এই পথে আলো জ্বেলে, এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে
গত বছর এলএইচসি (লার্জ হেড্রন কলাইডর) পৃথিবীর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। এবছরও কৃত্রিম প্রাণ সবার আকর্ষণের কেন্দ্র। মোটামুটি একসপ্তাহ আগে এই গবেষণার ফলাফল সবার সামনে এলো। যদিও কাজ শুরু হয়েছে ১৯৯৫ সালে, শেষ হয়েছে এখন হতে ছয়মাস আগেই। এই মুহুর্তে, এখন প্রফেশনালদের পাশাপাশি অনেক উৎসাহীরা পড়ে আছে ইন্টারনেটে, ঘাঁটছে এ বিষয়ক তথ্য।
বাংলাতেও দেখলাম বেশ কয়েকটা ব্লগ লেখা হয়ে গেছে। দেখলাম, কয়েকটি ব্লগে বেশ বিতর্কও শুরু হয়ে গেছে - গবেষণাটার সারাংশ, উপসংহার, প্রভাব নিয়ে। ছিদ্রান্বেষণও দেখলাম। কিন্তু বেশ অভাব বোধ করছি এটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা নিয়ে। ইংরেজিতেও খুব ভালোভাবে এখনও ব্যাখা নাই যে গবেষণাটা ঠিক কিভাবে হলো, পদ্ধতিটা কি ছিল।
যতটুকু আছে, তা হলো গবেষণাটার রিসার্চ পেপার থেকে নেয়া।
আমি এখনো পুরাপুরি বুঝি নাই যে কিভাবে কি হলো। আসলে একদল বিজ্ঞানী ১৫ বছর গবেষণা করে একটা জিনিস আমাদের জন্য নিয়ে আসবে, আর আমরা ১৫ মিনিট ব্যায় করে সেটা বুঝে ফেলবো, এটা তো আর হয় না। তবে মোটাদাগে কিছু বলতে পারবো। যেহেতু জীববিজ্ঞান অনেকের কাছেই অজানা, তাই একটু ভেঙে ভেঙে, সহজ করে বলার চেষ্টা করবো।
১
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের একটা সাধারণ সমস্যা আছে। সেটা হলো, তারা বিজ্ঞানের খবরগুলো ভালোভাবে দিতে পারে না। হয় বাড়ায়ে বলে, অথবা কমায়ে বলে। এই দুইটাই বিজ্ঞানের জন্য ক্ষতিকর। ২১ তারিখ যারা খবরের কাগজে জানলেন এই বিষয়টা নিয়ে, দেখলেন যে কৃত্রিম প্রাণ তৈরি হয়ে গেছে! তথ্যটা তারা এত ফুলিয়েছে যে খবরটা হারিয়েছে বস্তুনিষ্ঠতা।
আসলে তা না, গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে একটি ডিএনএর পূর্ণ খন্ড (জিনোম) তৈরি করা হয়েছে। এর আগেও কৃত্রিমভাবে ডিএনএ তৈরি করা হয়েছিল ( তথ্যসূত্র )। কিন্তু এই জিনোমটা একটা ব্যাক্টেরিয়ার কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার পর তা -
- নিজের মতো করে কাজ করেছে
- ব্যাক্টেরিয়া কোষ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচেছে
- কোষগুলো বংশবৃদ্ধি করেছে
সুতরাং, সাধু সাবধান, গুলিয়ে ফেলা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
এখন তাহলে জানা দরকার, ডিএনএ কি?
