‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’
‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ এখন খুবই উচ্চারিত শব্দ। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দশমিক ৫ থেকে ২ ডিগ্রি বাড়লে বাংলাদেশ সংলগ্ন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। এতে দেশের উপকূলের ১৫ ভাগ ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। মোট ৭১০ কিলোমিটারের এই উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে গেলে এ অঞ্চলের দুই কোটি অধিবাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
অনেকের আশঙ্কা, প্লাবিত এলাকার পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। ফলে সমানতালে উদ্বাস্তুর সংখ্যাও বাড়বে। এমনিতেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলার দেড় কোটি মানুষ লবণাক্ত পানির সঙ্গে বাস করছে। সুপেয় পানির সংকট সেখানে নিত্যদিন। নতুন করে এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে সংকটের ভয়াবহতা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এ দেশগুলোর দায় সবচেয়ে কম। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মানুষ নিহত হওয়ার পাশাপাশি ঘরবাড়ি, গাছপালা ধ্বংস হয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন জীবিকা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে, তখন পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তিরা চলে যান শহরে।
জলবায়ু উদ্বাস্তু প্রথমে পুরুষেরা হয়ে থাকে। এরা শহরে এসে ভিড় বাড়ায় মূলত অস্থায়ী দিনমজুর হিসেবে।
উপকূলে আমন ধানের উত্পাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে এ সময়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। তবে, খাদ্যনিরাপত্তা কমবেশি সবাইকে আঘাত করলেও নারীদেরই বেশি আঘাত করে। কারণ, আমাদের গ্রামসমাজে নারীকেই খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে বেশি ভাবতে হয়। দেখা যায় তারা প্রথমে শিশুদের খেতে দেয়, তারপর সংসারের উপার্জনশীল ব্যক্তিকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে। ফলে খাদ্যের ঝুঁকিটা নারীর ওপর ব্যাপক মাত্রায় পড়ে।
পুরুষ কর্মসংস্থানের জন্য স্থানান্তর হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নারী পরিবার নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই থাকে, ভোগে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার আবর্তে। এটা এসব অঞ্চলে দিন দিন বেড়ে চলেছে। উপকূলীয় এলাকায় কিছু বনায়ন কর্মসূচি আছে। বেড়িবাঁধের ভেতরে বসবাসকারী নারীরা যেভাবে থাকে, তাদের তুলনায় বাঁধের বাইরের নারীরা কিংবা চরাঞ্চলের নারীরা সাংঘাতিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
ডাকাতি এবং জলদস্যুতাও এসব অঞ্চলে প্রকট।
উপকূলের নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। মূলত নারীরা ঘরের কাজ বা জ্বালানি সংগ্রহ এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব হলে বা পানির লবণাক্ততা বেড়ে গেলে দীর্ঘ পথ হেঁটে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। উপকূলে কীভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তুর বসতি গড়ে তোলা যায়, উপকূলীয় নারীদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়—এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। প্রতিবছরের উন্নয়ন পরিকল্পনায়ও এদের জন্য আলাদা বরাদ্দ করতে হবে, না হলে এই জীবনপ্রবাহ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায়কে স্বস্তি দেবে না।
সময়ের কাজ সময়ে করার মধ্য দিয়ে একটি পথ তৈরি করতে হয়। ১৫ নভেম্বর ২০০৭-এ সিডর এবং ২৫ মে ২০০৯-এর ঘূর্ণিঝড় আইলাসহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের যে ভয়াবহ তাণ্ডব দেখেছি উপকূলে, তা থেকে বোঝা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা। এ জন্য প্রয়োজন উদ্যোগ, সঠিক পরিকল্পনা এবং যথাযথভাবে এর বাস্তবায়ন।
‘চারদিকে পানি, কিন্তু খাওয়ার পানি নেই
ছোট বেড়িবাঁধের ঝুপড়ির মদ্যি থাকতি থাকতি নিজেরে এহন আর মানুষ ভাবিনে। মাটির ওপর মাদুর বিছেয়ে শুতি শুতি নানা অসুখে ধরিছে।
খাবার নেই, পানি নেই, শান্তিমতো পায়খানা-প্রস্রাবের উপায় নেই। ঝুপড়িঘরের এক পাশে পশু, অন্য পাশে মানুষ। এইভাবে গাদাগাদি কইরে কত রাত একসাথে থাহা যায়?’
ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলেন খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতরখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কামাল শেখ। ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার পর চার মাস ধরে তিনি সপরিবারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের ঝুপড়িঘরে বাস করছেন।
কামাল শেখ জানান, আইলার পর চার মাসে দুবার তিনি সরকারের দেওয়া ৩৪ কেজি চাল ও তিন হাজার টাকা পেয়েছেন।
তা দিয়ে দুই মাস কোনোমতে তাঁর ছয়জনের সংসার চলছে। দুই মাস আগেও মাছ ধরে তিনি দিনে ১০০ টাকা আয় করতেন। এক মাস ধরে নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে জলাশয় থেকে মাছ ধরায় বিপদ রয়েছে। গত আড়াই মাসে পাঁচজন বাঘের আক্রমণে মারা গেছে।
তাই জীবিকার তাগিদে তাঁকে শহরে দিনমজুরি করতে যেতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আইলায় বিধ্বস্ত দাকোপের সুতরখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের ৫২ হাজার মানুষের একই কষ্ট। ইউনিয়ন দুটিতে দু-চারটি পাকা ভবন ছাড়া বাড়িঘরের চিহ্ন নেই। সহায়-সম্বল হারিয়ে বেশির ভাগ মানুষ পাউবোর বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিন দুমুঠো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি জোগাড়ে কঠোর সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের।
এর মধ্যে অনেকে আমাশয়সহ বিভিন্ন পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
কামারখোলা ইউনিয়নের জয়নগর ও ভিটেভাঙ্গা গ্রামে গেলে গ্রামবাসী জানায়, ঢাকী নদীর পানি থেকে গ্রাম দুটি রক্ষায় পাউবোর দুই কিলোমিটার বাঁধের ছয়টি স্থানে ৫০ থেকে ৬০ ফুট ভেঙে গেছে। স্থানীয় লোকজন বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। গ্রামে জমে থাকা পানিতে দুর্গন্ধ।
ওই ইউনিয়নের স্কুলশিক্ষক এস এম আব্দুল হান্নান বলেন, ‘কামারখোলা ইউনিয়নের শতভাগ মানুষ আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত।
হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কারও হাতে টাকা নেই যে খাবার কিনবে। চারদিকে পানি। বাঁধ মেরামত না করায় এই দুরবস্থা। এ সমস্যার সমাধান না হলে ইউনিয়ন দুটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। ’
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমিক্ষয় তীব্র হবে
বাংলাদেশে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস আর নদী ভাঙ্গনে প্রতিবছর গৃহহীন হয় হাজার হাজার মানুষ।
এই বাস্তুহীন নিঃস্ব মানুষদের বলা হয় পরিবেশগত উদ্বাস্তু। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমিক্ষয় তীব্রতর হবে। বাড়বে নদী ভাঙ্গন আর বাস্তুহীন মানুষের সংখ্যা। হাতিয়ার নলচিরা গ্রাম সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরেই এক সময় ছিল বাড়ি, ছিল চাষের জমি। হাতিয়া ভাঙ্গছে বহু বছর ধরে।
মূল দ্বীপের আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারিয়ে কেউ চরে, কেউ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ চট্টগ্রাম, রাজশাহী চলে গেছে।
নলচিলার ভুঁইয়া গ্রামে এখন নদী ভাঙ্গন তীব্ররূপ নিয়েছে। আগামী বছর হয়ত এই গ্রাম সমুদ্র গর্ভে চলে যাবে।
সমুদ্র গর্ভে চলে যাবে গ্রাম- একথা বুঝেও সমুদ্রের কাছেই দরিদ্র লোকেরা বাড়ি উঠায়। অর্থাভাবে ভাল স্থানেও যেতে পারে না।
উপকূলীয় অঞ্চলে এই ভাঙ্গা-গড়া স্বাভাবিক বলে মনে করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ (পশ্চিমবঙ্গসহ) পৃথিবীর ব-দ্বীপ। লক্ষ বছর ধরে এই ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছে।
এখনো এটি নির্মীয়মাণ। দক্ষিণে নতুন ভূমি, নতুন চর জাগছে। আর বাংলাদেশের আয়তন বাড়ছে।
তবে পরিবেশবিদ আইনুন নিশাতের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোনের তীব্রতা বাড়লে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতাও বাড়বে। ভাঙ্গা-গড়ায় মোট ভূমির পরিমাণ ঠিক থাকলেও কমবে আবাদযোগ্য জমি।
(চলবে)
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন -৩
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন -2
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন -১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।