লোচনে যতনে দেখি। কোপনে গোপনে লেখি। ।
লেখক : কুলদা রায়
আমি ফুটবল খেলা দেখি না। কারণ আমার টিভি নাই।
একটা আছে--সেটা দিয়ে শুধুমাত্র আবহাওয়া চ্যানেল দেখা যায়। এই আবহাওয়ার আগাম সংবাদগুলো ১০০% ঠিক হয়। আমার ঘরের জানালা খুলে দিলে টিভির দরকার হয় না। যদি দেখা যায় রাস্তায় লোকজন বগলে ছাতা নিয়ে চলছে--তাহলে বৃষ্টি। খালি হাত হলে রোদ।
তাইরে নাইরে না। সুতরাং নো টিভি। নো ঝামেলা। যদি একান্ত দরকারই হয় তাহলে এফ ট্রেন হলে সোজা ম্যানহাটন। টাইম স্কয়ারে বড় পদার্য় শাকিরা নেচে নেচে গাইছে।
দর্শক মেতে গেছে। তাইরে নাইরে না। আওয়ার গ্রেট শাকিরা। শাকিরার চেয়ে মহৎ আর কিছু নেই এই ভবে। এই বুঝেছি সার।
মিছে এ সংসার। শাকিরাকে নিয়ে একটি মহাকাব্য লিখব অবসর পেলে। অবসর, তুমি কবে আসিবে?
টিভি না থাকার কারণে ফুটবল দেখি না--এর চেয়েও বড় আরেকটি কারণ আছে। আমি জীবনে একবার ফুটবল খেলা দেখেছিলাম। সে খেলায় মানুষের সঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বর খেলতে নেমেছিলেন।
আকাশ থেকে পুষ্প বর্ষিত হয়েছিল। ঘটনা স্বপ্নের মত। চোখে লেগে আছে। নতুন কোনো খেলা দেখে আমার চোখ থেকে অই খেলাটি হারিয়ে ফেলতে চাই না। ঈশ্বরের লীলা হারিয়ে গেলে আর কী থাকে হে বেরাদার! সর্বহারা হয়ে লাভ নেই।
এক সময় সর্বহারাদের জন্য সারা দুনিয়াটা চিল। এখন গোল্লা। দাও শট। ভো করে শূন্যে আমাদের গোল্লা উড়ে যায়। সকল শূন্য মহাশূন্য হয়ে যাবে।
একথা একদিন ভাবি নাই তো মনে সজনী রে।
এর আগে একটি ঐতিহাসিক কাহিনী বর্ণনা প্রয়োজন। পঁচাত্তর সালে আমাদের ক্লাশে চাঁদা তোলা হয়েছিল। প্রাইমারী বনাম হাই স্কুল ফুটবল ম্যাচ। সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ বেপার।
আমার ফুটবল খেলার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাকে গোলকীপার মনোনীত করা হয়েছিল। গোলকীপারকে গোলকী বলা হত। আমরা মাঠে হাজিরও হয়েছিলাম। কিন্তু খেলাটি জাতির স্বার্থে বাতিল করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। দুপক্ষের খেলোয়াড়দের সাইজ দেখে হেডস্যার বললেন, নো, ইমপসিবল।
তালগাছের সঙ্গে তালগাছের খেলা হতে পারে। ঝামটি গাছের নয়। আমরা খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আমাদের হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
এখনো জোড়া লাগে নি। মাঝে নিঃশব্দে জলপতন হয়। বুঝেছিলাম, বৈষম্য কোনো মহৎ কর্ম হতে দেয় না। বৈষম্য নিপাত যাক।
সুতরাং এই বৈষম্যের কারণে আমাদের হাতে বেশ কিছু টাকা পঁয়সা বেচে গিয়েছিল।
অনেকদিন পড়েছিল কামরুলের কাছে। কী করা যায় এই অর্থ দিয়ে ভাবতে ভাবতে অনেকদিন কেটে গেল। আমাদের দুএকজনের হুটহাট করে গোঁফ গজাতে শুরু করেছিল। এটা দেখে কামরুল একদিন একটি ছাপানো চটি পত্রিকা নিয়ে এল। প্রচ্ছদে একটি গোলাকার বস্তুর ছবি আকা।
বড় করে লেখা ফুটবল। ফুটবলটি আকাশে উড়িতেছে না মাটিতে পড়িতেছে বোঝা যায় না। কারণ ততদিন ততদিনে আইনস্টাইনের মাথা থেকে কোনো আপেল আমাদের বইয়ের পাতায় পড়ে নাই। মাধ্যাকর্ষণ বলের ঘটনা তখনো জানা হয় নাই। বলটি তা্ই উড়িতেও পারে—আবার পড়িতেও পারে।
