আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লিচু, যৌবন ও ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী

লিচু, যৌবন আর জীবন ক্ষণিকের। এটা একটা উর্দু প্রবাদ। এই দুনিয়ায় কিছুই স্থায়ী নয়, তবে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী হলো ক্ষমতা। কেউই চিরকালের জন্য ক্ষমতায় আসে না। সবাইকেই একদিন না একদিন ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়।

১৯৪৭-এর পরে আমাদের অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় ছিলেন দুই সামরিক স্বৈরশাসক, আইয়ুব খান আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতায় সবচেয়ে কম দিন থাকার রেকর্ড বোধ হয় আওয়ামী লীগেরই। ১৯৯০ সালের পর ক্ষমতায় পর পর দুবার একই গোষ্ঠী আসেনি, অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। এবার পাকিস্তানের নির্বাচনেও দেখা গেল, সর্বশেষ ক্ষমতাসীনদের ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবু একবার নির্বাচনে জিতে এলেই ধরা হয়ে যায় সরা, দেশটা হয়ে যায় একেবারে মৌরসি-পাট্টা।


অথচ এই দেশের মানুষ, দেখা যাচ্ছে, এই বাড়াবাড়িটাকেই অপছন্দ করে সবচেয়ে বেশি। একবার, বোধ করি, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে, ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ নামের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সদ্য ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া বিএনপির নেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ আগামী ৪০ বছরেও ক্ষমতায় আসবে না। সেই নির্বাচনেই বিএনপি হেরেছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে, কে যে বুদ্ধি দিল শেখ হাসিনাকে, মাত্র কদিনের জন্য আপনি আবার গণভবন ছেড়ে কেন যাবেন, নির্বাচনের পরে তো আবার ফিরতেই হবে, কাজেই গণভবনটা লিখে দিই আমরা আপনাকে; তা করতে গিয়ে কী যে সমালোচনার ঝড় উঠল আর ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন হলো মুষ্টিমেয়। তখন, নির্বাচনের পরপর, মাহী বি. চৌধুরী বলেছিলেন, আমাদের যতজন মন্ত্রী আছেন, ওদের ততজন এমপিও নেই।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি ও জামায়াত যখন ক্ষমতায়, তখন মনে হচ্ছিল, এরা কোনো দিনও ক্ষমতা ছেড়ে যাবে না। তাদের কথাবার্তা হাবে-ভাবে তা ছিল স্পষ্ট। আর তারা তা ভাববে না-ই বা কেন। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারটাকে নিজের মনের মতো করে গড়েপিটে নেওয়ার সব ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছিল। তবু ক্ষমতা ছাড়তে হলো।

তারপর যখন নির্বাচন হলো, দেখা গেল, আওয়ামী জোট এবার দুই-তৃতীয়াংশ নয়, তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এই ভোটগুলোর প্রায় পুরোটাই নেগেটিভ ভোট, মানে সর্বশেষ শাসকদের বাড়াবাড়ির প্রতি জনগণের গভীর অনাস্থা—এমনটাই বলে মনে করে থাকেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ক্ষমতার ধর্ম, দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা চিরকাল ধরে রাখা যায় না, কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা ছাড়তে চান না এবং তাঁরা মনে করেন, তাঁরা চিরকাল ক্ষমতায় থেকে যাবেন। আর এই যে মনে করাটা, এটা তাঁরা নিজেদের স্বার্থে করেন না, দেশের স্বার্থে করেন, তাঁরা মনে করেন, তাঁরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক, এই দেশটার ভালোর জন্য কেবল তাঁদেরই ক্ষমতায় থাকাটা প্রয়োজন, কাজেই দেশের ভালোর জন্য ক্ষমতার কাঁটাভরা গদিটাতে তাঁদের অতিকষ্টে আরও এক মেয়াদের জন্য, অন্তত আরও একটা মেয়াদের জন্য বসা খুবই দরকার। দুঃখের বিষয় হলো, তাঁদের এই মনে করাটার সঙ্গে জনগণের মনের কথাটা মেলে না।