২
আমাদের শরীরটা যদি একটা দালান হয়, কোষ হচ্ছে সেই দালানের ইটের মতন। আমরা তো অনেক উন্নত প্রাণি।
ব্যক্টেরিয়ার মতো অনেক প্রাচীন জীব আছে যারা মাত্র একটা কোষ দিয়েই দিন আনে, দিন খায়। তাদের কোষ অনেক সরল।
কোষকে চলার জন্য অনেক কিছু করতে হয়। খাবার যোগাড়, শক্তি তৈরি, বড় হওয়া, কোষ বিভাজন করতে নানা রকম কাজ করতে হয়। একটা কোষ কিভাবে কি করবে, কি করবে না তার যাবতীয় নির্দেশ থাকে একটা এনসাইক্লোপিডিয়ার মধ্যে।
এই বিশ্বকোষটা হলো তার ডিএনএ। ডিএনএ কে আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রামের সোর্সকোডের সাথে তুলনা করতে পারি।
ডিএনএ নামের যেই বইটা, এইটা চারটা অক্ষর দিয়ে লেখf। এগুলো হলো এ, টি, জি, সি। ডিএনএ-র এক একটা অংশকে বলা হয় জিন।
এক একটা জিন, কোষের এক একটা বৈশিষ্ট্য বা কাজের জন্য দায়ী।
ডিএনএ কে একটা বিশাল ফুলের মালাও বলা যায়, যেই মালাটা মাত্র চারধরণের ফুল দিয়ে তৈরি।
তো বুঝাই যাচ্ছে, ডিএনএ খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তাইতো একে আদর করে বলা হয় Code of Life।
৩
মনে করেন, বিজ্ঞানী আরণ্যক একটা নতুন গ্যাস আবিষ্কার করলেন।
ধরেন গ্যাসটা কার্বন ডাই অক্সাইড। তিনি প্রথমে গবেষণা করে দেখবেন যে গ্যাসটা কোন কোন মৌল দিয়ে তৈরি। তারপর দেখবেন যে মৌলগুলো কিভাবে একটা আরেকটার সাথে বন্ধনীর মাধ্যমে যুক্ত আছে। তিনি দেখলেন যে এই গ্যাসটা কার্বন আর অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে গঠিত। এবং এর গঠন হলো:
O--C--O
তারপর তার কাজ কি হবে? তারপর তিনি চেষ্টা করবেন কিভাবে গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে এই গ্যাসটা তৈরি করা যায়।
পরবর্তীতে তিনি আবিষ্কার করলেন যে কার্বন আর অক্সিজেনের বিক্রিয়া করে গবেষণাগারে কার্বন ডাই অক্সাইড কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব।
৪
পৃথিবীতে প্রায় ষোল লক্ষ প্রজাতি। এক প্রজাতি হতে আরেক প্রজাতির পার্থক্য মূলত জেনেটিক কোডে। ডিএনএ-র লেখা তথ্যই ঠিক করে দেয় নতুন তৈরি কোষ কোন প্রজাতির জীবের।
এতদিন ধরে জীববিজ্ঞানে বিজ্ঞানী আরণ্যকের প্রথম কাজটাই হয়ে আসছিল।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জীবের ডিএনএ-র চারধরণের "ফুল" (আসলে বেস-পেয়ার, ক্ষারক-জোড়) কোন ধারবাহিকতায় সাজানো আছে সেটাই লিপিবদ্ধ করছিলেন কম্পিউটারে।
এখন যেটা হলো, জীববিজ্ঞান একটা বিশাল লাফ দিল! বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারে সংরক্ষিত জেনেটিক সিকুয়েন্স (ডিএনএ-র তথ্যের ধারা) অনুযায়ী গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তৈরি করলেন একটি পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ। অন্য একটি কোষে প্রবেশ করিয়ে দেয়ার পর যেটা কিনা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করা শুরু করলো।
তার মানে, মানুষ এখন আর কেবল ডিএনএ-র বই পড়তে পারে না। এখন সে সংকেত অনুযায়ী কৃত্রিমভাবে ডিএনএ-র বই লিখতেও পারে! এটা মানুষের লক্ষ বছরের ইতিহাসে একটা বিরাট মাইলফলক।
এই ঐতিহাসিক ঘটনা অন্যদের জানাতে আমি অত্যন্ত আনন্দ বোধ করছি।
এই বেলা তবে যাই? পরশু একটা পরীক্ষা আছে, তারপর না হয় বাকিটা লিখবো?
প্রথমে চতুর্মাত্রিকে প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।