যে কোনো যুদ্ধে অগ্রবর্তী একটা দল থাকে। তারা যুদ্ধে পেছনের মূলদলের অগ্রযাত্রা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পথের মাইন পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে নদীপথে পারাপারে ব্যবস্থা করা, সম্ভাব্য ছোটখাট প্রতিরোধ নির্মূল করা ছাড়াও মূলদলের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে।
নামে ভিন্নতা থাকলেও তারা আসলে একই দলের কৌশলগত যোদ্ধা, একই আদর্শিক দলের সদস্য এবং একই কমান্ডের অধীনে তারা অখণ্ড। এমনটি অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যেমন কিছুদিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি এসে ঘুরে গেলেন বাংলাদেশে।
তাঁর আগমনের এক সপ্তাহ আগেই সে দেশ থেকে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্রবর্তী একটি দল ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে অবস্থান নিয়েছিল।
সর্বক্ষেত্রেই এটা লক্ষ্যণীয় যে, অগ্রবর্তী দলটি মূলত তার পেছনের এলিট বা মূলদলটির অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে কাজ করে থাকে। নামে ভিন্নতা বা অবস্থানের সময়ে ভিন্নতা থাকলেও, মূলত দুটোই একই আদর্শে বিশ্বাসী, একই দলের অঙ্গ। পরিচয়ের এই ভিন্নতা শুধুই কৌশলগত কারণে; আদর্শগত বা অন্য কোনো কারণে নয়।
ভূমিকায় এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামীর অবস্থান এবং ভূমিকার ব্যাপারে আমার তত্ত্বীয় ভাবনাগুলো উপস্থাপন করা।
অনেকে হয়তো ভাববেন যে, এ ধরনের এবং ভাবাবেগের লেখা, ১৬ কোটি মানুষের দেশে এর আগেও অনেকেই লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন।
আমার দাবি, না, প্রসঙ্গ এক হলেও, ভাবনায় ও বক্তব্যে লেখাটি একেবারেই ভিন্ন এবং উত্থাপিত দাবির বা বক্তব্যের পক্ষে, সম্ভবত এটাই প্রথম লেখা। আলোচনা, পর্যালোচনা এবং যুক্তির সরলরেখার পথ ধরে এগিয়ে গেলে, নিঃসন্দেহে লেখাটিকে একটি বইয়ের আকার দেওয়া যায়। তবে সে দায়ভার অন্য কেউ নেবেন, এটাই আশাবাদ।
১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনীর দোসর, সহায়কবাহিনী জামায়াত ইসলাম দ্বারা গঠিত বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীসমূহ, যেমন, আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তিবাহিনী ইত্যাদির কথা বর্তমান প্রজন্ম জেনেছে বিভিন্নভাবে এবং উপস্থাপনায়।
স্বাধীনতার পরে দলটির সর্বোচ্চ নেতাসহ অন্যান্যরা হয় দেশত্যাগ করেছিল, অথবা আত্মগোপনে গিয়েছিল। বেশকিছু জামায়াতি অবশ্য মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহতও হয়েছিল।
১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রণীত সংবিধানে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণসহ তাবৎ ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াত ইসলামকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতের দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
যুদ্ধকালীন সময়ে অপরাধের জন্য ১৯৭৩ সালে গ্রেফতারকৃত হাজার হাজার মিলিশিয়া সদস্যকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল বিশেষ আদালতে।
জামায়াতও বসে থাকেনি। হৃত রাজ্য ফিরে পেতে, তার প্রভু পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খুব সূক্ষ্মভাবে বাংলাদেশে বিছিয়ে দেয় ভয়ঙ্কর সব চক্রান্তের রাজনীতি। ছদ্মবেশে অগ্রবর্তী একটা দলের সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে অবিশ্বাস্য গোপনীয়তায় সে চক্রান্তের জাল ফেলতে শুরু করেন মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন অতি চিকন মাথার সৈনিক।
মেজর জিয়া নামের এ বিষবৃক্ষের চারা রোপিত হয়েছিল মূলত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই।
যুদ্ধের ডামাডোলে কেউই তাকে সন্দেহ করতে পারেনি। সে সময় সবার দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পারলেও যুদ্ধপরবর্তী অনেক গবেষণায় বিতর্কের ঝড় তুলেছেন এ পাকসৈনিক।
অনেকে সন্দেহের যৌক্তিক তীর ছুঁড়েছেন তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দিকে। অগ্রবর্তী দলের এ সেনানায়ক তার সুচতুর কৌশলে সদ্যজন্মা এ দেশটির সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি দখলে নিয়ে নেন প্রায় বিনাবাধায়। তাকে এ কাজে সহায়তা করে খোন্দকার মুশতাক শ্রেণির বেশ কিছু পাকিসৈনিক, যারা এ অগ্রবর্তী দলেরই সদস্য।
