আর কেন সম্মেহন-এ পাপ, থাক- ‘বেদনা আমারি থাক’
বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বে গোলক্ষুধা নিয়ে দক্ষিন আফ্রিকায় এসেছিল বিভিন্ন দেশের সুপার ষ্টাররা। প্রতিশ্রুতির ফুলে ফুলে ভরে দিয়েছিল ভক্তদের উত্তেজনা আর উন্মাদনায় ভরা শৈল্পিক হৃদয়। কোটি কোটি ভক্তের প্রত্যাশা পূরনের দায়িত্ব ছিল ওই বিখ্যাত তারকাদের কাঁধেই। তারকা পুঞ্জের কেউই সেই প্রতিশ্রুতির ভার সইতে পারেনি। পারেনি নিজেকে বিকশিত করতে।
তাইতো সুপার ষ্টারদেরই বাফানার দেশে সুপার ফপ বলে মানছেন ফুটবল বোদ্ধারা।
বিশ্ব ফুটবলের মিলন মেলায় আর বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছাসে মেতেছে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তের শৈল্পিক হৃদয়। কিন্তু প্রিয় তারকার ব্যর্থতায় সেই উচ্ছাস মুহূর্তেই বিষাদে পরিণত হয়। আর দলের ব্যর্থতায় স্বপ্ন পাগল ফুটবল ভক্তদের শীতল হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। বিশ্বকাপ শুরুর পর অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে; টুর্নামেন্ট এখন মাঝপথে।
এরইমধ্যে বিদায় নিয়েছে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও রানার্স আপ ফ্রান্স।
পাঁচ জন বিখ্যাত তারকার কথা না বললেই নয়! যারা ফুটবল মহাযজ্ঞে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিতে এসেছিল। কিন্তু দুর্বল পারফরমেন্সের কারনে নিজেরাই চমকে গেছে। আবার অনেকে ভাল খেলেও সেই চির প্রত্যাশিত গোল না পাওয়ায়, সে খেলার সঠিক মূল্যায়ন করছে না ফুটবল ভক্তরা। তবুও অনেকে এখনো হাল ছেড়ে দেননি; বিশ্বমঞ্চে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
ফুটবল মাঠের সেরকম এক সাহসী যোদ্ধার নাম লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার ফুটবল জগতের বিস্ময় বালক সে। মজার ব্যাপার হচ্ছে খোদ ফুটবল ইশ্বরই তার শৈল্পিক খেলার ভক্ত। অনেক ফুটবল বোদ্ধা তাকে দুষ্টুমি করে ডাকেন মাছি বলে। শুধু মাছি হলে একটা কথা ছিল! মাছির আগে যুক্ত করে আরেকটি বিশেষন আর তা হল ‘আণবিক’।
ইংরেজিতে ‘অ্যাটোমিক ফি’ বলে ডাকা হয় বিশ্বের সেরা ফুটবলার মেসিকে। বাংলায় যার অর্থ দাড়ায় আণবিক মৌমাছি। লিওনেল মেসিকে এ নামেই ডাকা হয়। কারণটা অতি সহজ, মেসি দেখতে ছোটখাটো, কিন্তু গতি অসাধারণ; যখন ছোটেন তখন পিছু নেয়ার সাধ্য কার? সঙ্গে পায়ের কারুকাজ আর মাথায় নিপুণভাবে বল নিয়ন্ত্রণ কৌশল। তাইতো ফিফার গত বছরের সেরা খেলোয়াড় বার্সেলোনার এই লিওনেল মেসি।
তবে মেসি এখন পর্যন্ত বার্সেলোনার হয়ে যতটা সফল, ততটা আর্জেন্টিনার জন্য নন বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বে হিসাবের খাতায় এমনটাই লেখা ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপে এ বদনাম ঘুচানোর জন্য কি করেননি মেসি? বল পায়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছেন প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ঙ্কর এই ক্ষুদে যোদ্ধা। বল পায়ে গোল না পেলেও গোল করিয়েছেন অনেক। এমনকি অধিনায়ক হিসাবেও রেখেছেন সাফল্যের ছাপ। বিশ্বকাপে প্রথম অধিনায়ক হয়ে সাইড বেঞ্চের ফুটবলার নিয়ে জয়ী হয়েছে মেসি, জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা।
মেসি কেন সেরা খেলোয়াড়? এ প্রশ্নের কুল খুজে পায়না যারা তাদের সম্পর্কে বার্সেলোনার সাবেক কোচ ও একসময়ের বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড় ইয়োহান ক্রয়েফ বলেন-‘সকলের কাছে যে কাজটি খুব কঠিন, মেসি সেটি করেন খুব সহজে। আর তাইতো মেসির সতীর্থ থিয়েরি অঁরি কিছুদিন আগে মেসিকে বললেন অতিমানব’।
মেসি সম্পর্কে ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার থিয়েরি অঁরি বলেন-‘আমি বড় মাপের অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গেই খেলেছি, কিন্তু মেসি বিশেষ কিছু; লিও অনায়াসেই যেটা করে, অন্যদের কাছে সেটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মাঝেমধ্যে তো আমার মাথা ঘুরে যায় এই ভেবে, ও এভাবে খেলে কি করে?’ মজার ব্যাপার হল এমন মন্তব্য যিনি করেছেন সেই অঁরি নিজেই কিন্তু ২০০৩ ও ২০০৪ সালে ফিফার বিবেচনায় দ্বিতীয় বর্ষসেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন।
কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের এই তরুণ আজ এ পর্যায়ে পৌঁছবেন, কে ভেবেছিল? বরং মেসি এমন এক রোগে আক্রান্ত ছিলেন যে কারণে তাঁর উচ্চতা বাড়ছিল না।
সেসময় আর্জেন্টিনার স্থানীয় এক যুব কাবে মেসির খেলা দেখে বার্সেলোনা তাঁকে পরিবারসহ স্পেনে নিয়ে যায়। তখন মেসির বয়স মাত্র ১৩। কাবের খরচে চিকিৎসা চলে তাঁর। মেসির পেছনে অনেক অর্থ খরচ করে বার্সেলোনা। তবে এখন বোঝা যাচ্ছে ভবিষ্যৎ তারকা চিনতে ভুল করেনি বিশ্বখ্যাত ওই কাবটি।
২০০৪-০৫ সেশনে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে স্প্যানিশ লিগে খেলা শুরু করেন মেসি এবং সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম গোল করেন।
সেই থেকে ফুটবল জগতে মেসির ইতিহাস শুরু এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যান মেসি। গতবছর ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় হওয়ার আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তিনি দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন। অনেকে আবার মেসিকে ম্যারাডোনার সমতুল্য খেলোয়াড়ও মনে করেন। কেউ কেউ তাঁকে ম্যারাডোনার চেয়েও ভাল মনে করেন।
এবারের বিশ্বকাপে এই দুজনই আছেন। একজন কোচ, আর একজন খেলোয়াড়। তাইতো আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এবার তৃতীয়বারের মত বিশ্বজয়ের নেশায় বুদ হয়েছেন।
এর পর আরেক নক্ষত্রের কথা না বললেই নয়, সে হচ্ছে ফার্নান্দো তরেস। বর্তমান বিশ্বের যে কয়জন স্ট্রাইকারকে এ মুহুর্তে বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয় স্পেনের ফার্নান্দো তরেস তার মধ্যে অন্যতম।
যদিও বিশ্বকাপ শুরুর আগেই হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে তার বিশ্বকাপে অংশ গ্রহণ নিয়েই অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। অবশেষে ইনজুরি থেকে ফিরে আসেন তরেস কিন্তু ফেরাতে পারেননি নিজের ফর্ম।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ফুটবলে হাতে খড়ি ফার্নান্দো তরেসের। সেসময়ই তিনি স্থানীয় বাচ্চাদের একটি দলে যোগ দেন। ফুটবলার হওয়ার পেছনে বাবা-মার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি বলেন তরেস।
বেশ ছোট থেকেই ইনডোর ফুটবল খেলতে শুর করেন তরেস। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বের এই নামকরা স্ট্রাইকার শুরুতে গোলরক্ষক হিসেবে ফুটবল খেলা শুরু করেন।
স্থানীয় কাব এথলেটিকো মাদ্রিদের জুনিয়র দলে নাম লেখিয়ে ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু। এরপর ২০০১ সালে একই কাবে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে নাম লেখান তরেস। শুরুতেই দুর্দান্ত পারফরমেন্সের কারনে সকলের নজর কাড়েন তিনি।
তাই মাত্র ১৯ বছর বয়সেই দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়ে যান এ কৃতি ফুটবলার।
দীর্ঘ ১২ বছরে এ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে লিগে ১৭৪টি ম্যাচে ৭৫টি গোল করেছেন তরেস। অবশেষে ২০০৭ সালে ইংলিশ কাব লিভারপুলে ডাক পড়ে তাঁর। নিজের দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান ২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। আর প্রথম মৌসুমেই ২৯ গোল করে বুঝিয়ে দেন তার আসল মূল্য কত!।
চলতি মৌসুমেও ২২ ম্যাচে ১৮ গোল করেছেন অল রেড’দের হয়ে।
২০০৩ সালে পর্তুগালের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় তরেসের। এরপর মাত্র ২৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬০টি ম্যাচে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার রেকর্ড করে বসেন তিনি। তবে কাবের মত বিশ্ব ফুটবলে কিন্তু এত সহজে গোল পাননি তরেস। আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হওয়ার দীর্ঘ ছয় মাস পর ২০০৪ সালে ইতালির বিপক্ষে প্রথম গোল পান তিনি।
আন্তর্জাতিক ম্যাচে এখন পর্যন্ত ৭১ ম্যাচে ২৩ গোল করেছেন তরেস যা তাঁর কাব ক্যারিয়ারের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোলটি বোধহয় দুই বছর আগে ইউরো কাপের ফাইনালে। কারণ তাঁর করা জয়সূচক গোলেই জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। আর দীর্ঘ চার দশকে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা লাভ করে তারা। গত বিশ্বকাপে স্পেন বাদ পড়ার আগ পর্যন্ত তরেসের পা থেকে আসে তিনটি গোল।
