পারলৌকিক হ্যাঙ্গারে হ্যাঙ্গ হয়ে আছে ইহকাল / পুনরায় জন্ম নেয়া এখন বিশেষ প্রয়োজন
যেকোনো মানুষের সাথে পরিচয়ের প্রথম কথা হলো আমি অমুক যায়গায় আছি। এর অর্থ হলো আমি একটি প্রতিষ্ঠানে কামলা হিসেবে নিয়োজিত আছি। যে যত বড়, যত আগ্রাসী প্রতিষ্ঠানে কামলাগিরি করেন পারিবারিক আর সামাজিক জীবনে তার দাপট তত বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে তিনি নিজেকে পুরো পীর, অর্ধেক রসূল ভাবতে থাকেন। মাঝে মাঝে ঈশ্বরকে আণ্ডারএস্টিমেট করার সাহস দেখান। তো এই হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকতা।
আর সব মিলিয়ে সবার কাছেই এই প্রাতিষ্ঠানিক কামলাদের গুরুত্ব অনেক। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ঐ দাপটটুকু নেই রিকশাঅলার আর লিটলম্যাগঅলার। কিস্তিবন্দী মানবজীবনে প্রাতিষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সেই প্রাতিষ্ঠানিকতা বিষয়ে অনেক লদকালদকি চলছে লিটলম্যাগ জগতে।
প্রতিষ্ঠান কী এ বিষয়ে আগে যা জানতাম তার সবকিছু গত কয়েক বছরে গুলিয়ে ফেলেছি জানার কয়েক মাসের মধ্যেই।
আর এর জন্য দায়ী কতক লিটলম্যাগ, তার লেখক, পাঠক (খুব গুছিয়ে ভাবতে ও বলতে পারা এবং একটু চেষ্টা করলেই লিখতে পারা এক গোষ্ঠী) ও সম্পাদক। প্রচণ্ড রাগ-ক্ষোভ-অভিমান নিয়ে শুরু করা লেখাটির আবশ্যকতা নিয়ে আমি এখনো বিভ্রান্ত। অন্তত যাচাই করা যেতে পারে বিষয়টি কে কীভাবে নিচ্ছেন।
...................................................................
কী এই প্রতিষ্ঠান
এর বিরোধিতারইবা প্রক্রিয়া বা প্রয়োজনটি কী?
...................................................................
সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত ইউনিট, প্রতিটি মূল্যবোধ এক একটা প্রতিষ্ঠান। সমাজ, ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র এরা স..অ..অ..ব একেকটা প্রতিষ্ঠান।
প্রতিটি নিয়ম, প্রতিটি ভাঙতে ইচ্ছে না করা প্রথা এমনকি সারা বছরের বৈদেশিক কালচারের মাঝে পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশও। শুধু পাবলিক লিঃ-প্রাইভেট লিঃ লেখা সাইনবোর্ডধারী বিল্ডিংগুলোই প্রতিষ্ঠান নয়। সেই বিচারে ছোটকাগজও একটি প্রতিষ্ঠান~ প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানকে আরো সহজে বিচার করা যেতে পারে~ যার পণ্য আছে এবং তা বাজারে বিকোতে হয়; বিকোবার বা মুনাফার জন্য তাকে মরিয়া হয়ে উঠতে হয়। আর বিরোধীদের কথা হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতি পণ্য হয়ে উঠলে তা তার স্বরূপ হারায়।
ঠিকমতো না বুঝেই (আমিও যে খুব বুঝে ফেলেছি সেটা অস্বীকার করছি) ক্ষেত্রবিশেষে শুনে শুনেই এই প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একদল লেখক-আধালেখক-প্রায়লেখক ফাইটার ষাঁড়ের মতো প্রশ্বাস ফেলছেন আর নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী রুপে প্রচার করছেন। এটিও একধরণের বিজ্ঞাপন যা প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। তাদের এ বয়ানটা এমন~আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী নবী; ফলো মি ... আমার তাবুর তলে আসো। কিন্তু বুঝতে হবে, সবাই নবী হতে পারে না, সহনশীল নাব্যতা সবার থাকে না, সবাই মিশ্র হতে পারে না। সুবিমল মিশ্রও কি চূড়ান্ত বিচারে প্রতিষ্ঠানবিরোধী? পৃথিবীর দিকে যাবো না (না জানাও অন্যতম কারণ), বাঙলাদেশে একমাত্র এস এম সুলতান ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানবিরোধী আমার নজরে আসে না; যদিও নিজের অজান্তেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠান করে ফেলেছিলেন বা প্রতিষ্ঠানকে কাছে ঘেসতে দিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর পর তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন।
যে বা যাঁরা নিজেকে তা দাবী করেন তাঁদের আমার ভণ্ড মনে হয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের খুব কম লোকই চেনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা থেকে যান অগোচরেই। সুলতানকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দেয়া তাঁকে বাজারজাত করে মুনাফা লোটার জন্যই। যারা তাকে ইট মেরেছে তাদেরকেও দেখা যায় সুলতানের স্তব করতে, কিছু না জানলেও সেমিনারের মাইক্রোফোনে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন~ সুলতান পেয়ারা খেতে পছন্দ করতেন।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানবিরোধীকে আবার বুদ্ধিজীবির খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে তাঁর অত্যাধিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রচারণায়। কখনো কখনো তাঁদের দেখা গেছে দল বা সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (সংগঠন বাদ গেল) চাটছেন।
বাঙলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী-প্রতিষ্ঠানবিরোধী/মহাপ্রতিষ্ঠানবিরোধী সুবিমল মিশ্রর মতে~ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা টোটাল ব্যাপার, যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী সে সব অর্থেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী; পাশাপাশি তিনি এও স্বীকার করেন যে, যেসব কাগজে তিনি লিখছেন সেগুলোকে পুরোপুরি ছোটকাগজ বলা যাবে না। একজন মানুষ তাঁর জীবন-যাপনে পুরোদস্তুর প্রাতিষ্ঠানিক আর সাহিত্যচর্চা করতে এসে প্রাতিষ্ঠানিকতার খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চান; বাদবাকী সময় কোলবালিশের কভারের ভেতর নিজেকে ঢোকাবার মতো ঢুকে বসে থাকেন প্রতিষ্ঠানের মলদ্বারের ভেতর। এইই হচ্ছে এ যুগের প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা।
......................সাহিত্য-সংষ্কৃতির ব্যবসায়িক কাগজের সংগে নিজের নাম জড়ানোকে আমি একধরণের বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না....................
