শুরু হলো মধুমাসের মধুর মৌসুম। চারদিকে বাহারি ফলের মেলা। মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। ফলের বাজার জমজমাট। চলছে দারুণ বেচাকেনা।
অলিগলিতে ফেরিওয়ালারা ফল বিক্রি করছেন। ফল বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতেও। ঘরে ঘরে এখন দেশি ফলের বেশি মজা অনুভব করছেন সবাই। অতিথি আপ্যায়নেও কদর বেড়েছে ফলের। অবশ্য অতিথিরাও আনছেন ফলের ঝুড়ি বা ঠোঙা।
কারও হাতে আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, কলা, তরমুজ, বাঙ্গি, পেঁপে ইত্যাদি দেশি ফল। আবার কারও হাতে বিদেশি ফল আপেল, আঙুর, কমলা, মোসাম্বি ইত্যাদি। তবে দেশি ফলই তুলনামূলক বেশি।
কবি যেমন বলেছেন, গানে যেমন আছে `বাংলাদেশ ফুলের দেশ, ফলের দেশ, গানের দেশ, প্রাণের দেশ...। আসলে তা-ই ঠিক।
কত বিচিত্র স্বাদের ফলমূল মেলে এ দেশে-কালো জাম, পেয়ারা, আতা, কতবেল, চালতা, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, লেবু, তেঁতুল, কাজুবাদাম, ডালিম, ডেউয়া, তাল, গাব, বিলাতি গাব, বিলাতি আমড়া, জামরুল, জলপাই ও বরই/কুল, কামরাঙা, কাউ, লটকন, পানিয়ালা, মাকাল, বেল, করমচা, লুকলুকি, শরিফা, আঁশফল, সাতকড়া, খেজুর ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেক ফলই আমাদের অচেনা, স্বাদ-গন্ধ-আকার অজানা।
আজ আমরা বলব লিচুর কথা। সবার নিশ্চয় মনে পড়ে গেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতাটির কথা। শুরুর দিকটা আবার শুনলে কেমন হয়?
‘বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল্-কুকুরে/সে কি বাস করলে তাড়া,/বলি থাম্ একটু দাঁড়া।
/ পুকুরের ঐ কাছে না/লিচুর এক গাছ আছে না/ হোথা না আস্তে গিয়ে/য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে/গাছে গ্যে যেই চড়েছি/ছোট এক ডাল ধরেছি,/ও বাবা মড়াৎ করে/পড়েছি সড়াৎ জোরে। ...’
লিচু কিন্তু সারা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয় একটি ফল। আমাদের তো বটেই। তাই তো অনেক জায়গার নাম হয়ে যায় লিচুতলা কিংবা লিচুবাগান। সে যাই হোক, আসল প্রসঙ্গে আসি।
লিচু (Litchi) Sapindaceae গোত্রের Litchi chinensis গাছের ফল। ভালো জাতের লিচুগাছ মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে। ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা লিচুগাছ দেখতেও দারুণ। যখন বাগানে লিচু পরিপক্ব হয় তখন গাছগুলো ফলের ভারে মাটির দিকে নুয়ে পড়ে। থোকা থোকা লিচু দুলতে থাকে হাওয়ার তালে।
একেকটি গাছে হাজার হাজার লিচু। বেশির ভাগই একই আকারের। একই রঙের। কী সুন্দর সেই দৃশ্য! মাঘ-ফাল্গ–নে আমের মতো লিচুগাছে মুকুল আসে। তখনও লিচুবাগানে সৌন্দর্য লুটোপুটি খায়।
তবে গ্রামেগঞ্জে বিশাল বিশাল লিচুগাছও মাঝমধ্যে চোখে পড়ে। কিন্তু বড় বা বুড়ো লিচুগাছে ফলন হয় কম। গোলাপি বা হলদে সবুজ লিচুর পাতলা চামড়ার নিচে টলটলে নরম সুমিষ্ট শাঁস। লিচুর ত্বকটা কাঁটাযুক্ত। তবে সেই কাঁটা ভোঁতা।
