আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুষ্টিয়া আমার ভালবাসার শহর (১ম পর্ব)

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
কুষ্টিয়া আমার প্রানের শহর, ভালবাসার শহর। এখানে আমার শৈশবে কৈশরের অনেক মধুর সময় কেটেছে। আমার স্মৃতিতে কুষ্টিয়ার রুপ এতো সুন্দর, এতো মধুর যা আমি সযতনে বুকের ভিতরে লালন করে চলেছি। দাদাবাড়ি দেশের বাইরে হওয়ায় প্রতিবছর গরমের ছুটি আমরা নানাবাড়িতেই কাটাতাম। আহা! ছুটির অনেক আগে থেকেই চলতো আমাদের দু’ভাই-বোনের গোছগাছ, প্রস্ততি।

বড় মামার বিয়ের সময় দোতলা ষ্টিমারে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তাও সে ষ্টিমার নষ্ট হয়ে নদীর বুকে তিনদিন ভেসে ছিলো। সে কাহিনী অন্য সময় বলবো। আমরা সচারচর ঢাকা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যেতাম। প্রমত্ত পদ্মা পাড়ি দিয়ে আবার ট্রেনে চড়তাম।

তখনো কয়লার ইঞ্জিনে ট্রেন চলতো। জানালা দিয়ে মুখ বের না করলে আমার হতোনা। আব্বা সবসময় হুশিয়ার করতেন, চোখে কয়লার গুড়ো পড়বে। পড়তোনা যে তা নয়। কিন্তু সেসব কিছুই আমাকে জানালার সামনে বসা থেকে নিবৃত করতে পারতো না।

ট্রেনটা যখন গড়াই নদীর উপর হাডির্জ সেতুতে উঠতো তখন আমাদের খুশী দেখে কে! এই তো আর কিছুখন পরই আমরা পৌছে যাবো স্বপ্নের শহর কুষ্টিয়াতে। ট্রেনটা যত কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী হতো, আমাদের ভাইবোনের মাথাও ততটাই বের হতে চাইতো। আম্মার চিমটি, বা আব্বার রক্তচক্ষুকে তখন আর ভয় পেতাম না। কারন এতো মানুষের ভিড়ে তো আর মারতে পারবেন না। আর নানাবাড়ী গেলে তো আমাদের নাগালই পাবেননা।

আমরা কেমন করে যানি বুঝে যেতাম, কোন দিকের জানালায় বসলে নানাবাড়ী দেখা যাবে। কুউউউউউউ ঝিকঝিক করতে করতে ট্রেনটা যখন নানাবাড়ীর সামনে আসতো, আমরা চিৎকার দিয়ে উঠতাম, “ঐযে ঐযে উনারা দাঁড়িয়ে আছেন। বারান্দায় দাঁড়ানো নানা, মামাদের দেখা যেতো। নানীকে দেখতে পেতামনা। কিন্তু জানতাম, উনি আছেন জানালার খড়খড়ির আড়ালে।

আমরা হাত নাড়তাম। মামারাও হাত নাড়তো। ষ্টেশনে নেমে ঠিক দেখতাম মামারা হাজির। ষ্টেশন থেকে বাসা বেশী দূর ছিলো না। কুষ্টিয়ার মাটিতে পা দিয়েই আমার এক অন্য রকম অনুভুতি হতো।

আমি ভাষায় সে সুখানুভুতির বর্ননা দিতে পারবোনা। দেশে বা দেশের বাইরে অনেক জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু অন্য কোথাও সে অনুভুতি হয়নি। রিক্সা যখন মিলপাড়ায় ঢুকতো, আমার মাথার মধ্যে সেই চেনা গন্ধটা ঘুরপাক খেতো। যেটা সবসময় আমায় স্মৃতিতাড়িত করতো।

আজও করে। কুষ্টিয়া ছাড়া এ গন্ধ আমি আর পাইনি। তখন কুষ্টিয়ার বেশীর ভাগ বাড়ী ছিলো চুনসুড়কির। হয় লাল রঙের না হলে বাইরে চুনকাম ছাড়া। নানাবাড়ীরও ছিলো অমনি একটি একতলা বিল্ডিং।

