Bangladesh: Dream
শ্রমিকরা যখন তাদের ‘প্রাপ্য বেতন-মজুরি’ আদায়ে রাস্তায় নামে তখন শিল্প-মালিক এবং সরকারের চোখে তা ‘দাবি আদায়ের নামে বিশৃঙ্খলা’ হিশাবে ধরা পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রাপ্য বেতন-মজুরি আবার আলাদা করে ‘দাবি’ করতে হচ্ছে কেন? এবং সেই দাবিতে নিজেদের বিক্ষোভ প্রকাশে রাস্তায় নেমে আসা ছাড়া শ্রমিকের সামনে আর কোনো পথ খোলা আছে কি? নাই। লিখেছেন মাহফুজুর রহমান মানিক
প্রাপ্য ন্যূনতম বেতন-মজুরিও ‘দাবি’ করতে হয়
আসলে ঠিক কী ‘দাবি’ করে শ্রমিক রাস্তায় নামছে ? কোনো বাড়তি সুযোগ সুবিধা কিম্বা সুরক্ষার দাবি করার ফুরসত শ্রমিকদের নাই। বাংলাদেশের শিল্প-শ্রমিকরা শুধু তাদের ন্যূনতম মজুরিটুকু প্রতিমাসে হাতে পেতে চায়, গার্মেন্টস শিল্পে যেই ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ এক হাজার ছয়শত বাষট্টি টাকা। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় কাজ করিয়ে নেবার পরও শিল্প-মালিকেরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে যথাসময়ে শ্রমিকের পাওনা মেটাতে নারাজ।
কাজেই নিরূপায় শ্রমিককে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। রাস্তায় না নেমে, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি’ না করে দাবি আদায় করা যায় না বুঝি! --শহরে তীব্র যানজটে আটকে থাকা নাগরিক-যাত্রীরা এমনতরো প্রশ্নও মূলত শ্রমিককে লক্ষ্য করেই করেন। না, শ্রমিকের অভিজ্ঞতা বলছে রাস্তায় না নেমে দাবি নিয়মিত মজুরিটাও প্রায়ই পাওয়া যায় না। কার্যত, পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয় নাই মালিক ও সরকারের তরফে। ট্রেড ইউনিয়ন নাই, এবং পার্টিসিপেশান কমিটি যে অল্পসংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠানে আছে, তাও নামকাওয়াস্তে।
এপ্রিলের ২৬ তারিখ থেকে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে। সেই পুরোনো বিপদে আটকে পড়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। বেতন-মজুরি না পাওয়ার বিপদ। সর্বশেষ ২০০৬ সালে বর্তমান বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। সর্বনিম্ন বেতন স্কেলের জন্য তখন মজুরি বোর্ডের সুপারিশ ২৩০০ টাকা থাকলেও মালিক পক্ষের চাপাচাপিতে নির্ধারণ করা হয় ১৬৬২ টাকা।
বর্তমান মূল্য ও মুদ্রা; দুইয়ের স্ফীতির এই বাজারে একজন শ্রমিকের নিজের পক্ষেই শহরতলীর বস্তিতেও দিনযাপন করা অসম্ভব। তিন বছর পার হলেও সে বেতনের আর পরিবর্তন হয় নাই। একদিকে এই নিম্ন মজুরি অন্যদিকে সেই মজুরি নিয়মিত না পাওয়ায় যখন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তখনই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। যে বিক্ষোভকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখেছেন বিশৃংখলা হিশাবে। তিনি এখানে ষড়যন্ত্র খুঁজছেন।
কিন্তু এই ক্ষোভের কথা রাস্তা ছাড়া আর কোথায় জানাতে পারে শ্রমিকরা? নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকরা কথা বলবে-- এমন কোনো নিয়ম ও ফোরাম তৈরি হতে দেয় নাই সরকার ও মালিক পক্ষ।
বিক্ষোভ এর বিকল্প হিশাবে শ্রমিকরা আর যা করতে পারে