১৯৭৫ সালের আগষ্টে এ অগ্রবর্তী দল অত্যন্ত সুকৌশলে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করতে সক্ষম হয়। অগ্রবর্তী দলের সাফল্যজনক অগ্রযাত্রা সেই থেকে চলতে থাকে এবং প্রায় বাধাহীন ভাবেই। তারপর শুরু হয় প্রতিশোধের রাজনীতি আর মুক্তিযোদ্ধা নিধন। তা শুরু হয় প্রথমে মূল সেনাবাহিনীতে,তারপর বেসামরিকদের উপর। গভীরভাবে চিন্তা করলে খুব স্পষ্টতই ফুটে ওঠে এ অগ্রবর্তী বাহিনীর শৈল্পিক সুবিন্যস্ত কাজকর্মগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
জিয়া কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়েই জারি করা হল ইনডেমনিটি আইন। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিশেষ বিমানযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হল লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বিভিন্নভাবে পুরষ্কৃত করা হল হত্যাকারীদের। পর্যায়ক্রমে তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। সেনাছাউনি থেকে গঠন করা হল বিএনপি নামের এক অগ্রবর্তী রাজনৈতিক দল।
সেনা হিসেবে ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিকভাবে পেছনের মূল দল বা শক্তিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া অনেক কঠিন কাজ। তাই সরাসরি রাজনৈতিক ময়দান তৈরির কর্মযজ্ঞ।
শুরু থেকে ছদ্মবেশে গোপনে থাকলেও, মেজর জিয়ার নেতৃত্বে অগ্রবর্তী দলটি বিএনপির মাধ্যমে তার স্বরূপে আত্নপ্রকাশ করল। পাশাপাশি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল সৌদি আরব, চীনের মতো পাকিসমর্থক দেশগুলো। বাকশালের অতিউৎসাহী সদস্য হয়েও মেজর জিয়া বাকশালের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে বাংলার মাটিতে সাদর সম্ভাষণ জানাল বিতাড়িত জামায়াত ইসলামীকে।
পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল জামায়াত ইসলামের বাংলার মাটিতে। সে সঙ্গে সমাপ্ত হল চক্রান্তের প্রথম ধাপটির। আওয়ামী লীগ তখন নিপাতিত একটা দল, যার নেতৃত্ব নেই, কর্মীরা আত্নগোপনে অথবা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা একটি দল। তারপর থেকে শুরু হল মূলদল জামায়াতকে শাসকদল হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার যতসব যজ্ঞ ও আয়োজন।
পাঠক, একের পর এক ঘটনাগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখুন- কীভাবে জামায়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ছদ্মবেশী বিএনপিকে অগ্রবর্তী দল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আসলেই কি তা নয়? তাহলে এটাই হোক বিচার্য যে, এ বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? বিএনপি স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যা কিছু করেছে,তা সম্পূর্ণ জামায়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই করেছে, যা সাধারণত একটা অগ্রবর্তী দলই করে থাকে।
এ অগ্রবর্তী দল হুট করে হাওয়া থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এতে ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, কৌশল, সুদক্ষ অভিনয় এবং সর্বোপরি,আন্তর্জাতিক স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অকৃপণ সহযোগিতা। এছাড়াও যেটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং উল্লেখযোগ্য তা হল বাংলার এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রায় ৪২ বছর ধরে বোকা বানানো।
যাক, যা বলছিলাম, অগ্রবর্তী দলটি হুট করে হাওয়া থেকে যে উড়ে আসেনি তার এক প্রমাণ সৈনিক জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশের পরই রেখে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম, আই উইল মেক পলিটিক্স ইমপসিবল ফর দ্য পলিটিসিয়ানস। ’