~সুবিমল মিশ্র
সুবিমলকাকা ভালোই বোঝেন বলে এতো বোল্ড হরফে আমি তাঁকে কোট করতে পারি। কিন্তু সফার মতো বলতে হয় বৃষ্টি যখন আসে তখন সব ভিজে যায়, সেভাবে প্রতিষ্ঠান না থাকলে সুবিমলকাকা ভারত থেকে সমগ্র সাহিত্যের ভেতর ঢুকতেন কীভাবে? একটু যুতসই প্রচার পেলে তাঁর লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হতো, আলো-সমালো-চোনা হতো। এমনকি নোবেল কমিটি.....
...................................................................
বেশ্যাবৃত্তির প্রামাণ্য দলিল
...................................................................
তুখোড় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্লোগান দিয়ে বক-তৃতা শেষে নেতা নেমে আসেন মঞ্চের নিচে। নেতার গলা শুকিয়ে গেছে দেখে দরদী কর্মী নেতার হাতে তুলে দেন কোকাকোলা। নেতা পরম মমতায় কী দরকার ছিলো বলে ঢোকে ঢোকে গিলতে থাকেন তরল সাম্রাজ্যবাদ।
এর পরের দৃশ্যটি আরো মজার। নেতা বক-তৃতা শুনছেন, পরবর্তী বক-তা আরো ছাল তুলছেন এশিয়া অ্যানার্জির, নেতা টানছেন গোল্ডলিফ।
এভাবে পায়ের নখ থেকে চুলের আগা পর্যন্ত আমরা প্রাতিষ্ঠানিক, প্রাতিষ্ঠানিকতার পুঁজারী। আমাদের নিজস্ব পুঁজিতে আমাদের উৎপাদন বলতে যা আছে তা খুবই নগন্য। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাঙালির ফুটো থালার শেষ আধুলিটাও চলে যাচ্ছে নরওয়ে...
...................................................................
লিটলম্যাগও একটি পণ্য
...................................................................
আমাদের হোমড়া-চোমড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা বিদেশী মোবাইলফোন কোম্পানিকে রেভ্যিনু দিচ্ছেন কেউবা সেখানকার ফুলটাইম কামলা।
কেউ কর্পোরেট মিডিয়ায় তাঁদের লিটলম্যাগিও-প্রতিষ্ঠানবিরোধী মেধা দিয়ে জ্বালানী হচ্ছেন সেইসব কর্পোরেশনের। তারা আবার লিখছেন ছোটকাগজে আর নব্য লিটলম্যাগলেখক-সম্পাদকদের ভাবছেন নিজেদের খলিফা। কিন্তু তাঁদের প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে যখন পত্রিকা প্রকাশের সময় আমরা মাইক্রোসফট্ এর দাস হয়ে পড়ি—না বুঝেই এম এস ওয়ার্ড, পেজ মেকার, ইলাস্ট্রেটর, কোয়ার্ক, ফটোশপ নামের মার্কিন-আগ্রাসী-সাম্রাজ্যবাদী পণ্যগুলোর ভোক্তা হই হাতে লিখে পত্রিকা বের করার বদলে, আল্লাহু আকবর বলে ইয়াহুর খপ্পরে পড়ে যাই। মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে দেখি হযরত ড. মোহাম্মদ ইউনুস (সুদালায়েস্সাল্লাম) হুরবেষ্টিত হয়ে টেলিনরের (নর-নারীটেল) লোগো সম্বলিত পানপাত্রে পান করছেন বেহেশতি সুরা। কোনো কোনো লিটলম্যাগ ছাপা হয় (নামে লিটলম্যাগ) বিদেশী দামী কাগজে।
