কবিতার প্রথম লাইনটি আসে স্বর্গ থেকে; বাকিটা তুমি গড়ে তোল।
আমাদের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির যারা নেতাÑ সমাজে তাদের একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। সেটা যতটা না ইতিবাচক তার চেয়ে অনেক বেশি নেতিবাচক। বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক চলতে পারে। তবে বাস্তবতা এটাই।
বাংলাদেশে কোনো দল দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসে না, আসে ক্ষমতায়। ক্ষমতায় এসেই তারা অসততার চক্রে জড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামী নিজেদের সব সময়ই প্রচলিত এই রাজনৈতিক ধারার বাইরে বলে দাবি করে। যদিও অসততা কত প্রকার ও কী কী সেই প্রমাণ তারা একাত্তরে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতার বাইরে থেকে আস্তে আস্তে নানা কৌশল-অপকৌশলে জামায়াত সংগঠিত হয়েছে।
দেশের মানুষের মাঝে এই ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, জামায়াতের নেতারা সৎ, যোগ্য...। তারা কোনো অসততা বা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। দেশের মানুষের একটি অংশ তাদের ছড়িয়ে দেয়া ধারণায় বিভ্রান্তও হয়েছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে জামায়াত ব্যবহার করেছে পবিত্র ধর্ম ইসলামকে। তারা আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে।
তারা বলে সৎলোকের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা।
বিএনপির কাঁধে ভর করে চারদলীয় জোটের অংশ হিসেবে তারা ক্ষমতায়ও আসে। জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীকে প্রথমে দেয়া হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে দেয়া হয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। পরবর্তীতে দলীয়করণের অভিযোগে নিজামীকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়।
একাত্তরে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিজামী, মুজাহিদ গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর সুযোগ পায়।
বিএনপি সেই সুযোগ করে দেয় এবং তখন থেকেই জামায়াতের ‘রূপ’, জামায়াত নেতাদের ‘প্রকৃত স্বরূপ’ প্রকাশ হতে থাকে।
জামায়াত যে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে নয়, সেটা প্রমাণ হতে থাকে। রাষ্ট্র ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিজেরা সুবিধা নিতে থাকে। দলীয় নেতাকর্মীদেরও সুবিধা দিতে থাকে। তবে এই রিপোর্টের বিস্তৃতি এত ব্যাপক নয়।
মূলত নিজামী এবং মুজাহিদের ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকব এবং নিজেদের সুবিধা নেয়ার জন্য তারা কী করে, মুখে যা বলে তার সঙ্গে কাজের সাদৃশ্য থাকে কিনা, ইসলামের সঙ্গেই বা এসব কাজের সম্পর্ক কী? ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সাধারণ জনমানুষ একটা পরিষ্কার ধারণা পাবেন।
২.
মতিউর রহমান নিজামী তখন শিল্পমন্ত্রী। ২০০৬ সালের ২১ মে নিজামী একটি প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন। রাজউকের নিয়মানুযায়ী প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন তখনই করা যায়, যখন রাজউক প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেই বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরে নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে হয়।
নিয়ম এটাই। কিন্তু নিজামী রাজউকের জারি করা কোনো বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরে আবেদন করেননি।
নিজামীর আবেদনপত্রের ওপর সেই সময়ের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস চেয়ারম্যান, রাজউককে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন’ লিখে আবেদনপত্রটি সরাসরি রাজউকে পাঠিয়ে দেন। সরকারি নিয়মানুযায়ী তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যে সুপারিশ করেছিলেন, সেটিও নিয়মসিদ্ধ ছিল না। রাজউকের প্লট বিধি ১৯৬৯-এর অধিকতর সংশোধনীর ধারা অনুযায়ী সুপারিশ করা হয়নি।