যা ইচ্ছা তাই মনে করে নিলেই হল। ওটা যে একটা ফুটবল তাতে কিন্তু সন্দেহ নাই। নিচে লেখা আছে—বড় করে—ফুটবল। ভিতরের পাতায় লেখা—একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট উপলক্ষে প্রকাশিত অজর সাহিত্য পত্রিকা। সম্পাদক সেলিম ওমরাও খান।
তারপরে সেলিম ওমরাও খানের একটি কবিতা ছাপা করা আছে—‘আমার মৃত্যুর পরে থেমে যাবে ব্যথার গুঞ্জন’। এটা যে একটি কবিতা—এটা যে আমাদের ওমরাও খান সেলিম লিখেছে সেটা আবিষ্কার করতে কয়েকটি বছর কেটে গিয়েছিল। পত্রিকাটির বাকী পৃষ্ঠাগুলি কোনো এক নৌকামালিক সমিতির বার্ষিক কার্যবিবরণী। আয় ব্যয়ের হিসাব।
কামরুলদের প্রেসে ছাপা।
কামরুল খুব সৎ ছেলে। কোনো দুর্নীতি তখনো ওর মধ্যে উদ্গত হয় নি। ফুটবলের টাকা পঁয়সা হালাল করেই কাজটি করেছে। সেলিমের কবিতার পাশাপাশি আমাদের সেই ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল টিমের নাম ছিল। এতেই আমরা ধন্য।
আমি গোলকী। এ আনন্দ অপার।
এই ফাঁকে আমাদের বন্ধু সেলিম—স্কুলের রেজিস্ট্রারের ওমরাও খান যখন সেলিম ওমরাও খান হয়ে গেল তখন থেকেই সেলিম লেখালেখির মাঠে নেমে পড়ল। সুকান্তর কবিতা টবিতা বাদ দিয়ে বিবাহাদির শুভ পরিণয়, বার্ষিক ওরশ মোবারক, আসিতেছে আসিতেছে প্রিন্সেস ময়না কথা কয় না থেকে শুরু করে বিভিন্ন দলের লিপলেট হ্যান্ডিবিল লিখতে লিখতে একদিন পৌছে গেল সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার অফিসে। বিচিত্রা থেকে বিটিভিতে।
তখন যমুনা সেতুর উদ্বোধন। অনেক লোকজন গমগম করছে। সেলিম বিটিভি চিহ্নিত মাইক্রোফোন নিয়ে হাসিনার আগে আগে ক্যামেরায় ধারা বিবরণী দিচ্ছে। একটু পূর্বাঞ্চলীয় টানে। নো প্রবলেম।
তারপর লাল গাড়ি। নলি শাড়ি। ঢাকায় বাড়ি। সেলিমকে আর দেখা যায় নি। আকাশে –না, মাটিতে, সেলিম ওমরাও খান কোথায় –জানি না।
এসবই ফুটবলের মহাযাদুর খেলা। আমাদের বাল্যে যদি ফুটবল খেলাটির আয়োজন না হত তাহলে কি এসব হতে পারত সেলিম? মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি ফুটবলেরই লোক।
এরকম প্রশ্ন দার্শনিকসুলভ। সেকালে আমার সেজো বোনটির বিয়ে হল খূলনায়। আমি ময়মনসিংহে।
বৃষ্টির দিনে যেতে হল খুলনায়। সঙ্গে ছোট বোনটি। তালপিঠা ভেজে নিয়েছে। বড় বয়রা—আইজারের মোড় তখনো খুলনা হয়ে ওঠে নি। গ্রাম গ্রাম চেহারা।
পথের দুপাশে ধানক্ষেত। এর মধ্যে বোনের শ্বশুরবাড়ি। সবে ঘরটি উঠেছে। টিনের চাল। আর দরমার বেড়া।
পিছনে ডোবা আর ঝোপজঙ্গল। ব্যাঙ ডাকে—গ্যাঙ গ্যাঙ। ঢোল কলমী গাছে গঙ্গা ফড়িং নাচে।
মায়ৈমা ডেকচি ভর্তি করে খিছুড়ি রান্না করলেন। ইলশ ভাজি হচ্ছে।
তালে পিঠা। বৃষ্টি না পড়ে পারে? ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি নামল। টিনের চাল ভেদ করে ঘরেরর মধ্যে বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করেছে। কিছু হাড়ি কুড়ি দেওয়া হল। কিন্তু থামাথামি নেই।
অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যে আমরা খিচুড়ি খেয়ে নিচ্ছি। গরম গরম। ইলিশ ভাজি। তালের বড়া পিঠা।
একটি ছাতি মেলা হল। ছাতিটি রাখা হল ঘরের কোণে রাখা টিভিটার উপরে। খাটের উপরে মিন্টুদা আর আমি। ছোট বোনটি কী একটা সেলাই নিয়ে বসেছে ফ্লোরে। মেজবোনটি আর অমিতবাবু অন্য একটি খাটে।
টিভি অন হল। মায়ৈমা কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, দূর্গা দুর্গা। আমার ম্যরাডোনার মুখ রাইখো গো ঠাকুর। তুমি করুণা সিন্ধু। আমরা কজন হিন্দু।
বোঝা গেল আজ ফুটবল খেলা। মায়ৈমার ম্যারাডোনার খেলা। ফ্রান্সে না জার্মানীতে। আর আমরা খূলনায়—মধ্যরাতে। ঘরের মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে ঝম ঝম—পা পিছলে আলুর দম।
ফুটবল খেলা আমার পছন্দ নয়। বাইশজন মানুষ। আর একটিমাত্র ফুটবল। সবার উদ্দেশ্য ঐ একটিমাত্র ফুটবলকে অমানুষিকভাবে লাথি মারা। চড় চাপড়ও নয়।
লাথি। সজোরে পদাঘাত। কী দোষ করেছে বলটি? একদম ফ্যাসীবাদি কাণ্ডকারখানা। কেন বাবা, বাইশটি ফুটবল নিয়ে নামলে কী হয়? বাইশজন লোক একটি নয়—বাইশটি বলকে লাথি মারতে পারে। সেটা অনেকটা শোভনীয়।
একটু কম ফ্যাসিবাদ। অনেকটা গণতান্ত্রিক। কিন্তু আমার মায়ৈমা বলছেন—দুর্গা দুর্গা। আমার ম্যারাডোনারকে রক্ষ্যা করো গো মা। তুমি ছাড়া এ জগতে কে আছে ওর।
খেলা শুরু হয়ে গেল। দুর্দান্ত খেলা। বল পায়ে পায়ে ঘোরে। কখনো মাথায় মাথায়। খেলোয়াড় যতটা ছোটে তার চেয়ে বেশি ছোটে রেফারী আর মাঝে মাঝে কে একজন মাঝারী সাইজের লোক বল ধরলেই মায়ৈমা চেচিয়ে ওঠেন, বাবা ম্যারাডোনা।
বাবা ম্যারু। টিভিতে হাজার হাজার দর্শক মায়ৈমাকে সাপোর্ট দিয়ে বলে, ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা। যাদুকরী বেপার।
মিন্টুদাও লাফিয়ে ওঠেন। আর খাটটা মচ মচ করে ওঠে।
ভেঙে পড়ার আগে মিন্টু খাট থেকে নেমে পড়লেন ফ্লোরে। মাঝে মাঝে খিচুড়ী খাওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে উল্লাশ---ম্যারাডোনা, ম্যারোডোনা। বাবা ম্যারু।
আমি মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ছি।
মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখছি—মায়ৈমা মাঝে চঞ্চল হয়ে উঠছেন, মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত। মাঝে মাঝে আর্তনাদ। কে যেন ম্যারাডোনার পায়ে পেছন থেকে আঘাত করেছে। ম্যারাডোনা মাটিতে পড়ে গেছে। মায়ৈমা মাথায় জল দিচ্ছেন।
খেয়ে নিচ্ছেন প্রেসারের আরেকটি ট্যাবলেট। বৃষ্টি পড়ছে ঝম ঝম করে। ঘরের বিড়ালটি ভিজতে ভিজতে লেজ উচু করে ঘুরছে। ঘুমোতে চায়। আমি মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বুঝতে পারছি মায়ৈমা মানতি করছেন, দোহাই ত্রিণাথ, তোমার জগতের নাথ।
ম্যারাডোনার বাঁচাও। রক্ষ্যা করো গো ঠাকুর। গোল আর হয় না। রাত কেটে যাচ্ছে। বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে।
ঘুম টুটে যাচ্ছে। সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোচ মাথার চুল ছিড়ছে। দর্শকদের গলা ভেঙে গেছে। হায় হায়--ম্যরাডোনা হেরে যায়--হেরে যায়!