আর আমাদের ম্যাগগুলোর গতরে মূল্য সাটা থাকে, এটিও একটি পণ্য; লেখক পণ্য, লেখা পণ্য—যার উৎপাদন ব্যয় আছে সেটিতো পণ্য হবেই। শুধু বিজ্ঞাপন নিয়ে ছোটকাগজ করা যাবে না, বড় কাগজে লেখা যাবে না, বড় কাগজে যারা লেখে ছোটকাগজে তাদের মুর্তাদ ঘোষনা, বিজ্ঞাপনআলা ছোটকাগজে লেখা যাবেনা ইত্যাদি ভিত্তিহীন দর্শন পুষে রেখে আমরা নিজেদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল প্রমাণ করছি। যে কোনো বিষয়ে তীব্র/অটল মনোভঙ্গি মৌলবাদীতারই সামিল। তাই আমরা শুধু মৌলবাদের চর্চাকারীই না মৌল আবাদীও হয়ে উঠছি। যে বড় কাগজে লিখছেন তার অর্থপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যকে গণিকাবৃত্তি আর প্রচার প্রত্যাশাকে মানসিক বিকারই বলবো, কেননা শিল্প সৃষ্টি যখন হয় উদ্দেশ্যমূলক তখন তা হাইব্রিড টমেটো বা বয়লার মুরগি পর্যায়ে চলে যায়।
মহৎ সৃষ্টির আলামত বোঝেনা সৃষ্টিকর্তা নিজেও। সুমন গেয়েছেন~ কেউ ব্যাচে তার মেহনত হাতের পেশী.....আমি বেচি আমার পদ্য সুরের ভাষায়.....। তাই, বলে কয়ে আসুন, অবলম্বন করুন সর্বচ্চ সততা; কারণ সততাই মহত্তম পন্থা। এই লেখাটি বড় কাগজে ছাপতে পারলে আমি আনন্দে একাই নাচতাম না, সাথে আরো অনেককে পেতাম।
আজাদকে দেখেছি তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী শব্দটিকে পাত্তা দেননি; নিজের মতো করে সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী।
আর বাজারজাত হতে চেয়েছেন তাঁর মতাদর্শের প্রচারের জন্য, গণিমিয়ার ফ্যাক্টরিতে আজাদের সাহিত্য উৎপাদিত হয়নি।
আমরা সবাই বড় কাগজ খবরের জন্য পড়ি, কিছু কাগজ সুড়সুড়ির জন্য কিনি, সাহিত্যের জন্য নয়। যাঁরা ভাবছেন অনেক পাঠক পাবেন তাদের জন্য আমাদের ঘোষনা এই যে, বড় কাগজে যে কবিতাগুলো ছাপা হচ্ছে সেগুলোর নামই কবিতা (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে), জাত নয়। কারণ সেগুলো ছাপার লালসায় লেখা হয়, নাজিল হয়না। আমাদের কবিতা নাজিল হয়, আমরা চাইলেই লিখতে পারিনা যখন তখন।
...................................................................
কম্প্রোমাইজের ভিন্ন ভিন্ন রূপ
...................................................................
বিজ্ঞাপন নিয়ে ছোটকাগজ করা আমার কাছে কিছুটা নোংরামী মনে হয় বৈকি। কিন্তু এটা ছাড়া উপায় থাকে না দেখে আমি পাক বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনা বধের সাথে মেলাতে চাই। তাছাড়া সমস্যা আর একটা থাকেই, সেটা হচ্ছে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। বিজ্ঞাপন ছোটকাগজের সৌন্দর্য নষ্ট করে। স্বাভাবিকভাবে লিটলম্যাগের বিজ্ঞাপনগুলো দেখে কেউ পণ্যটির খোঁজ করেছেন কি না সন্দেহ।
বিজ্ঞাপন নিয়ে যদি একটা উৎকৃষ্ট ছোটকাগজ বের হয় ক্ষতি কী? বিজ্ঞাপনদাতাদের ফরমায়েশ মতো কি ছোটকাগজের লেখা তৈরী হয়? কারো কমাণ্ডে যে মাল তৈরী হয়না সে মাল বিক্রি হওয়া বা না হওয়াতে কিছু যায় আসে না। আর যাদের অঢেল টাকা বা যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে কাগজ করতে পারেন তাঁদেরতো নমস্কার-আদাব-সালাম.....।
হোক একটা উৎকৃষ্ট কাগজ; বিজ্ঞাপনে কিছু যায় আসে না। কেউ যদি দৈনিকে লেখে লিখুক না। সে নিজেকে বেচুক কি ভাড়া দিক সেই হিসেব করে আমাদের লাভ খুব সামান্যই।
সবাই কিন্তু আসলে লেখক না। আমরা প্রাধান্য দেব লেখাটাকে। আমাদের দরকার ব্যতিক্রম-বেপরোয়া-উস্কানিমূলক-স্থিতাবস্থাবিরোধী-এক্সপেরিমেন্টাল লেখা, যা শ্রেনীস্বার্থের ফার্মে পয়দা হয়না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।