এই ধারায় না পড়ায় মন্ত্রীর সুপারিশ সরকারি সুপারিশ হিসেবে গণ্য হয়নি। কারণ রাজউকের বিজ্ঞপ্তির বাইরে যে কেউ আবেদন করলে রাজউক তা বিবেচনা করতে পারে না। কেবল সরকার নির্দেশ বা সুপারিশ করলে রাজউক সেটা করতে পারে। মতিউর রহমান নিজামীর আবেদনের প্রাথমিক পর্যায়েই অনিয়মের সূচনা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তির বাইরে নিজামী নিজেই খুঁজে বের করেন বনানীর আকর্ষণীয় একটি প্লট।
বনানী ১৮ নং রোডের ৬০ নম্বর প্লটটির অবস্থান লেকের পাড়ে। আয়তন ৫ কাঠা ১৫ ছটাক ১৩ বর্গফুট। এই প্লটটি খালি আছে এটা তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন।
অনিয়মের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া নিজামীর ফাইল সচল থাকে। কাজ আগাতে থাকে।
বলা হয় একটি অনিয়মকে আড়াল করতে আরো দশটি অনিয়ম করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত পার পাওয়া যায় না। প্রমাণ কোনো না কোনোভাবে, কিছু না কিছু থেকেই যায়। নিজামীর ফাইলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রাথমিক আবেদনের প্রেক্ষিতে রাজউক মতিউর রহমান নিজামীকে বনানী বা উত্তরায় ৫ কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই সিদ্ধান্তের পর নিজামী বনানীর ১৮ নং রাস্তার ৬০ নম্বর প্লটটি তাকে বরাদ্দ দেয়ার জন্য আবেদন করেন।
কাজ চলতে থাকে। এর এক পর্যায়ে হঠাৎ করে জানা যায়, মতিউর রহমান নিজামীর ফাইলটি হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাওয়াটা খুবই রহস্যজনক। এর মধ্যে নিজামীর প্লটের দখলপত্র প্রদান করে রাজউক। দখলপত্রসহ পুরো ফাইলটি হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, ‘জনাব মতিউর রহমান নিজামীর প্লটের দখলপত্র প্রদানের পর তার প্রতিনিধি নথিটি রেখে নামাজে চলে যান।
এরপর নথিটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ’
রহস্যজনকভাবে ফাইলটি হারিয়ে যাওয়ার পর আবার ছায়ানথি খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেই সময়ের একজন রাজউকের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ফাইল হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে শুধু দুঃখজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর জন্য কোনো তদন্ত কমিটি করা হয়নি। কোনো উচ্চবাচ্যও করা হয়নি।
আমরা তদন্ত কমিটি করতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে মতিউর রহমান নিজামীর লোকজন রাজউকে আসে। যারা হৈ চৈ করছেন তাদের কারো চাকরি থাকবে না বলে হুমকি দেন। মন্ত্রণালয়ের চাপে সেই সময়ের রাজউক চেয়ারম্যানও আমাদের চুপ থাকতে বলেন। নিজামী, জামায়াতের তখন কী দাপট ছিল সেটা তো সবাই জানেন। ’
সেই সময়ের এই দাপুটে মন্ত্রীর ফাইল হারিয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী তৎপরতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
ক. ফাইলটি কি সত্যিই হারিয়ে যায় না ইচ্ছা করে হারানো হয়?
খ. একজন মন্ত্রীর ফাইল কয়েক মিনিটের মধ্যে হারিয়ে গেল অথচ কোনো তদন্ত করা হলো না। কীভাবে হারাল, হারানোর জন্য কে দায়ী কিছুই চিহ্নিত করা হলো না কেন?
গ. সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন সরকারি ফাইল কেন মতিউর রহমান নিজামীর প্রতিনিধির হাতে ছিল? নিয়মানুযায়ী রাজউকের ফাইল রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো প্রতিনিধির হাতে বা টেবিলে থাকবে। আইন অনুযায়ী মতিউর রহমান নিজামীর প্রতিনিধির হাতে রাজউকের ফাইল কোনোভাবেই থাকতে পারে না। তাহলে বেআইনিভাবে নিজামীর প্রতিনিধির হাতে ফাইল কে দিল?
