যে কোন লড়াই শেষ পর্যন্ত লড়তে পছন্দ করি।
মুক্তিযুদ্ধে আমার এলাকায় পিকিংপন্থী বামদের ভূমিকা
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার সেনা বাহিনী যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বর্বর হামলা চালালো; হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হ’ল; পুরো জাতি তখন শুরুতে ধাক্কা খেয়ে কিংকর্তব্যমবমূঢ় হলেও পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললো।
দলমত নির্বিশেষে, সমস্ত বিভেদ ভুলে, আবাল বৃদ্ধ বনিতা, প্রতিরোধ গড়ে তুললো। যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাহারা দিতে শুরু করলো, অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করলো, যাদের কাছে অস্ত্র ছিল তাদের সাথে গিয়ে যুক্ত হতে লাগলো। আর পাকিস্তানী হানাদার সেনাদের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছোট ছোট ব্রিজ কালভার্ট ভেঙ্গে দিতে লাগলো।
আমাদের এলাকার পিকিং ও মস্কোপন্থী উভয় গ্রুপের বামপন্থী কমিউনিষ্ট নেতারা এসব কাজে উৎসাহ দিতে লাগলেন এবং তারা অনেকে তাদের দলীয় কর্মীদের নিয়ে সংগঠকের ভূমিকায় কাজে লেগে গেলেন। একদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করা, অপরদিকে চুরি, ডাকাতি, লুঠ-পাঠ ঠেকানো। তাছাড়া শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকজনকে আশ্রয় দেয়া, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা----সে এক কঠিন সময়।
কিছুদিনের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার একটি প্রবণতা দেখা দেয়াতে আর এক ধরণের সমস্যা দেখা দিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তান(?) ছেড়ে ভারতে চলে গেলে তাদের জায়গা, জমি, ঘর-বাড়ী, কি হবে---এসব নিয়ে নানা জনের নানা দৃষ্টিভঙ্গী, নানা মনোভাবের ফলে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্যে চিড় ধরতে শুরু করলো।
এই ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার অভাব এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থ যখন স্থানীয় সর্বদলীয় ঐক্য প্রায় নড়বড়ে করে ফেলছে, ঠিক তখন পিকিংপন্থী বলে পরিচিত একটি কমিউনিষ্ট পার্টির উঁচু পর্যায়ের কিছু নেতা আমাদের অঞ্চলে এলেন এবং ঘোষণা করলেন, “এ যুদ্ধ (মুক্তি যুদ্ধ) হ'ল "দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি” এই যুদ্ধে আমাদের কোন ভুমিকা নাই"। এতে করে ফল যেটা হ’ল তা হ’ল, নড়বড়ে সর্বদলীয় স্থানীয় ঐক্য একেবারে এলোমেলো হয়ে গেল। শুরু হ’ল সংকীর্ণ দল ভিত্তিক কোন্দল, রেষারেষি, পারস্পারিক শত্রুতা, দু-একটি ক্ষেত্রে পারস্পারিক হত্যাকান্ড। যারা অতিমাত্রায় লোভী তারা পরে কেউ কেউ রাজাকার হয়েছিল।
এর আর একটি ফল হ’ল, বামপন্থী বা কুমউনিষ্টদের মধ্যে পিকিংপন্থী ঘরানার রাজনীতির সাথে যুক্ত যুবকদের ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র টেনিং নেয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
যারা সাহস করে ভারতে গেলেন তাদের অনেকে মহাবিপদে পড়লেন, দু-একজন মারাও পড়লেন, বেশ কয়েকজন নিখোঁজ হলেন, যাদের আজও কোন খবর পাওয়া যায়নি। কারণ ভারতের পশ্চিম বাংলায় তখন নক্সালপন্থী বামরা বেশ সক্রিয় এবং শক্তিশালী। নক্সালরা আবার পিকিং পন্থী হিসেবে পরিচিত। ফলে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কোন যুবককে নক্সাল বা নক্সালদের সমর্থক হিসেবে ভারতীয় পুলিশ, সিআরপিএফ বা যুব কংগ্রেস কর্মীদের কাছে রিপোর্ট করলে আর রক্ষা নাই। খুলনায় একজন সুপরিচিত এ্যাডভোকেট আছেন যিনি এই রকম অবস্থায় পড়ে চরম ভাবে নির্যাতিত হয়ে বহু কষ্টে নিজের পৈতৃক জীবনটি রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
তবে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পরও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশে ঢুকতে পারেন নি। তাকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে বসে থাকতে হয়েছিল। বিজয়ের পর তিনি দেশে এসেছিলেন।