মায়ৈমা আমাকে ঠেলে ওঠালেন।
বললেন, বাবা—হাত তোলো। দেখি, ঘরের সবাই প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে গেছে। মায়ৈমা তদগত ভাবে বলছেন, চোখ মুদে। আমরা তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছি,, হে ঈশ্বর, তুমি অগতির গতি। তুমি সর্বশক্তিমান।
তুমি বিনা গাছের একটি পাতাও নড়ে না। তুমি রক্ষ্যা না করলে কে করবে আমাদের। আমাদের ম্যারাডোনাকে।
মায়ৈমা কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, হে জগদীশ্বর, ম্যারাডোনা পা দিয়ে কিছুই করতে পারছে না। তুমি এবার তোমার খেলা দেখাও।
পায়ের দরকার নেই। তুমি তোমার গোপন হাতটি পাঠাও। ম্যারাডোনার জন্য গোল করে দাও হে পরমেশ্বর। আমি তোমার জন্য পাঁচসিকার চিনি দেব। সত্যি সত্যি দেব।
কোনো ভুল নাই।
চিনি খুব মিষ্টি। এর চেয়ে মধুর আর কী আছে ডায়াবেটিকদের কাছে। সত্যি সত্যি কাজ হল। ঈশ্বর সত্যি সত্যি পাঁচসিকার চিনির লোভে পড়ে গেল।
ততক্ষণে ম্যারাডোনা বলটি পাস দিয়ে এগিয়ে গেছেন গোল পোস্টের কাছে। কে যেন পা দিয়ে ঠেলে দিল বলটি। মাথা দিয়ে জালে পাঠাতে চেষ্টা করল। ম্যারাডোনা ফেইল। মাথায় লাগেনি।
আরেকবার হতাশা। মায়ৈমা চোখ বুজে আছেন। হাত জোড় করা। বলছেন, হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর। পাঁচসিকা চিনি দেব।
আর এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কোত্থেকে একটি হাত এসে ঠিকই ঠেলে দিল বলটিকে জালের মধ্যে। আমরা দেখছি—গো-ও-ও-ল। রেফারী অবাক। তিনি বাঁশি বাজাতে ভুলে গেলেন। ঈশ্বরের হাতকে কী করে তিনি ফাউল বলবেন।
বলার মত হিম্মত তার কি আছে! আকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আর চারদিক থেকে কোটি কোটি কণ্ঠে উল্লাশ ভেসে যাচ্ছে—ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা।
আমার মায়ৈমা মা ফ্লোরে অনেকক্ষণ পরে বসলেন। চোখ মুছে এক খিলি পান বানালেন।
মুখে পুরলেন। হাসতে হাসতে বললেন, দূর্গা দূর্গা।
বৃষ্টি থেমে গেছে। সকাল হয়ে আসছে। পাঁচ সিকার চিনি আনতে হবে।
এই চিনি ছাড়া কি ঈশ্বরের হাতটি পাওয়া যেত?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।