ঘ. নিজামীর প্রতিনিধি, যার হাতে বেআইনিভাবে ফাইল ছিল, তিনি নামাজে যাওয়ার সময় ফাইলটি কার কাছে রেখে গিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই ব্যক্তির কাছে, চেয়ার-টেবিলের কাছে নয়। যার কাছে রেখে গিয়েছিলেন তাকে তিনি নিশ্চয়ই চিনতেন।
কিন্তু ফাইল হারিয়ে যাওয়ার পর কার কাছে ফাইল রেখে গিয়েছিলেন সেটা উল্লেখ না করার কারণ কী?
ঙ. মতিউর রহমান নিজামীর মতো একজন মন্ত্রীর ফাইল গায়েব করার সাহস কী তখন রাজউকের কোনো কর্মকর্তার থাকার কথা? তাও আবার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে?
প্রশ্নবিদ্ধভাবে হারিয়ে যাওয়া ফাইলের রহস্য অনুসন্ধানের কোনো চেষ্টা না করে ‘ছায়ানথি’ বা ফাইল খোলা হয়। নতুন ছায়া ফাইল খোলার জন্য মতিউর রহমান নিজামীর পূর্বে দাখিল করা কাগজপত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করা হয়। এই কাগজপত্র দেখতে গিয়েই ফাইল হারানোর রহস্য কিছুটা বোঝা যায়। রাজউকের প্লট পাবার যোগ্যতা কারো আছে কি না, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হচ্ছে ‘হলফনামা’। যিনি আবেদন করেন এই ‘হলফনামা’য় তিনি পরিষ্কার করে বলেন, তার নিজের, স্ত্রী, সন্তান, পোষ্য কারো ঢাকায় কোনো জমি, প্লট, বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই।
এ রকম একটি ‘হলফনামা’ নিজামীও দিয়েছেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ‘হলফনামা’য় মতিউর রহমান নিজামীর স্বাক্ষর নেই! ‘ছায়া ফাইল’ খোলার কাগজপত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। হলফনামার মূল কপিতে যদি স্বাক্ষর থাকত, তবে ফটোকপিতে তা অবশ্যই থাকত। তাছাড়া এটা খুব স্বাভাবিক বিষয় যে স্বাক্ষর ছাড়া কাগজ কেউ ফটোকপি করে সংগ্রহ করেন না। আর এটা ছিল রাজউকে দাখিল করা মূল কাগজের ফটোকপি।
যা স্বাক্ষরবিহীন হতে পারে না।
নিজামীর ফাইল হারানোর প্রধান কারণ এই স্বাক্ষরবিহীন হলফনামা। কারণ স্বাক্ষরবিহীন হলফনামার ওপর ভিত্তি করে রাজউকের কর্মকর্তারা ফাইল উপস্থাপন করেছেন। হয় তারা চাপে পড়ে এমন কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন অথবা নিজামী বা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে কাজটি করেছেন। স্বাক্ষরবিহীন হলফনামার ভিত্তিতে তারা নিজামীকে লিজ দলিল সম্পাদন করে দিতে সহায়তা করে অন্যায় করেছেন।
তাই হয়ত বাঁচার জন্য রাজউকের কর্মকর্তারা ফাইলটি গায়েব করে দিয়েছেন। ফাইল গায়েব করার এই কাজটি মতিউর রহমান নিজামী প্রতিনিধি পাঠিয়ে, রাজউকের কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়েই করেছেন। এবং সবই করেছেন স্বাক্ষরবিহীন হলফনামার অনিয়ম থেকে বাঁচার জন্য।
অনিয়ম এবং অনৈতিকতার প্রমাণ থাকলেও নিজামী ঠিকই বনানীতে প্লট পেয়েছেন। সেখানে ছয় তলা বিল্ডিংও করেছেন।
৩.