লিচুর শাঁস খেতে অতুলনীয়। প্রাণ জুড়ায়। একসঙ্গে বেশি লিচু খেতে নিষেধ করেন বয়োজ্যেষ্ঠরা, এতে পাতলা পায়খানা হওয়ার শঙ্কা থাকে। লিচুর মাঝখানে তেলতেলে বাদামি রঙের বীজ বা বিচি। সেই বিচির মুখে কাঠি ঢুকিয়ে তৈরি করা যায় একধরনের খেলনা।
হাতের দুই আঙুল দিয়ে কাঠি ঘুরিয়ে দিলে লিচুর বিচিটি ঘুরতে থাকে মেঝেতে। এই দৃশ্য শিশু-কিশোরদের দারুণ আনন্দ দেয়।
মৌসুমি ফলের মধ্যে এখন হাত বাড়ালে পাওয়া যাচ্ছে লিচু। রসালো সব লিচুর হাতছানি উপো করা সম্ভব নয় ক্রেতা-পথচারীদের প। ে রাজশাহী-দিনাজপুরের লিচু পুষ্টিগুণ, আকার, সৌন্দর্যে বরাবরই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে থাকছে।
বড় বড় গোলাপি লিচুগুলো দেখলে জিবে জল না এসে পারে? পাশাপাশি বাঁশখালীর কালীপুরের লিচুও একটি অবস্থান সৃষ্টি করে নিয়েছে। তা-ই তো চট্টগ্রামের বিক্রেতাদের হাঁকডাক শোনা যায়, ‘কালীপুরের লিচু, কালীপুরের লিচু। ’ লিচুর দাম নির্ভর করে আকার ও স্বাদের ওপর। এখন বাজারে ১০০-২৫০ টাকায় প্রতি শ লিচু বিক্রি হচ্ছে।
লিচুর মূল আবাস কিন্তু চীন দেশে।
বিশেষ করে কাওয়াং তুং এবং ফুকিং প্রদেশ। লিচু নামটিও এসেছে চীনা ভাষা থেকে। লিচ্চি থেকে লিচু। চীনে অবশ্য এর নাম চাইনেন্সিস। বার্মা ও ভারতে পৌঁছায় ১৭শ শতকে।
আমাদের দেশের সব জেলাতেই লিচুগাছ দেখা যায়। তবে এখনো বাণিজ্যিকভিত্তিতে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ, ঢাকা জেলাতেই চাষ সীমিত। সোনারগাঁওয়ের লিচুও স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা এবং কক্সবাজারের টেকনাফেও উন্নত জাতের লিচুর চাষ হচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও উন্নতজাতের লিচুচারা বা কলম সংগ্রহ করে বসতবাড়ির আশপাশে লাগাচ্ছেন।
বিভিন্ন নার্সারি বা বৃমেলায় প্রচুর লিচুচারা বিক্রি হয়ে থাকে। বোম্বাই, মোজাফ্ফরপুরি, মঙ্গলবারি, চায়না, বেদানা, কদমি, মাদ্রাজি, এলাচ, বারি ১-৩ ইত্যাদি লিচুচারার বেশ চাহিদা ল করা যায়। লিচুর কাছাকাছি ফল হচ্ছে লংগান (কাঠলিচু) ও রাম্বুটান। তবে স্ট্রবেরিও দেখতে অনেকটা গোলাপি লিচুর মতোই।
সূত্র জানায়, লিচুতে আছে প্রধানত শর্করা (চিনি), প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন ‘বি’ এবং ‘সি’, ক্যালসিয়াম ও লোহা।
এ প্রসঙ্গে পুষ্টিবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের মতামত অগ্রগণ্য। চীন দেশে লিচু শুকিয়ে লিচু-বাদাম তৈরি করা হয়। কোনো কোনো দেশে লিচুর মোরব্বা তৈরি করে চিনির রসে সাইট্রিক এসিড দিয়ে টিনের কৌটায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরণ করে খাওয়া হয়। আমাদের দেশেও কৃত্রিমভাবে লিচু দিয়ে (লিচুর ফ্লেবার) বাচ্চাদের মুখরোচক খাবার তৈরি হচ্ছে। অনেক পরিবারে লিচুর রস দিয়ে তৈরি করা হয় সুমিষ্ট শরবত।
ইন্টারনেটে দেখেছি লিচু দিয়ে ওয়াইন, কালো চা, মধু, জ্যাম, জেলি, সিরাপ, সস, জুস, স্যুপ, ওষুধ ইত্যাদি তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও লিচুর নতুন জাত, লিচু দিয়ে নানান খাদ্য ও ওষুধ তৈরির ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।