ট্রেড ইউনিয়ন গঠন শ্রমিকের অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে এটা স্বীকৃত। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও দরকষাকষির বিষয়ে শ্রমিকদের জন্য আইএলও‘র ১৮৩ টি কনভেনশনের মধ্যে ৮৭ নং কনভেনশনটি ট্রেড ইউনিয়ন আর ৯৮ নং কনভেনশনটি দরকষাকষি সংক্রান্ত। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৩(ঘ) তে ও ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই বাংলাদেশের সরকার নজরে আনছে না।
দেশে ট্রেড ইউনিয়ন নাই। কাজেই শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা, তাদের প্রাপ্য আদায়ের জন্য দরকষাকষি ইত্যাদি করার কোনো ফোরাম নাই। যার ফলে অসংগঠিত বিক্ষোভ হচ্ছে। শিল্প মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন চায় না। শ্রমিকদের সাথে মালিকদের যোগসূত্র হিশাবে কাজ করার লক্ষ্যে পার্টিসিপেশন কমিটি গঠন করার কথা বলেছে সরকার।
সরকারের চাপে পড়ে এ পর্যন্ত ৪০০ টি প্রতিষ্ঠান পার্টিসিপেশন কমিটি গঠন করলেও অন্যরা করে নাই। যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান এ কমিটি গঠন করেছে তারাও সেভাবে কমিটিকে কাজ করতে দিচ্ছে না। অর্থাৎ সে কমিটি সক্রিয় নয়। একদিকে শ্রমিকের পেশাগত সংঘবদ্ধতার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না, অন্যদিকে শ্রমিকের কথা শোনার জন্য মালিক ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের তরফে যে ফোরামের কাজ করার কথা সেটি অকার্যকর আছে। এই অবস্থায় কাজের বিনিময়ে নিয়মিত ও যথাসময়ে বেতন-মজুরি আদায় করার জন্য শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ না করে কেবল একটি বিকল্প উপায়ের কথা ভাবতে পারে।
সেটি হচ্ছে-- নিয়মিত বেতন-মজুরির আশা না করে শুধু অবিরাম কাজ করে যাওয়া। এরই নাম হবে রপ্তানি, প্রবৃদ্ধি আর জাতীয় উন্নয়ন!
শিল্প বান্ধব শ্রমনীতি বনাম শিল্প পুলিশ
বেতনের দাবিতে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে শ্রম, কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ২৮ এপ্রিল সচিবালয়ে গার্মেন্টস মালিক সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনমাসের মধ্যে নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়ন করার আশ্বাস দিয়েছেন। শ্রমিকদের সন্তোষজনক বেতন কাঠামো নির্ধারণে সরকার কতোটা সক্ষম তা দেখার জন্য আমাদের তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে। মন্ত্রী বেতন কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে বাজারদরের কথা বিবেচনায় রাখার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ দেখিয়েছে কোনো পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি চারজন হয়, তবে বর্তমান বাজার ও আনুষঙ্গিক সকল কিছু বিবেচনায় রেখে সর্বনিম্ন খরচ ১৫ হাজার ৪৯৮ টাকা।
বর্তমানে পোশাক শ্রমিকদের গড় বেতন সাড়েতিন হাজার টাকার মত। বর্তমান বাজারে এ আয়ে জীবনধারণের ন্যূনতম উপকরণ সংগ্রহ করা অসম্ভব। তবু পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বেচে আছে, আশ্চর্যই বলতে হবে। অথবা তালাবদ্ধ হয়ে আগুনে পুড়ে কিম্বা অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেলেই বা কি?