বিল্ডিং তৈরি করা নিয়েও আশ্রয় নেয়া হয়েছে অনিয়ম, অনৈতিকতার। পুরো প্রক্রিয়াটিতে অস্বাভাবিক রকমের তাড়াহুড়ো করা হয়েছে।
২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর নিজামী লিজ দলিল সম্পাদন করেছেন। একই তারিখে মিশন ডেভেলপার লিমিটেডকে প্লটটিতে বিল্ডিং নির্মাণ ও যাবতীয় কাজ সম্পাদনের জন্য আমমোক্তার নিয়োগ করেছেন। অর্থাৎ যে তারিখে (২২.১০.২০০৬) নিজামী নিজে লিজ দলিল সম্পাদন করে নিয়েছেন, একই তারিখে (২২.১০.২০০৬) অন্য একটি দলিল সম্পাদন করে আমমোক্তার নিয়োগ করেছেন।
দু’টি কাজ একই তারিখে দ্রুততার সঙ্গে হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
নিজামী ও মিশন ডেভেলপারের সঙ্গে সম্পাদিত আমমোক্তার নামার দলিলে দেখা যায়, ওই দলিলের ‘নম্বর ও তারিখ’ উল্লেখ করা হয়নি। ‘নম্বর ও তারিখের’ স্থান দু’টি খালি রয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এতই তাড়াহুড়া করা হয়েছে যে, স্থান দু’টি পূরণ করা হয়নি। তাড়াহুড়া করার থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে,
ক. নিজামী প্লটটি পেয়েছিলেন অনিয়মের মাধ্যমে।
খ. প্লটটি দ্রুত হস্তান্তর করে নিজের দুর্বলতা বা অনিয়ম আড়াল করার কৌশল নিয়েছেন।
রাজউক থেকে নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রেও হয়েছে অনিয়ম। মিশন ডেভেলপারকে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে নিজামী আমমোক্তারনামা দিয়েছেন। তাই নিয়মানুযায়ী ওই প্লটে বিল্ডিং নির্মাণের নকশা মিশন ডেভেলপার কোম্পানির নামে হবে। অথচ ২০০৭ সালের ২ জানুয়ারি প্লটের নকশা অনুমোদন করে নেয়া হয় মতিউর রহমান নিজামীর নামে।
আইন অনুযায়ী যেটা করা যায় না। নিজামীর নামে নকশা অনুমোদন করা যেত যদি পূর্বে মিশন ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে করা আমমোক্তারনামা দলিল বাতিল করা হতো। কিন্তু এই দলিল বাতিল না করেই নিজামী তার নিজের নামে নকশা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। যা অনৈতিক, অনিয়ম এবং বেআইনি। কাজটি নিজামী করেছেন।
৪.
এই সময় রাজউকের বিষয় শাখা একটি রিপোর্ট দেয় বাস্তব অবস্থা জানিয়ে। রিপোর্টে দেখা যায়, প্লটটিতে বিল্ডিংয়ের ছয় তলার ছাদ পর্যন্ত নির্মিত হয়ে গেছে। বিল্ডিংয়ের সামনে মিশন ডেভেলপারের সাইনবোর্ড লাগানো আছে। এর থেকে বোঝা যায় মিশন ডেভেলপার এই বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ করছে। কিন্তু মিশন ডেভেলপারকে দেয়া আমমোক্তারনামা রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত নয়।
তাই মিশন ডেভেলপারের বিল্ডিং তৈরির কাজ রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী অবৈধ। মিশন ডেভেলপারের এই কাজটি বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় যে, মিশন ডেভেলপার নয়, নিজামী নিজেই বিল্ডিং তৈরি করছেন, ছাদ পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছেন এবং নকশাও তার নামেই পাস হয়েছে। কিন্তু এটা ধরে নিলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কারণ মিশন ডেভেলপারের সঙ্গে করা আমমোক্তারনামা বাতিল না করে তিনি নিজে বিল্ডিং তৈরির কাজ করতে পারেন না।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটা করার সুযোগ নেই।
বিল্ডিং তৈরির কাজ মিশন ডেভেলপার করলেও সেটা বেআইনি। নিজামী নিজে করলেও বেআইনি। অর্থাৎ ৬ তলার ছাদ পর্যন্ত তৈরির কাজ পুরোপুরি বেআইনিভাবে করা হয়েছিল।
মতিউর রহমান নিজামীর বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লটটি পূর্বে আজিজুর রহিম নামক একজনের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু মতিউর রহমান নিজামীর নামে যখন এই প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছিল তখন পূর্বে বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি গোপন রাখা হয়।
আজিজুর রহিম জামানতের টাকা ছাড়া আর কোনো অর্থ পরিশোধ করেননি। অর্থ পরিশোধের সময়ও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তার প্লট বরাদ্দ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাতিল করা হয়নি। তারপর নিজামীকে বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া চলাকালীন আজিজুর রহিম আবার প্লটের টাকা পরিশোধের আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করেন।
কিন্তু নিজামীর প্লট বরাদ্দের ফাইলে এই বিষয়গুলোর কোনো উল্লেখ ছিল না। সত্য গোপন করে কাজ করা হয়েছে।
নিজামীর ফাইল গায়েব হবার ক্ষেত্রে এই সত্য গোপন করাটাও একটা কারণ বলে মনে করা হয়। যেহেতু এই প্লটের খোঁজ নিজামী নিজে সংগ্রহ করে আবেদন করেছেন, সেহেতু এই একই প্লটটি পূর্ব বরাদ্দের বিষয়টিও তার জানা থাকার কথা। কিন্তু তিনি আবেদনে সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
নিজামী এবং রাজউকের কর্মকর্তারা উভয়েই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন, গোপন করেছেন।
৫.