কিন্তু এত টাকার উৎস কী? যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশটিতে যেখানে দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ চলছিল, সেটিই মুজিব হত্যার পর জিয়ার হাত ধরে কাড়ি কাড়ি টাকায় ভর্তি হয়ে গেল? উত্তর খুব সোজা। আমেরিকা, সৌদি আরব, পাকিস্তান, লিবিয়া আর চীনের মতো দেশগুলোই সে টাকার উৎস। যুদ্ধকালীন সময়ে এ দেশগুলোই পাকিস্তানকে অর্থ ও যুদ্ধের রসদ দিয়ে সাহায্য করেছিল এবং মুজিব হত্যার পর এ দেশগুলোই জিয়ার এ অগ্রবর্তী প্রক্সি-দল বিএনপিকে সহযোগিতা করেছিল মূলত বিএনপিকে শক্তিশালী করতে নয়; বরং জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে পাকিবাজ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে।
প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে মুজিব হত্যার পর সরাসরি জামায়াতকে কেন ক্ষমতায় বসানো হল না।
তার উত্তর হচ্ছে প্রথমত, মুজিবহত্যাকে একটা সাধারণ সামরিক অভ্যুত্থানের পরিণতি হিসেবে দেখানো, এবং দ্বিতীয়ত এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো চক্রের সম্পর্ক নেই, তা প্রমাণের জন্য সরাসরি জামাতকে ক্ষমতায় প্রতিস্থাপিত করা হয়নি।
এরপরও আর একটা উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট যে, যুদ্ধপরবর্তী এত অল্প সময়ের মধ্যে জামায়াতে ইসলামকে ক্ষমতার মসনদে দেখলে বাংলার মানুষ মেনে নিত না এবং তখনই হয়তো দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে বসত। তাছাড়া এত তাড়াহুড়ারও তো দরকার ছিল না। জামায়াতের অগ্রবর্তী প্রক্সি-দলটি ক্ষমতায় থাকা মানেই যে জামায়াতের ক্ষমতায় থাকা এটা সবচেয়ে বোকা শত্রুটিও বুঝতে পেরেছিল। দেশপরিচালনায় জামায়াতের অদৃশ্য একটা হাত সবসময়ই যে ছিল, তা আজ আর কারও না বোঝার কারণ দেখি না।
এবার দেখা যাক, ক্ষমতায় না থেকেও কীভাবে জামায়াত দেশ শাসন করেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কী কী পরিবর্তন হয়েছে? সেগুলো কার প্রয়োজন পূরণ করেছে? এ দুটি প্রশ্নের যৌক্তিক পর্যালোচনা করলেই আমার দাবির যথার্থ উপস্থাপনা হবে বলে আমি মনে করি এবং আত্মবিশ্বাসে বেশ নিশ্চিত। কিছু উদাহরণ দিলে বুঝতে হয়তো সুবিধা হবে।
যেমন, ইনডেমনিটি আইন জারি করা, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথমে বিসমিল্লাহ এবং পরবর্তীতে ইসলাম সংযুক্তিকরণ, ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম এবং স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস খুব সুচতুর ও সূক্ষ্মভাবে মুছে ফেলা, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান মিত্রদেশ ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করা, খুব ধীরে নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা প্রদানে প্রাধান্য না দিয়ে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা, ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য দেশে স্কুলের চেয়ে অধিক হারে মাদ্রাসা এবং মসজিদ স্থাপনা করা, ব্যাঙ্ক-হাসপাতাল-শিশুশিক্ষা-বীমা ইত্যাদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা গ্রহণ করা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জামায়াতের লোকদের বিপুল হারে নিয়োগ দেওয়া, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব গোপনে ছাত্র শিবিরের প্রসার বৃদ্ধি করা, জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিদেশে বিভিন্ন মিশনে চাকরি দেওয়া, সে হত্যাকারীদের বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেওয়া, সে দল থেকে সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া, জামায়াতকে বিএনপি সরকারের অধীনে দুজন মন্ত্রীর পদ দেওয়া, বিভিন্ন রূপে ও নামে বাংলা ভাইদের জন্ম দেওয়া, ২১ আগষ্টের নারকীয় ঘটনা ঘটানো, মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে রাজাকারদের দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা ইত্যাদি।
এ ধরনের আরও শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়।
তারপরও যেমন পঁচাত্তর-পরবর্তীতে বাংলাদেশে একটা নব্য ধনিকশ্রেণি তৈরি করা হয়েছে। তাদের অর্থের উৎস এবং ক্ষমতার বলয় সম্পর্কে পরিষ্কার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ ৪০ বছরের শেষের দিকে এক কথায় তারাই মূলত বিভিন্নভাবে দেশশাসন করেছে, দিকনির্দেশনা দিয়েছে। চাকরি, ব্যবসায়, রাজনীতিতে, সাহিত্যে,মিডিয়াতে প্রায় সবখানেই এসব নব্য দাড়িগজানো ধনিকশ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় নয় কি?