তবুও এবার বাফানার দেশে জ্বলে উঠতে পারছেন না প্রতাপশালি এ ষ্ট্রাইকার।
এবং এবার আসি ফুটবল বিশ্বের আধুনিক বিস্ময় ক্রিষ্টিয়ানো রোনাল্ডো সমাচারে। আধুনিক সময়ের আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের সামনে আদর্শ পর্তুগাল অধিনায়ক ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। তার ভক্তের সংখ্যাও উল্লেখ করার মত। গত বছরের ফিফা বর্ষসেরা এ খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করছে পর্তুগালের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন।
ক্রীড়া বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে চমক লাগানো গতি, সুঠাম শারীরিক বল এবং দুই পা’য়ের বিস্ময়কর কৌশলগত নৈপুণ্য যেন ২৫ বছর বয়সী এ তারকাকে উদ্দীপনার ঝলকে পরিণত করেছে। এ রোনালদোর নৈপূন্যেই এবার বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়াকে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত করে পর্তুগাল।
রোনালদোর একেকটা শটের গতি যেন প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার আঘাত। তাঁর এতোসব গুণাবলীর পেছনে দক্ষতা এবং কঠোর অনুশীলন রয়েছে। অনেকে আরেকটু এগিয়ে বলতে চান, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাথলেট এখন রোনাল্ডো।
এমনকি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে রোনাল্ডোর কীর্তিগাথা। তিনি বলেন-‘এই ছেলের প্রশংসা ছাড়া তার সম্পর্কে আর কিছুই বলার নেই আমার। খুব সহজেই তাকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় বলা যায়’। ফার্গুসন আরো বলেন-‘গোল পোস্ট লক্ষ্য করে তার আক্রমণ, গোলের প্রচেষ্টা, পেনাল্টি বক্সে তার দ্রুত বিচরণ সবকিছুই অত্যন্ত বিস্ময়কর’।
নিজের সম্পর্কে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলেন-‘আমি একা খেলি না এবং আমি কোন অলৌকিক কিছু করে দেখাতে পারবো না’।
তিনি আরো বলেন-‘আগামী ম্যাচে জয় পেতে হলে আমাদের সামগ্রিকভাবেই আরো ভালো করতে হবে’। তবুও যে যাই বলুক পর্তুগাল বাসীর স্বপ্ন পূরনে আরো দুরন্ত দুর্বার গতিতে ছুটবেন এ তারকা এটাই কামনা করছেন রোনালদো ভক্তরা।
এবার বলি দ্য এলিফেন্টদের তারকা দিদিয়ের দ্রগবার কথা। আইভরিকোষ্টের সব স্বপ্ন ও আশা ছিল তাকে ঘিরেই। বিশ্বকাপের পূর্বেই প্রস্তুতি ম্যাচে হাতের কনুইয়ে আঘাত পেয়ে চুপসে যায় এ তারকা ফুটবলার।
পরে ইনজুরির ভয়াল থাবা থেকে ফিরে আসলেও বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে ঠিকমত জ্বলে উঠতে পারেনি এ তারকা। তাইতো ডুবে গেছে আইভরিকোষ্টের স্বপ্ন তরী।
পঞ্চপান্ডবের শেষ পান্ডব হলো বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালির ক্যাপ্টেন ফ্যাবিও ক্যানাভারো। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েও প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিয়েছে ইতালি। আর এখানে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আজ্জুরিদের তারকা ফ্যাবিও ক্যানাভারোর।
বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞে এবার অনেকটা নিস্প্রভ ছিলেন ক্যানাভারো। ইতালি বাসীর স্বপ্ন আর আকাঙ্খার জলাঞ্জলিতে কতটা ভুসিকা রেখেছেন এ তারকা তা আজ্জুরিরাই ভাল বলতে পারবেন।
তবে বিশ্ব চ্যাস্পিয়ন হয়েও প্রথম রাউন্ডেই বিদায় কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেনা ইতালি ভক্তরা। আর ইতালির দেখানো পথেই হেটেছে থিয়েরি অঁরির ফ্রান্স; ওয়েইন রুনির ইংল্যানাডও। বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বে রুনি ও অরিকে নিয়েও অনেক আশা করেছিল শৈল্পিক ফুটবল ভক্তরা।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! শেষে একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হল; বড় আসর বড় তারকা, বড় বড় দুঃথ ব্যাথা! নিতান্তই খেলার মাঠে, তবুও মনে হয় প্রিয় তারকা আরেকটু ভাল খেললেও পারতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।