জনগণের চাওয়ার একটা মূল্য আছে, শক্তিও আছে। কাজেই ক্ষমতায় কেউ চিরকাল থাকে না।
এই কথাটা যদি ক্ষমতাসীনেরা মনে রাখতেন এবং সেটা প্রথম দিন থেকে মনে রাখতেন, তাহলে পৃথিবীতে আমাদের বসবাসটা আরেকটু সুন্দর, আরেকটু আরামদায়ক হতো। প্রথম দিন ক্ষমতায় এসেই যদি শাসকেরা বলতেন, এই রাজপ্রাসাদ আমার নয়, এই কুশনবিছানো সিংহাসন আমার নয়, এটা একটা পান্থশালা আর আমি এখানে দুদিনের অতিথি মাত্র, কিছুদিন পরে আমার উত্তরসূরির হাতে এই ঘরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারলে বাঁচি—তাহলে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখের রাত্রির অবসান ঘটত। এই সরকারের তিনটা বছর অন্তত গেল বিএনপি ও বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলনে।

কত গাড়ি যে পুড়ল, গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে গেল মানবশরীরও, অপচয়িত হয়ে গেল আমাদের কত মূল্যবান শ্রমঘণ্টা। শুধু নির্বাচনটা যেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়, এই একটা দাবি থেকে।
এখন ক্ষমতাসীনেরা কেন চান না নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক? কেন সেটা ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া চাননি, ২০০৬ সালেও বিএনপি চায়নি, এখন আওয়ামী লীগ চাইছে না। আমরা জানি, আওয়ামী লীগের রেডিমেড উত্তর আছে, আমরা কিছু করিনি, যা করার, মহামান্য আদালত করেছেন পবিত্র সংবিধান ও আইনের আলোকে।
আমার ধারণা, ক্ষমতাসীনেরা যতই ক্ষমতান্ধ হোন না কেন, এটা তাঁরা জানেন, ক্ষমতা মানুষকে অজনপ্রিয় করে, পর পর দুবার নির্বাচনে জেতার মতো ভালো কাজ তাঁরা করেন না, করার যোগ্যতা রাখেন না, করতে চান কি না, সেটাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।

কাজেই তাঁরা নির্বাচনটাকেই নিজের মনের মতো করে অনুষ্ঠিত করতে চান। তা করে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। অন্তত ১৯৯০ সালের পরে হয়নি।
এখন একটা তর্ক করা যাক, একেবারেই কাল্পনিক একটা তর্ক। ধরা যাক, দেশের মানুষ চায় না যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক বা তার মেয়াদ পূর্তির পরে আবার ক্ষমতায় আসুক।

এই অবস্থায় দেশে একটা নির্বাচন হলো, যাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটল না। এবং তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আবারও ফিরে এল। তাতে কি দেশের এবং আওয়ামী লীগের মঙ্গল হবে? এই প্রশ্ন কেবল আওয়ামী লীগের বেলায় খাটবে, তা নয়। বিএনপিকে ধরেও এই প্রশ্ন তোলা যায়। ধরা যাক, ২০০৬ সালে বিএনপি একটা যেনতেন নির্বাচন করে ফেলতে সক্ষম হলো এবং তার মাধ্যমে তারা পুনর্বার ক্ষমতাসীন হলো, তা কি ভালো হতো?
আমার ধারণা, নির্বাচনে জনগণের চাওয়ার প্রকৃত প্রতিফলন হতে দেওয়া উচিত।