তাছাড়াও খুব সুচিন্তিত ও সূক্ষ্মভাবে এ নব্যদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে সমবন্টন আকারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে দৃশ্যও কিন্তু যথেষ্ট দৃশ্যমান।
এ সবকিছুর গোড়ার কারণই মূলত এক ও অভিন্ন, জামায়াতের মওদুদীবাদের বৈপ্লবিক প্রসার ঘটানো এবং ইরানীয় আদলে জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমতার শীর্ষে বসানো।
আসুন একটু কল্পনা করা যাক। ধরুন পঁচাত্তর-পরবর্তীতে বিএনপি না হয়ে যদি জামায়াতে ইসলামী সরাসরি ক্ষমতা দখল করত এবং বিএনপি বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশে যে পরিবর্তনগুলো এনেছে এবং যেভাবে শাসন করেছে, জামাত কি তার থেকে আলাদা কিছু করত? আমার পর্যবেক্ষণে উত্তর হচ্ছে ‘না’, অর্থাৎ বিএনপি যা কিছু করেছে তা একটা অগ্রবর্তী দল হিসেবে তার মূল দলকে নির্বিঘ্নে প্রতিষ্ঠা এবং সার্ভ করার জন্যই করেছে।
যদি তাই হয়, তাহলে দাঁড়াল কী? বিএনপি কি আসলেই স্বপ্রতিষ্ঠিত, স্বতন্ত্র কোন দল? না কি জামায়াতেরই একটা অংশমাত্র? আমার পর্যবেক্ষণ এবং বিবেচনায় বিএনপি শুধুই জামায়াতের একটা অগ্রবর্তী জামায়াতীয় প্রক্সি-দল; অর্থাৎ বিএনপির ভূমিকায় অভিনয় করছে যে দলটি, জামায়াতে ইসলামীই তার মূল এবং একমাত্র পরিচয়।
আমার ধারণায়, গত জোট সরকারের আমলটা ছিল বিএনপি নামধারী দলটির শেষ আমল এবং অগ্রবর্তী দল হিসেবে বিএনপির যতটুকু করার কথা বা পরিকল্পনায় ছিল, তার সবটুকুই এ জামায়াতের প্রক্সি-দল বিএনপি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই শেষ করেছে।
একটু খেয়াল করে দেখুন, গত জোট সরকারের আমলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। অথচ মাত্র দুটি মন্ত্রীত্ব পেয়েও দেশটি সম্পূর্ণ পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম। সে সময় দেশের যে কোনো সিদ্ধান্তই হয়েছে জামায়াতের ইচ্ছায় অথবা ইশারায়।
তারেক জিয়া জামায়াতের সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, জামায়াত-বিএনপি একই মায়ের দুই সন্তান। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ তো দাঁড়াতেও পারেনি।
কিন্তু ছাত্রদল উঠতে-বসতে শিবিরের হাতে মার খেয়েছে, অপমানিত হয়েছে, শিবিরের বি-টিম হিসেবে কাজ করেছে অবনত মস্তকে। তা হয়েছে খালেদা-তারেকেরই আদেশে এবং হুমকিতে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের আশ্রয় দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করানো তো আজ সবার জানা। দশট্রাক অস্ত্র। জামায়াত একটা সম্পূর্ণ মুসলিম দেশের শাসনভার নিতে যাচ্ছে অচিরেই, অথচ সে দেশে হিন্দুরা থাকবে কেন? জোট সরকারের আমলের মতো হিন্দুদের উপর এত বীভৎস অত্যাচার এর আগে কি কখনও হয়েছে?