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতিবিদদের অবস্থা কী ছিল সেটা সবাই জানি। এতটা ভয়াবহ অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের কখনো পড়তে হয়নি। যখন সারাদেশের রাজনীতিবিদদের চলছে ধরপাকড়। তখন মতিউর রহমান নিজামী সরকারি প্লটে বিল্ডিং তুলছেন।
পুরো কাজটি হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। তার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নীরব থেকেছে। বোঝা যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিস্ময়কর রকমের সমর্থন ছিল জামায়াতের প্রতি। লোক দেখানো গ্রেফতার করা হয়েছিল সত্য, কিন্তু তাতে জামায়াতের লাভই হয়েছিল।
বর্তমান সরকারের সময়ে অতীত সরকারের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা, আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।
কিন্তু জামায়াতের দুর্নীতি বিষয়ে এই সরকারও এখন পর্যন্ত চুপচাপ। জামায়াতও বড়াই করে বলছে তারা কখনো কোনো দুর্নীতি করেনি।
কিন্তু নিজামীর প্লট নেয়ার বিষয়টি কী প্রমাণ করে যে, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি? আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতিবিদদের গাড়ি-বাড়ি-অর্থের লোভ আছে সবাই জানি। তাদের অনেকেই অন্যায় অনিয়ম করেন, সেটাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তাদের থেকে জামায়াত বা মতিউর রহমান নিজামী কী আলাদা? তারাও তো একই রকম প্রক্রিয়ায় প্লট নিয়েছেন।
বাড়ি-গাড়ির লোভ দেখা যায় তাদেরও আছে। অন্যায়-অনিয়ম করে হলেও তারা প্লট নিয়েছেন। আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে নিজের নামে প্লট নিচ্ছেন। তাও আবার কত রকমের কৌশল করে! ইসলাম বা আল্লাহ্র আইনের কোথায় এমন অনৈতিক কাজ করার অধিকার দেয়া হয়েছে?
সাবেক জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও উত্তরায় একটি প্লট নিয়েছেন। উত্তরার ১১ নং সেক্টরের ৫নং প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন মুজাহিদ।
তিনিও একই প্রক্রিয়ায় রাজউকের বিজ্ঞপ্তির বাইরে আবেদন করেছেন। বিল্ডিং তৈরি করিয়েছেন মিশন ডেভেলপারকে দিয়ে। নিজামী মুজাহিদের প্লট পাওয়া এবং বাড়ির কাজ প্রায় একইভাবে হয়েছে। মুজাহিদ ৬ তলা বিল্ডিংয়ের তিনটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন। রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে এক একটি ফ্ল্যাটের মূল্য দেখিয়েছেন ১৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা! এই মূল্য দেখানো হয়েছে ২০০৭ সালে।
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো ঐ সময় এ রকম একটি ফ্ল্যাটের দাম ছিল ৬০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকা।
রেজিস্ট্রেশন করার সময় দাম কম দেখানো হয় রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোর জন্য। এই কাজটি অনেকেই করেন। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়াও থাকে একটি উদ্দেশ্য।
সবাই করেন তাই মুজাহিদও করেছেন!