জানালাগুলো দরজার সমান বড় বড়। সবুজ খড়খড়িযুক্ত। চুনসুড়কির দেয়াল এতো পুরু ছিলো যে আমরা অনায়াসে জানালার নিচে বসে রাস্তা দেখতাম, বা ওখানে জিনিসপত্র রাখা যেত। বাসার সামনে একটা ছোট্ট পুকুর, তার পাশে দু’একটা টিনের ঘর। পুকুরের উপর একটা নারিকেল গাছ ঝুকে ছিলো।

পুকুরের পাশেই একটি মাঠে অনেক বড় বড় কাঠের গুড়ি পরে ছিলো। আমরা ওটাকে বলতাম কাঠের মাঠ। পুকুরের পিছনে ছিলো বাজার। সকাল সন্ধ্যা মানুষজনে গমগম করতো। মাঠের পিছনে ছিলো রেল লাইন।

তার ওপারে গড়াই নদী। নদীর পাড়ে শ্বশান। ট্রেনের শব্দ শুনে আমরা বলতাম এখন কোন মেল আসছে। সকাল এগারটার দিকে একটা ট্রেন আসতো মানুষে টইটুম্বুর। ছাদে পা-দানীতে মানুষ ঝুলে থাকতো।

জানালায় থাকতো লাকড়ির স্তুপ। ওখানে বলতো খড়ি। আর থাকতো আখের বোঝা। আমরা ঐ ট্রেন দেখলেই বাজারে ছুটতাম আখ কিনতে। তখন বলতাম “কুশোর’।

বাসার পাশেই ছিলো একটা কাপড়ের মিল। ‘পিয়ার টেক্সটাইল’। সকাল থেকে শুরু হতো মেসিনের ঘটরঘটর। ওটার মালিক সামসুদ্দীন সাহেব ও তার ভগ্নীপতিকে একাত্তুরে পাক-বাহিনী গুলি করে মারে। সামসুদ্দীন সাহেবের ছেলে আমার মামার বন্ধু ছিলেন।

পরবর্তিতে উনি আমার দুলাভাই হন। মহিনীমিলের ভো বাজতো দুইবার। ভোরবেলা, অন্ধকার থাকতে আর দুপুর দুটোয়। ঐ ভো শব্দেই নানী উঠে যেতেন। উনার কাজ শুরু হতো।

এক মুহুর্ত উনাকে বসে বিশ্রাম নিতে দেখিনি। ছোট বেলা থেকেই নানীর কষ্ট আমাকে কষ্ট দিতো। আমি নানীর পায়ে-পায়ে ঘুরতাম। কাজে সাহায্য করতে যেয়ে হয়তো কাজ বাড়িয়ে দিতাম। কিন্তু কখনোই নানী কিছু বলতেন না।

ভিতরের বারান্দার পাশে একটা ছোট ঘর বোঝাই কয়লা থাকত। ঐ কয়লা আবার হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে টুকরা করে নিতে হতো। কয়লা দিয়ে কয়লার চুলো জ্বালানো হতো। সেই কয়লার চুলোয় ফুকনি দিয়ে ফু দিয়ে তাল-পাখার বাতাস করে, রুটি সেকে, চামচ দিয়ে ইলিশের আঁশ ছাড়িয়ে নানীকে সাহায্য করতাম। উঠোনে মাচায় পুঁই, লাউ, ঝিঙ্গে লকলক করে বেড়ে উঠতো।

আম্মা মেরেধরে সবজি খাওয়াতে পারতেননা। কিন্তু নানীর মাচার ওসব পুঁই, লাউ, ঝিঙ্গে, শাক-পাতা অনায়াসে সোনামুখ করে খেয়ে নিতাম। চলবে......কুষ্টিয়া আমার ভালবাসার শহর (শেষ পর্ব) এই পোস্টটি আমার পুচকু সোহামনি রাজসহানকে উৎসর্গ করলাম। *** ছবি নেট থেকে সংগ্রহ করা।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.