আপরদিকে পিকিংপন্থী রাজনীতির সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের গাত্রদাহের কারন ছিল। চীনের সাথে চরম শত্রুতার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যে কোন পিকিংপন্থীকে চীনা চর হিসেবে বিবেচনা করতো।
সহজে অনুমেয় যে, ভারতে তখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পিকিংপন্থী রাজনৈতিক কর্মীর জন্য কি ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে।
আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষের দিকে এসে কয়েকটি পিকিংপন্থী বামপন্থী দল ভেঙ্গে একটি দল বা গ্রুপ গঠন করে তাদের নেতারা ঘোষণা করলেন যে, "এটা (মুক্তিযুদ্ধ) পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্ববৌমত্বের উপর ভারতীয় আধিপত্যবাদের নগ্ন আগ্রাসন। স্বাধীন (পাকিস্তানী) জাতি হিসেবে এই আগ্রাসন আমাদের রুখতে হবে। "
যে কথা সেই কাজ। পাকিস্তানীদের সাথে হাত মিলিয়ে লেগে গেলেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এক যুদ্ধে।
সব নেতাদেরই কিছু অনুসারী থাকে। তাদেরও ছিল। যারা ১৯৭২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পাবনার প্রান্তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার পর পরাভুত হয়েছিল। নেতাদের দু-একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন। (তবে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তাদের দলের নাম ছিল “পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম. এল.)”।
দেশ স্বাধীনের পর এই দলে যোগ দিয়ে দেশের কিছু কিছু এলাকায় রাজাকার বাহিনী হয়ে গেল "লাল বাহিনী"। যুদ্ধাবস্থা না থাকায় তারা লেগে গেল জাতীয় বেঈমান খতমের কাজে। জাতীয় বেঈমান বলতে তাদের ভাষায় “যারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের সহযোগী বা দালাল”।
ভুল পথে চললে জনসমর্থন থাকে না। এখানেও তাই হ'ল।
জনসমর্থন হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে তারা মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত হলেন। বহু নেতাকমী ভুল নীতি-কৌশলের বলি হয়ে প্রাণ হারালেন। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দলে যোগ দিলেন। অনেকে বিএনপি, জাতীয় পার্টিতেও যোগ দিলেন। ছোট্ট ছোট্ট গ্রুপে যুক্ত বা দলছুট অবস্থায় তাদের অনেকে এখনও নির্মম ক্রস ফায়ারের শিকার হচ্ছেন।
আবার যাদের সামর্থ্য ছিল তারা অনেকে রাজনৈতিক ভাবে নিঃশ্ব হয়ে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নতুন জীবনের সন্ধানে বিদেশ গিয়ে প্রবাসী হলেন। হলেন বিদেশী নাগরিক।
(যারা বৃটেন গেলেন তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ হলেন বৃটিশ কমিউনিষ্ট। বৃটিশ নাগরিক ও বৃটিশ কমিউনিষ্ট হয়ে তারা বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদী শোষন-লুন্ঠনের ভাগীদার হলেন, সাম্রাজ্যবাদী সমাজের সৃযোগ-সবিধা ভোগও করলেন। এখন তারা বিপ্লব বা শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য কঠোর কোন আন্দোলনে জড়ান না।
সব সময় অন্যদের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করে মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঢুকিয়ে দেন। ব্যাক্তি বা ব্যাক্তির মতের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভক্তি তাদের আচরণে খুব কমই প্রকাশ পায়। কমিউনিষ্ট হওয়া সত্বেও বৃটিশ পুলিশ কখনও তাদের গ্রেপ্তার করে না। তারা দেশে আসলে এদেশের পুলিশও তাদের গ্রেপ্তার করে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন কমিউনিষ্ট পার্টির ও গ্রুপের কিছু নেতার সাথে তাদের খুব বন্ধুত্ব এবং এই সব পার্টি ও গ্রুপের উপর তাদের অনকে প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
যে কোন কারণে হোক এইসব পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্য়কর ভাবে বিকশিত হতে পারছে না।
বাংলাদেশের অনেক এলাকাতে মুক্তিযুদ্ধে পিকিংপন্থী বামরা শুধু অংশগ্রহণ করেন নি, বরং মূল সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতায় তারা যথাযথ স্বীকৃতি ও সম্মান পান নি। ইদানিং কেউ কেউ পাচ্ছেন। (বুঝতে হবে, আজকের যে মহাজোট হয়েছে, এটা তখন গঠন করা তো দুরের কথা, চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।