যদিও খুব সুক্ষ্মভাবে দেশ থেকে হিন্দুবিতাড়ন শুরু হয়েছে মূলত পঁচাত্তরের পর থেকেই।
এ পর্যন্ত প্রায় তিন কোটির অধিক হিন্দু দেশত্যাগ করেছে। এ ধরনের উদাহরণ আরও হাজারটা দেওয়া যেতে পারে।
আমার ধারণা আরও স্পষ্ট হয় যখন ভাবি, ইয়াজউদ্দিন আর আজিজকে দিয়ে যে করেই হোক নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মাটি কামড়ানো চেষ্টার কথা। আমি আজ নিশ্চিত, সেবার যদি জোট আবার ক্ষমতায় আসত, বিএনপি যদিও তখন জামায়াত গহ্বরে হারিয়া যাওয়া একটা দল প্রায়, তারপরও সম্পূর্ণ ঘোষণা দিয়ে বিএনপি বিলুপ্ত করে দিয়ে বিএনপির সবাই জামায়াতে যোগদান করে শুধু বাংলাদেশ জামায়াত হিসেবেই এক দলের শাসন চালাত।
ইরানের খোমেনীর যে বিপ্লব হয়েছিল শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ঠিক সেভাবেই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিপ্লবের মাধ্যমে জামায়াত বাংলাদেশে ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল।
আরেকটু ভিন্নভাবে দেখলে বলা যায়, স্বাধীনতাপরবর্তীতে মুজিবহত্যার আগমূহূর্ত পর্যন্ত দেশ যে আদর্শ বা নীতিমালায় চালিত হয়েছে, চল্লিশ বছর পরের হিসেবে দেখা যায় দেশ চালিত হয়েছে সে আদর্শ বা নীতিমালার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে। এতেও আমার দাবির পক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠা পায়।
তাছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের দীক্ষার আলোয় একদলীয় বাকশালের যে শাসনের শুরু তিনি করেছিলেন, চল্লিশ বছর পর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় যেতে পারলে মূলত জামায়াত-বিএনপিসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বিলুপ্ত করে ইরান-স্টাইলে ইসলামের শাসন জারি করলে আমি অবাক হতাম না।
অবাক হতাম না বাহাত্তর-স্টাইলে জামায়াতকে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, তেমনি চল্লিশ বছর পর জামায়াতও চাইলে ক্ষমতার দম্ভে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এবং এর নেতৃত্বকে দেশছাড়া করলে। তার কিছু আলামত কি আমরা এক-এগারোর সময় দেখিনি।
মাইনাস ওয়ানের কথা আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। তার কারণ, জামায়াতের ইসলামিক ধারায় এক শাসনতন্ত্র মূলত সমাজতন্ত্রের একদলীয় বাকশালরীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মের একটা রীতি এবং জামায়াত ক্ষমতায় আসলে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। নয় কি?
মূল জামায়াতে ইসলাম না হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ননামে অর্থাৎ ‘বিএনপি’ নাম ধারণ করে পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলাম এরই মধ্যে অনেক বছর শাসন করেছে বাংলাদেশ। এর আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি, আধা-সরকারি এবং বেসরকারি যে কোনো জায়গাতেই একাধিক স্তরে বসে আছে জামায়াতের নিজস্ব লোকজন। কিন্তু এটা কী করে হয়?