আল্লাহ্র আইন, ইসলামে কী এমনটা করার সুযোগ আছে?
৬.
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা যোগাযোগ করেছিলাম মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে।
তার পিএসের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি জানান, নিজামী লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে বলেছেন। লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। পিএস প্রশ্ন প্রাপ্তি স্বীকার করেন এবং জানান যে মতিউর রহমান নিজামীকে প্রশ্নের বিষয় জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর দেননি মতিউর রহমান নিজামী।
উল্লেখ্য, নিজামী নিজে সাধারণত মুঠোফোন ধরেন না, তার পিএস ধরেন।
তারপর ফোন করা হয় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।
হ্যালো আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বলছেন?
জি, বলছি
আমি সাপ্তাহিক থেকে বলছি।
জি, বলেন।
রাজউক থেকে আপনি যে প্লট পেয়েছেন, সেটা নিয়ে আমাদের কয়েকটি প্রশ্ন আছে।
আপনার...
আমি মুজাহিদ সাহেবের পিএস বলছি... সরি, উনি ব্যস্ত আছেন...।
উল্লেখ্য, মুঠোফোন সাধারণত মুজাহিদ নিজেই ধরেন।
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তারপর অনেকবার ফোন করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
রাজউকের চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল হুদা অনেক কথা বলেন।
ঢাকা শহরের পাঁচ হাজার অবৈধ বিল্ডিং পারলে কথা দিয়েই ভেঙে ফেলতে চান। কিন্তু জামায়াত নেতাদের অনিয়ম নিয়ে তিনিও নিশ্চুপ। তিনি লিখিত প্রশ্নের জবাব দিতেও অনাগ্রহ দেখিয়েছেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী সাপ্তাহিককে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি এখনো অত ভালোভাবে জানি না। তবে ১১ মে’র মিটিংয়ে বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করব এবং আমাদের পক্ষ থেকে যা করার আমরা করব।
’
বর্তমান সরকার যখন প্লট বরাদ্দ দেয় তখনো দেখা গেছে অনেক রাজনীতিক, এমপি তথ্য গোপন করে প্লট নিয়েছেন। তাদের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান বলেছেন, কেউ তথ্য গোপন করে থাকলে বরাদ্দ বাতিল করা হবে।
বাতিল করা হবে কিনা আমরা জানি না। তবে মুখে অন্তত বলেছেন। কিন্তু নিজামী-মুজাহিদের বিষয়ে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মুখেও কিছু বলতে চাইছেন না।
মন্ত্রণালয়ে, এপিএসের মাধ্যমে অনেকবার চেষ্টা করেও প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
একটি সূত্রে জানা যায়, এই ঘটনাটি নিয়ে কথা বললে, তদন্ত করলে আরো অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। তার মধ্যে ক্ষমতাসীন, বিরোধী অনেকেরই নাম থাকবে। তাই কেউ এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায় না।
সবাই কথা দিয়ে, বক্তৃতায় দুর্নীতি দমন করতে চায়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নয়।
৭.
যে কোনো অন্যায়-অনিয়মের অভিযোগ উঠলে প্রথম কাজ সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য তদন্ত। কাগজপত্র, বরাদ্দ প্রক্রিয়া প্রমাণ করছে মতিউর রহমান নিজামী প্লট বরাদ্দ নেয়ার ক্ষেত্রে অন্যায়-অনিয়ম-অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে মুজাহিদের প্লটের ক্ষেত্রেও।
নিজামী-মুজাহিদরা ইসলামের কথা বলে অনেক কাজই করেন।
যার সঙ্গে যদিও ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামকে তারা নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করেন। ফাইল গায়েব করার মতো চরম অন্যায় কাজেও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ‘নামাজ’ পড়াকে।
জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা প্লট নিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টি তদন্ত করে অনিয়ম পেয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এই সরকারের প্রথম দেড় বছরেও নিজামীরা নিরাপদেই রয়ে গেছে।
গোলাম মোর্তোজা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।