাশুন্য, নেতৃত্বশূন্য। সংকট দিনে দিনে বাড়বে বৈ কমবে না। পরবর্তীতে কোনও এক সময় এরাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে এবং সেদিনের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা যে কী দাঁড়াবে তা এখন থেকেই অনুমান করা যায়। সুতরাং সকল অপকর্মের দায় ছাত্রদের ঘাড়ে চাপিয়ে বসে থাকলে কারো লাভ হবে না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে বন্ধ বা নিরুৎসাহিত করতে স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে আলাদা পরিচ্ছেদ সংযোজন করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে যতোই দেরি করবো পরিস্থিতি ততোই ভয়াবহ রূপ নেবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
-বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে সরকারের পক্ষপাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। আরও যা বলা হয়েছে তা দেখুন এখানে: Document - Bangladesh: Politically motivated arbitrary arrests hamper impartial investigation of campus violence
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।