একজন সুস্থ্য ও সবল শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা এবং কাজের দক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। উৎপাদনে গতি সঞ্চার করে সেটা শিল্পখাতের প্রতিযোগিতা স্বক্ষমতাই বৃদ্ধি করে।
ভারত ও চীন শ্রমিকদের পেছনে খরচ করে বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ। ভারতে ন্যূনতম মজুরি বাংলাদেশের টাকায় সাড়ে সাত হাজার টাকার বেশি এবং এ মাসের পহেলা মে পাকিস্তান নতুন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছে যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় নয় হাজার টাকা। সরকার ইতিমধ্যেই শ্রমনীতি ২০১০ (খসড়া) তৈরি করেছে। ন্যায্য মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বাধ্যবাধকতা, শ্রম কল্যাণ, স্বাস্থ্য সেবা, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে নারী সমতা ইত্যাদি চূড়ান্ত শ্রমনীতিতে থাকা চাই। শ্রমিকের এতসব সুরক্ষা ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হলেই পরে নীতিটি কার্যত শিল্প-বান্ধব হবে।
অবশ্য ‘নীতি’ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা মোটেই ইতিবাচক না। যেমন নারী নীতি ও শিক্ষা নীতি-- সরকার দীর্ঘ দিন ধরে এ দুটো নীতি কার্যকর করার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানে আছে। কাজেই শ্রমনীতি তিনমাসের মধ্যে চূড়ান্ত হবে আর তারপর তা খুব শীঘ্রই কার্যকর করা হবে-- সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আমাদের এই ভরসা করতে দেয় না। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের কথা বলার জায়গা ওই রাস্তায়ই থাকলো, আর প্রশাসনের কাজ হলো ‘শিল্পখাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চক্রান্ত’ রোধে পুলিশকে কাজে লাগানো! অবশ্য শ্রমিকদের ঠ্যাঙ্গানোর জন্য বিশেষ পুলিশ বাহিনী-- শিল্প পুলিশ বাহীনিও তৈরি করতে পারে সরকার।
সাম্প্রতিক শ্রমিক বিক্ষোভের ডেটলাইন
২৬ এপ্রিল: কাঁচপুর শিল্পনগরীর নয়াবাড়ি এলাকায় এসএফ ফ্যাশন কারখানায় বেতন বৃদ্ধি, হাজিরা বোনাস, ঐচ্ছিক ছুটির দাবিতে কারখানা ভাঙচুর এবং মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল।
২৭ এপ্রিল: নারায়নগঞ্জের কাঁচপুরে সিনহা গ্রুপের বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কাঁচপুর ব্রিজের পূর্ব পাড়ে সর্বনিম্ন মজুরি পাঁচ হাজার টাকা, কথায় কথায় শ্রমিক ছাটাই ও নির্যাতন বন্ধ, যাতায়াত ভাতা, ঈদ বোনাস, ঐচ্ছিক ছুটিসহ ১০ দফা দাবিতে বিক্ষোভ।
২৮ এপ্রিল: বেতন বৃদ্ধির দাবিতে মিরপুর ১৩ নম্বর সেক্টরের সি ব্ল¬কের ওপেক্স গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভ। একই দিন রূপগঞ্জে মোহাম্মদী গ্রুপের অ্যারো এ্যাপারেলসের শ্রমিদের দাবি দাওয়া আদায়ে বিক্ষোভ।
২৯ এপ্রিল: শ্রমিক নিপীড়ন ও বরখাস্তকে কেন্দ্র করে টঙ্গীর ভাদাম এলাকায় ৪টি রপÍানীমুখী পোশাক কারখানায় (তামশিনা ফ্যাশন ওয়্যার, তামশিনা ডায়িং, ইটাফিল স্যুয়িং ও ইনাফিল এক্সেসরিজ) বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হামলা ও ভাঙচুর করে।
৩০ এপ্রিল: মিরপুর ১৪ নম্বরের ভিশন গ্রুপের পোশাক উৎপাদন কারখানায় কয়েকশ শ্রমিক, এছাড়া আশেপাশের কারখানা এস আর পি, রোড স্টার, এবং টিউনিকের শ্রমিকদের রাস্তায় বিক্ষোভ।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।