আমার ধারণা, তারা এসব প্রশাসনে যখন নিয়োগ পেয়েছিল, তাদের লেবাস ছিল বিএনপির।
অর্থাৎ মূলত তো তারা শুরু থেকেই মূল জামায়াতেরই লোক। এখানেও আমার সে দাবিই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ বিএনপি হচ্ছে বাংলাদেশে জামায়াতেরই অগ্রবর্তী একটি প্রক্সি দল। মূলত তারা এক এবং অভিন্ন জামায়াতে ইসলামী; তাদের স্বত্ত্বাও এক।
বাংলাদেশে বিএনপি না থাকলে জামায়াত থাকবে, জামায়াত না থাকলে বিএনপি থাকবে। অর্থাৎ যে রূপেই থাকুক না কেন, জামায়াত থাকবেই।
কারণ, যে নামেই ডাকুন, ভালবাসার মানুষটি তো সে একই জন। পোষাকের ভিতরের দেহটির অভিন্নতাই এর মূল কারণ। পঁচাত্তর-পরবর্তী বিএনপি তার বহুবিধ কাজ এবং আচরণ দিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা জামায়াতে ইসলামীরই ক্লোন বা অভিন্নরূপী। আর শুধুমাত্র এর ধারাবাহিকতার কারণেই খালেদার বিএনপি সম্পূর্ণ নির্লজ্জ-চাটুকর বেশে উঠে পড়ে লেগেছে জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে।
ব্যাপারটা উল্টোটাও হতে পারত।
ধরুন, জামায়াতে ইসলামের যা ইচ্ছা তাই হোক। বিএনপি এসব গায়ে না মাখিয়ে নিজের মতো চললে এবং নিজস্ব রাজনীতির চর্চায় মনোনিবেশ করলে, আমার দাবি নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা পেত না। অথচ এর উল্টোটাই আমরা বরং ঘটতে দেখেছি এক-এগারোর সময়, যখন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং বিএনপির সব নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল।
জামায়াতের ভূমিকা তখন কী ছিল? জামায়াত কিন্তু তখন সামান্য ভদ্রতাসূচক কোনো প্রতিবাদ জানায়নি বা বিএনপির পক্ষে বক্তব্য দেয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন জানায়নি? জানায়নি কারণ, এটাই নিয়ম।
অগ্রবর্তী দল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মূলদলের পদচারণা নির্বিঘ্ন করবে। আর সে কাজ করতে গিয়ে যদি তাদের জীবন বিপন্ন হয়, তাতে জামায়াতে ইসলামীর কিছুই যায়-আসে না বা তারা সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকবে স্বভাবতই।
কিন্তু খালেদা এবং বিএনপি সেটা করতে পারছেন না শুধুমাত্র তাদের ‘অগ্রবর্তী প্রক্সি দলের’ পরিকল্পনামাফিক দায়িত্বপালনের কারণে। জামায়াতকে বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকে নির্বিঘ্নে হত্যা করতেও এতটুকু বুক কাঁপছে না দলটির। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জামায়াতের আরেক ক্লোন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ জলন্ত উদাহরণ।
ব্যাপারটা এমন কী কঠিন যে বোঝা যাচ্ছে না তারপরও?
বিষয়টা এতই স্পষ্ট যে, এতগুলো কথা না বললেও হয়তো চলত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি এবং জামায়াত, দল দুটোর যে কোনো একটিও যদি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে অপরটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আপনা থেকেই। সে কারণে বলা যেতে পারে, বর্তমান বাংলাদেশে এ মৌলবাদী দল দুটোর (মূলত একটি) বাঁচা-মরার লড়াই। টিকে থাকার লড়াই। যা এ দলদুটোর সমসাময়িক রাজনৈতিক চর্চায়ই স্পষ্টত দৃশ্যমান।
চর্চাটা যে খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল, তাও নয়। তবে এর বিভৎসতার ধারণা এ প্রজন্মের ছিল না, যারা একাত্তর দেখেনি।
এ যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির হার হলে, পরিণতি সে জামায়াত-বিএনপির মতোই হবে। এ লড়াই দুপক্ষেরই বেঁচে থাকার লড়াই; টিকে থাকার লড়াই। এ যুদ্ধে একপক্ষকে হারতেই হবে।
এ পর্যায়ে যুদ্ধের এটাই নিয়ম। আর এ সত্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সরকারসহ সকল স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিগুলোকে উপলব্ধিতে আনতে হবে এবং সেভাবে কর্মপন্থা সাজাতে হবে। তা না হলে, দ্বিতীয় সুযোগটি আর পাওয়া না-ও যেতে পারে।
সব্বির খান : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। লিনক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।