অজনপ্রিয় দল বা জোটের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখা আখেরে সুফল বয়ে আনবে না। আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষের সামনে কোনো বিকল্প নেই, তাই তারা হাভাতের মতো একবার এই দল আরেকবার ওই দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাচ্ছে এবং প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে, তবু বলতে হবে, নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটতে দিতে হবে। সেটা একটা ইচ্ছাপূরণের নির্বাচনের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর হবে।
জানি, আমাদের সামনে অনেক বাস্তব বিষয় বিবেচনার জন্য উপস্থিত আছে। যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারের শেষ পরিণত কী হবে? জঙ্গিবাদীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না তো? মৌলবাদ কায়েম হবে না তো?
কিন্তু আমার মনে হয়, সব সমস্যার সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের কাছেই আমাদের হাত পাততে হবে।

অমর্ত্য সেনের সেই দুর্ভিক্ষ ও গণতন্ত্রের তত্ত্বটাকে একটু বিবেচনায় নিই! তিনি বলেছেন, যে দেশে গণতন্ত্র আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কারণ, দেশের কোথাও খাদ্যাভাব দেখা দিলে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তা প্রকাশ করবে, সরকার তা জানতে পারবে, সরকারকে যেহেতু পরেরবার ভোট চাইতে জনগণের কাছে যেতে হবে, কাজেই তারা তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেবে, ওই অঞ্চলে খাদ্য পাঠাবে। এখন সরকার যদি বলতে থাকে, সংবাদমাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রকাশিত হচ্ছে, সুতরাং ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার নেই এবং ভোট আমাকে চাইতে যেতে হবে না, ভোট পাওয়ার জন্য একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল আমরা অবলম্বন করছি, তাহলে সেটা আর গণতন্ত্রই থাকে না। তাই বারবার করে বলি, গণতন্ত্রটাকে চলতে দিন। যত অপ্রিয়ই হোক না, যত অপ্রীতিকরই হোক না কেন, ভোটে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানোর ব্যবস্থা আমাদের রাখতেই হবে।


তার ফলে আপাতত কারও হার হতে পারে। মনে হতে পারে, বাকস্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা এবং খোদ গণতন্ত্রই তো ‘ওদের’ হাতে নিরাপদ নয়, কাজেই ভোটের মাধ্যমে ওদের ক্ষমতায় আসার অধিকার নেই। এই মনে হওয়াটা খুবই ক্ষতিকর হবে। এবং এই ধরনের মানসিকতার মধ্যে একটা ফ্যাসিবাদ লুকিয়ে আছে। তাহলো দেশের ভালো, গণতন্ত্রের ভালো, মানবতার ভালোটা কেবল আমরা বুঝি, আমরাই পারি।


বারবার করে বলি, গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র। জানি, ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাবদল গণতন্ত্রের পুরোটা নয়, ওটা একটা উপাদান মাত্র, কিন্তু ওটা না থাকলে গণতন্ত্রই থাকে না। যদিও বুশ সাহেব প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন কম ভোট পেয়েও, কী এক হিসাবনিকাশের মারপ্যাঁচে। কিন্তু আমেরিকার গণতন্ত্র আর আমাদের গণতন্ত্র তো সমান নয়। কাজেই আমাদের এমন একটা নির্বাচন দিতে পারতে হবে, যা বেশির ভাগের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং যাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে।


গ্রিক পুরাণে সেবিল চেয়েছিল হাতের মুঠোয় যত ধূলি ধারণ করা যায় তত বছরের আয়ু। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল যৌবন চাইতে। সে বেঁচে থাকল বটে, কিন্তু জরাগ্রস্ত। ছোট হয়ে গেল তার আকার, তাকে রাখা হলো একটা খাঁচায়, দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেবিল, তুমি কী চাও, খাঁচা থেকে সে উত্তর দিল: মরতে।


জোর করে দীর্ঘজীবন আদায়ের পরিণতি হয় এ রকম। জোর করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টার পরিণতিও গণতন্ত্রের জন্য, দেশের জন্য ও নিজেদের জন্য সুফল বয়ে আনে না। এটা আমরা সাম্প্রতিক অতীতে নিজেদের দেশেই কি দেখতে পাইনি?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।